ক্ষোভ থেকে জাহাজের মাস্টারকে, ধরা পড়ার ভয়ে বাকিদেরও হত্যা

4

পূর্বদেশ ডেস্ক

চাঁদপুরে সারবাহী এমভি আল-বাখেরায় সাত খুনের ঘটনায় আকাশ মন্ডল ওরফে ইরফান নামের যে জাহাজকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন, তিনি ক্ষোভ থেকে মাস্টার গোলাম কিবরিয়াকে কুপিয়ে হত্যা করেন বলে র‌্যাবের ভাষ্য। এই এলিট ফোর্স বলছে, ঘটনা জানাজানি হওয়ার ভয়ে ইরফান জাহাজের বাকি সাত কর্মীকেও কোপান, যাদের মধ্যে ছয়জনই মারা গেছেন। বাকি একজন শ্বাসনালী কাটা অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। খবর বিডিনিউজের।
গতকাল বুধবার কুমিল্লা নগরীর শাকতলায় র‌্যাব কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য তুলে ধরেন র‌্যাব-১১ এর উপ-অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন।
সোমবার বিকালে চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার মেঘনা নদীতে এমভি আল-বাখেরা থেকে পাঁচটি লাশ উদ্ধার করা হয়। এ সময় গুরুতর আহত আরও তিনজনকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন।
মেজর সাকিব জানান, আলোচিত এ ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরপরই গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে র‌্যাব। মঙ্গলবার রাতে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র‌্যাব-১১ ও র‌্যাব-৬ এর যৌথ অভিযানে ইরফানকে বাগেরহাটের চিতলমারী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ইরফান বাগেরহাটের ফকিরহাট এলাকার জগদীশ মন্ডলের ছেলে। তিনি জাহাজটিতে মাস আটেক ধরে কর্মরত ছিলেন। তার কাছ থেকে একটি হ্যান্ড গ্লাভস, একটি ব্যাগ, ঘুমের ওষুধের খালি পাতা, নিহতদের ব্যবহৃত পাঁচটি ও ইরফানের দুটিসহ মোট সাতটি মোবাইল ফোন এবং রক্ত মাখানো একটি জিন্সপ্যান্ট উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে র‌্যাব।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাতে মেজর সাকিব বলেন, জাহাজের কর্মচারীরা ছুটি ও বেতন-বোনাস সময় মতো পেতো না এবং বিভিন্ন ধরনের বিল কর্মচারীদের না দিয়ে জাহাজের মাস্টার একাই ভোগ করতো বলে গ্রেপ্তারকৃত আকাশ (ইরফান) জানায়।
সে আরো বলে যে, মাস্টার সকল কর্মচারীর উপর বিনা কারণে রাগারাগি করতো এবং কারোর উপর নাখোশ হলে তাকে কোনো বিচার বিবেচনা ছাড়াই জাহাজ থেকে নামিয়ে দিতো, এমনকি তাদের বকেয়া বেতনও দিতো না।
এ বিষয়ে ইরফান অন্যদের প্রতিবাদ করতে বললেও কেউ ভয়ে প্রতিবাদ করতো না বলে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি র‌্যাবকে বলেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মাস্টারের এমন সব আচরণে ইরফানের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং এই ক্ষোভ থেকে ‘উচিত শিক্ষা দেওয়ার’ পরিকল্পনা করেন। গত ২২ ডিসেম্বর সকালে ইরফান ও তার সহকর্মীরা চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে ৭২০ টন ইউরিয়া সার নিয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীর উদ্দেশে রওনা দেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইরফান ওইদিন সন্ধ্যায় রাতের খাবারের সঙ্গে ৩০টি ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেন। পরে ইরফান ও সুকানি জুয়েল ছাড়া বাকিরা রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত ২টার দিকে আরও ৮-১০টি জাহাজের সঙ্গে এমভি আল-বাখেরা নোঙর করেন জুয়েল ও ইরফান।
ঘটনার বর্ণনায় মেজর সাকিব বলেন, পরে রাতের খাবার খেয়ে সুকানি জুয়েলও ঘুমিয়ে পড়েন। এরপর সাড়ে ৩টার দিকে মাস্টার গোলাম কিবরিয়াকে জাহাজে থাকা চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন ইরফান। পরবর্তীতে সে চিন্তা-ভাবনা করে যে, জাহাজে থাকা বাকিরা জেনে গেলে সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ধরা পড়বে, বিধায় একে একে সবাইকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে।
এই র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, ভোরে অন্য জাহাজগুলো গন্তব্যে রওনা হলে ইরফান নিজেই আল-বাখেরা চালাতে থাকেন। একপর্যায়ে মাঝিরচর এলাকায় জাহাজটি আটকা পড়ে। তখন পাশ দিয়ে যাওয়া ট্রলারে তিনি বাজার করার কথা বলে উঠে পড়েন। এরপর ইরফান বাগেরহাটের চিতলমারী এলাকায় আত্মগোপনে চলে যান বলে ভাষ্য র‌্যাব কর্মকর্তা সাকিবের।
জাহাজে হতাহতের ঘটনা তদন্তে শিল্প মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশের তরফে পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছে। আর খুন ও ডাকাতির অভিযোগে অচেনা ১০ জনের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার রাতে মামলা করেন মালিকপক্ষের মাহাবুব মুর্শেদ।
এদিকে সারবোঝাই কার্গো জাহাজ এমভি আল বাখেরার ৭ স্টাফকে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আকাশ মন্ডল প্রকাশ ইরফানকে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল সন্ধ্যায় চাঁদপুরের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ফারহান সাদিকের আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নৌ পুলিশের পরিদর্শক মো. কালাম ১০ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করেন। এ সময় আদালত শুনানি শেষে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর শরীফ মাহমুদ সায়েম সাংবাদিকদের বলেন, একসঙ্গে ৭ জনকে হত্যার প্রকৃত কারণ এবং এই ঘটনার সঙ্গে আরো কেউ জড়িত কি না। তা আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে মূল ঘটনা বের করার জন্য আদালতের মাধ্যমে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে আবেদন জানানো হয়।