আমানউদ্দীন আবদুল্লাহ
গত সংখ্যার পর
(পর্ব-৬)
একটা পরিবারের সদস্যদের দিন কাটানোর জন্য যা যা প্রয়োজন সব কিছুই রয়েছে বাড়িটিতে। কিচেন-বাথরুমের যাবতীয় সামগ্রী এমনকি বয়াম ভরা বিস্কুট ও রয়েছে টেবিলে সাজানো। শুধু নেই মালিক পক্ষের কোন লোকজন। দুপুরে ফিশ এন্ড চিপস এবং রাত্রে গ্রীলড ল্যাম্ব চপ এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরদিন ভোরে চা-নাস্তা সেরে বাড়ি ফেরার পালা। দরজা লক করে তানিয়া সেই ছোট্ট বাক্সে চাবিটা রেখে গাড়িতে উঠে পড়ে।
এখানে প্রতিটি এরিয়াতে রয়েছে পরিবার নিয়ে সময় কাটানোর জন্য সবুজ পার্ক। পার্কের চারপাশে হাঁটার রাস্তা এবং মাঝখানে বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য রয়েছে দোলনা এবং রাইড। তানিয়াদের বাসার খুব কাছেই রয়েছে সবুজ গাছগাছালিতে সাজানো সুন্দর একটি পার্ক। বিকেলে সেই পার্কে হাঁটাহাঁটি করতে খুব ভালো লাগে। এলাকাটি নিরিবিলি হওয়ার কারণে এখানে সকাল সন্ধ্যায় আফগানী মহিলারাও হাঁটতে বেরোয়। হাঁটাহাঁটির এক পর্যায়ে আমি অনতিদূরে অবস্থিত মেলভিক গ্রোসারী শপে ঘুরতে যাই। মাঝেমধ্যে সেখান থেকে গরু এবং মুরগির মাংস ক্রয় করি। দোকানের মালিক আমিন সাহেবের সাথে পরিচিত হলে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করে।
সকাল বেলা নাস্তার টেবিলে বসে সিদ্ধান্ত হলো আপেল বাগান দর্শনে যাবো। ইতোমধ্যে তানিয়া গুগল ঘেঁটে কাছাকাছি দূরত্বের একটি আপেল বাগানের খোঁজ নিলো। পঁচিশ মিনিট পাহাড়ের ঢালুতে আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে ডেনডেনং রেন্জে অবস্থিত এই বাগানটিতে এসে পৌঁছি। প্রতিটি গাছই কাঁচা পাকা আপেলের ভারে মাটিতে নুয়ে পড়ছে। বাগানের অফিসের তাকে বিভিন্ন প্রজাতির আপেল রাখা আছে। দর্শনার্থীরা যার যার ইচ্ছে মতো আপেল, জুস্, জ্যাম ইত্যাদি ক্রয় করছে। ইতোমধ্যে বাগানের মালিক ক্রেতাদের জন্য ট্রাকটর ট্যুরের ব্যবস্থা করেছে। বাগানের একটা ট্রাকটরের পিছনে লাগেয়া লরির পাটাতনে গদি আঁটা চেয়ারে বসে পড়ি। কয়েক হাজার হেক্টর অধ্যুষিত বাগানটি আপেল গাছে ভরপুর। পথের দুইদিকের সারি সারি আপেল গাছের মধ্য দিয়ে গড় গড় শব্দ তুলে ট্রাকটরটি এগিয়ে চলেছে। আপেল ভর্তি গাছ গুলো সাদা রঙের মশারী দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। তারই ভেতর থেকে উঁকি মারছে রঙ বেরঙের কাঁচা পাকা আপেল। দেখতে এতো সুন্দর লাগছে যে চোখ ফিরানো মুশকিল। অবশেষে ট্রাকটর তার ট্রিপ শেষ করে আমাদেরকে যথাস্থানে নামিয়ে দেয়। এদিকে বিকেলে আমার নাতি আরিজ তার বারোতম জন্মদিনের ডিনার খাওয়ার জন্য তার মায়ের কাছে আবদার করতে থাকে। অতএব সিদ্ধান্ত হলো এখান থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে ক্লেটনে গিয়ে ইন্দোনেশিয়ান রেস্তোরাঁতে ডিনার করা হবে। রেস্তোরাঁটি