ক্যাঙারুর দেশে পরিযায়ী বেশে

1

আমানউদ্দীন আবদুল্লাহ

গত সংখ্যার পর

খুবই সুন্দর সাজানো গোছানো চার বেড রুমের বাড়িটি এক কথায় অপূর্ব। আমাদের নাতি আরিজ এবং নাতনি সুবাহ ও শাহিরা আমাদের পেয়ে যতনা আনন্দিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি মন ভারাক্রান্ত হয়েছে বাংলা বলতে না পারার কারণে। বাংলা ভাষা বুঝলে ও শুদ্ধ ভাবে প্রকাশ করতে পারেনা। যাক প্রথম কয়েকদিন ঘুমে ঘুমে কেটে গেলো। ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর হয়ে মেলবোর্ন পৌঁছানো পর্যন্ত প্রায় বারো/ তেরো ঘন্টা সফরের ঝক্কি গেছে শরীর ও মনের উপর। এখানকার সময় প্রায় পাঁচ ঘন্টা এগিয়ে থাকার কারণে সময়টাকে মানিয়ে নিতে কয়েকদিন কেটে গেলো। ইতোমধ্যে একদিন তানিয়া আমাদেরকে ড্রাইভ করে শহর ঘুরাতে নিয়ে গেলো। ক্র্যানবোর্ন কে একটা স্বায়ত্তশাসিত উপশহর বলা চলে। এর আলাদা প্রশাসন রয়েছে যার কাজ রাস্তা ঘাট,ট্রাফিক কন্ট্রোল, পার্ক,লেক,গৃহস্থালি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি তদারকি করা। তানিয়ার ভাষ্য হচ্ছে এখানে আসার পর সাত বছর কেটে গেছে কিন্তু মুহূর্তের জন্যেও বিদ্যুৎ,গরম-ঠান্ডা পানি ইত্যাদির কোন সমস্যা দেখা যায়নি। এগুলো নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চলমান। এখানে আমার সব চেয়ে বেশি নজর কেড়েছে ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেমের এত উন্নতি দেখে। এসমস্ত উপশহরগুলোতে বড়ো বড়ো এপার্টমেন্ট বিল্ডিং নেই। আছে শুধু অত্যন্ত পরিপাটি ভাবে সাজানো একতলা দোতলা বাড়ি। প্রতিটি বাড়ির সাথে একটি গ্যারেজ এবং বাড়ির পিছনে ঘাসে ঢাকা খোলা যায়গা। কয়েক টা বাড়ির পর পরই দুই পাশে ফুটপাত সহ প্রসস্থ রাস্তা। বাড়ির পাশের রাস্তাগুলো বড়ো রাস্তায় গিয়ে মিশেছে যেখানে রয়েছে সার্বক্ষণিক সিগনাল বাতির সংকেত যা মানতে প্রতিটি চালক বাধ্য। মেলবোর্ন এর আশেপাশে যত উপশহর রয়েছে তার প্রতিটিতেই ভারতীয়দের পাশাপাশি আফগানীদের সংখ্যাধিক্য লক্ষ্যণীয়। আফগানীরা নাকি শত বৎসর আগে বিশাল উটের বহর নিয়ে এ অঞ্চলে এসে আস্তানা গেড়েছে। তাই এখানে ক্যাঙারুর পাশাপাশি উটের সারি ও দেখা যায়। হাজারা স¤প্রদায়ের এ সমস্ত আফগানী আবার শিয়া মতাবলম্বী। তারা ব্যবসা বানিজ্য চাকরি বাকরিতে খুবই অগ্রসরমান। মুসলমানদের সংখ্যা গরিষ্ঠতার কারণে এখানে যথেষ্ট হালাল খাদ্যের দোকান রয়েছে।
এখানে এক দুই কিলোমিটার দূরে দূরে বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে বিজনেস এরিয়া। প্রতিটি এরিয়াতে রয়েছে পার্কিং লট,গ্যাস স্টেশন, ফার্মেসি, গ্রোসারি সপ্, ম্যাগডোনাল্ড,পিজা, কে এফ সি, সেলুন, রিয়াল এস্টেট,ট্র্যাভেল এজেন্ট ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা। আবার কয়েকটা এরিয়া মিলে রয়েছে লোকাল ক্লিনিক এবং প্যাথলজি সেন্টার। এখানে প্রতিটি নাগরিকের হ্যাল্থ ইন্সিওরেন্স রয়েছে যার ফলে এখানকার স্বাস্থ্যসেবা অনেকটা সুনিয়ন্ত্রিত এবং ঝামেলা বিহীন। ঔষধ কেনা হয়ে গেলে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ফার্মেসিতে সংরক্ষণ করা হয় পরে তারা জিপি অফিস তথ্য জেনারেল প্রাকটিশনারের অফিসে ফেরত পাঠায়। বিভিন্ন ধরনের টেস্ট এর রিপোর্ট যাচাই বাছাই করে জিপি সিদ্ধান্ত দেবে পরবর্তী কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখাবার প্রয়োজন আছে কিনা। এখানে একই ওষুধ বহুদিন ধরে ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হয়।
রিয়েল এস্টেট এখানে খুবই ব্যয়বহুল। চার পাঁচ শত স্কোয়ার মিটারের বাড়ি বিক্রি হচ্ছে ছয়/ সাত লাখ ডলারের মধ্যে। এছাড়া তিন চার বেড রুমের বাড়ি ভাড়া সপ্তাহে ছয় সাত শত ডলারের কাছাকাছি নেয়।
ক্যাঙারুর দেশে এসে ক্যাঙারুর সাথে দেখা করবোনা তা কি হয়? অতএব একদিন আমাদের আবাসস্থলের অনতিদূরে লিচেস্টার ফিল্ড পার্ক নামক পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত ক্যাঙারু বিচরণ দেখতে গেলাম। পাহাড়ের গা ঘেঁষে উঁচু নিচু রাস্তা দিয়ে প্রায় পঁচিশ মিনিট গেলে অসংখ্য ক্যাঙারুর দেখা পাই। দেখতে অনেকটা হরিণাকৃতির নিরীহ জীব গুলো সামনের ছোট দুই পা তুলে পিছনের পা এবং শক্ত মোটা লম্বা লেজের উপর ভর দিয়ে খাদ্যের জন্য দর্শনার্থীদের পিছে পিছে ছুটাছুটি করছে। ইতোমধ্যে আমরা বেশ কিছু ছবি তুলে নিই। পাহাড়ের ঢালুতে এদিক ওদিক ছড়ানো অসংখ্য কাঠের চেয়ার টেবিল পাতানো রয়েছে। ক্যাঙারুর পিছনে দৌঁড়াতে গিয়ে আমার আদরের নাতি আরিজ কাহিল হয়ে পড়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে সে আমার পাশে এসে বসতে বসতে বলে, নানা ভাই আই এম টায়ার্ড এন্ড হান্গরি! অতপর আমরা সাথে আনা ঝাল মিস্টি নাস্তা নিয়ে খেতে বসি। ইতোমধ্যে বেশ কিছু নাম না জানা রঙিন পাখি এবং সাদা কালোয় মেশানো রঙের কাক এসে আমাদের পাশে ওড়াউড়ি করছে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। এবার যাবার পালা। যাওয়ার আগে ক্যাঙারুদের সাথে বেশ কিছু ছবি তুলে নিই। গাছের ছায়ায় চাদর বিছিয়ে