এ অন্চলে হালাল খাবারের জন্য প্রসিদ্ধ। আগে থেকে অনলাইনে বুক করে যেতে হয়। বাইরে তাপমাত্রা দশ ডিগ্রিতে উঠা নামা করছে। তাই সবাই গরম কাপড় চোপড় নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ি। রেস্তোরাঁয় পৌঁছে দেখি এটি ওই দোকান যেখানে একদিন ইফতার করতে এসেছিলাম। আরিজের পছন্দমতো ডিনারের অর্ডার দেয়া হলো। বিনি চালের ভাতের সাথে কাঁচা মরিচ বাটা দিয়ে ডিম পোছ,সালাদ এবং বোনলেস চিকেন। এটাই নাকি এখানকার জনপ্রিয় খাবার। তবে আমার জন্য নয়। প্রচন্ড ঝাল ভাত মুখে দিতেই আমার ছেলে মাসুমের নাগা মরিচ খাওয়ার কথা মনে পড়ে গেল। অতপর অনেক কষ্টে খাবারগুলো খেয়ে মুখে ওহ আহ শব্দ করতে করতে বাসায় ফিরে আসি।
আমার জামাই শহিদুল্লাহর পরিচিত এক ভদ্রলোকের দাওয়াত রক্ষার্থে একদিন সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখি আরো কিছু পরিবারকে উনি দাওয়াত করেছেন। চট্টগ্রামের নিমতলা নিবাসী একজন মাঝবয়েসী অতিথির সাথে আলাপ হলো। উনি সপরিবারে ক্র্যানবোর্নেই থাকেন। আগামী কদিন পরে দেশে যাবেন আবার কুরবানির ঈদের আগেই ফিরে আসবেন। কিছুদিন এখানে থেকে আবার চলে যাবেন। এভাবে আসা যাওয়া করেই উনার জীবন কাটাচ্ছেন। উনার মুখেই শুনলাম এখানকার প্রতিটি এলাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ এশিয়ানরা বসবাস করে। তৎমধ্যে চীনা এবং ভিয়েতনামের বাসিন্দাই বেশি। এর পরে ভারতীয়, পাকিস্তানী,শ্রীলংকা,আফগানী এবং সবশেষে বাংলাদেশীদের স্থান। অস্ট্রেলিয়ান তথা অজি রমনীরা সংসারবিমুখ। অজি পুরুষরা সংসারী হওয়ার মানসে এশিয়ান তথা চীনা এবং ভিয়েতনামী মহিলাদের ব্যাপকহারে বিয়ে করে চলেছে। তাই পার্ক রেস্তোরাঁ শপিং মলে অজিপুরুষদের সাথে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে এশীয় স্ত্রীদেরকে চলাফেরা করতে বেশি দেখা যায়। আবার এসমস্ত এশীয়ান ইমিগ্রান্টরা ব্যবসা করার সুযোগে নিজের দোকানে আগুন লাগিয়ে ইন্সুরেন্স এর মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার প্রবণতা ও লক্ষণীয়।
ইদানিং আমরা প্রতিদিনই বেড়াতে যাচ্ছি কাছে দূরে কোথাও। ভিক্টোরিয়া প্রদেশের প্রতিটি দর্শনীয় স্থান তানিয়ার বাসা থেকে ত্রিশ/ চল্লিশ মিনিটের ড্রাইভে যেতে হয়। তবে ইতোমধ্যে বুঝতে পেরেছি যে, এখানকার শহরের সড়ক আর গ্রামের সড়ক পথ এবং ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেমের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বলা যায় পুরো ভিক্টোরিয়া অন্চলের ট্রাফিক ব্যবস্থা অত্যন্ত সুচারুভাবে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বিন্যস্ত করা হয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা সবাই আইন মেনে চলে এবং আইনকে শ্রদ্ধা করে। আমাদের দেশের গ্রাম আর এদেশের গ্রামের মধ্যে বিশাল পার্থক্য।এখানে যে কোন একটি উপশহর গড়ে উঠার আগে প্রশাসনের প্রতিটি বিভাগ থেকে জরিপ কার্য চালানো হয়। তার পর পানীয় জল,পয়োনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ গ্যাস ইত্যাদির সরবরাহ লাইন স্থাপন এবং প্রয়োজনীয় প্রশস্থ সড়ক স্থাপনের শেষে জমির লিজ গ্রহিতা কোম্পানি নিজস্ব নক্শাপ্রণয়ন করে স্কোয়ার মিটারের বিত্তিতে প্লট বিক্রয় শুরু করে। সেই প্লটের মূল্য জায়গা ভেদে উঠানামা করে। বিশেষ করে শপিংমল, স্কুল,কলেজ,ক্লিনিক ইত্যাদির কাছাকাছি জায়গার প্লট বা বাড়ি গুলোর দাম বেশ চড়া।
তানিয়ার বান্ধবী এবং তার স্বামী একদিন প্রস্তাব দেয় দূরে কোথাও গিয়ে বনভোজন করার জন্যে। সেই মথ্যে আমরা একদিন পিকনিকের যাবতীয় সামগ্রী নিয়ে রওয়ানা হই ১১৭ কিলোমিটার দূরবর্তী আউষ্ট ম্যাসেডোন নামক এক পাহাড়লী উপত্যকার উদ্দেশ্যে সেদিন ছুটির দিন ছিলো তাই গন্তব্যস্থলে গিয়ে গাড়ি পার্কিং এর সমস্যায় পড়তে হয়। ম্যামেডন পাহাড়ের উপত্যককায় অনেকগুলো পিকনিক স্পট রয়েছে প্রতিটি স্পট ই লোকে লোকারণ্য। শীতের আগমনী সময়ে এসব অঞ্চলে গাছে গাছে রঙিন পাতার সমারোহ। বাতাসের দোলানীতে পাতাগুলো ঝরে যাওয়ার সে এক অপূর্বদৃশ্য। ঝরেপড়া পাতাগুলো মাটিতে পড়ে রঙিন গালিছার মতো দেখতে লাগে। এ অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করার জন্যেই এখানে হাজার হাজার লোক পরিবার ছুটে এসেছে। ইতোমধ্যে আমরা নিরিবিলি পরিবেশে একটি পিকনিক স্পট খুঁজে পাই। এখানে বাচ্চাদের দোলনা, ¯িøট, বসে গল্প করার জন্য কাঠের বেঞ্চ, বারবিকিউ করার জন্যে বৈদ্যুতিক চুলা, পানীয় জলের টেপ এবং ওয়াশরুমের ব্যবস্থা রয়েছে। তানিয়া ওর বান্ধবীকে নিয়ে রান্না বান্নায় ব্যস্ত হয়ে গেছে। বাসা থেকে অন্যান্য পোর্টেবল গ্যাস কুকারে রান্না চলতে থাকে। আমি ভদ্র মহিলার স্বামীর সাথে গল্পে মেতে উঠি মাঝ বয়েসী ভদ্রলোকের নাম আজাদ। পিতা ভভারতের চেন্নাই নিবাসী। চাকরি সূত্রে বাংলাদেশে এসেছিলেন। অথপর পুরান ঢাকার এক বনেদি পরিবারের মেয়ের পানি গ্রহণ করেন। আজাদ সাহেব তাদের প্রথম পুত্র। তিনি পিতা মাতার সাথে ঢাকাতেই বড় হয়েছিল। মাঝেমধ্যে পিতৃভূমিতে বেড়াতে যান।
যাই হোক ইতোমধ্যে তানিয়া ওর বান্ধবীকে নিয়ে খিচুরি, মুরগি এবং ডিম রান্না করে ফেলেছে। অনতিদূরে আরো দু’চারটি ভারতীয়, শিখ এবং আফগানী পরিবার রান্না বান্নায় ব্যস্ত। দর্শনার্থী এবং পিকনিকে আগত লোকদের জন্য এ অঞ্চলের প্রশাসন এতো সুন্দর ব্যবস্থা করে রেখেছে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। আমরা খাওয়া দাওয়া সেরে আজাদ পরিবারের কাছে বিদায় নিয়ে বাসার পথে রওয়ানা দিই। এই বিদেশ বিভ‚ইয়ে এসে বাংলাদেশি পরিবারগুলো একে অপরের সান্নিধ্যে এসে কিছুটা সময় এভাবে সুখ দুঃখ ভাগ করে নেয়। এদেশে এসে সবচেয়ে বড় পাওনা।
চলবে –
লেখক : প্রাবন্ধিক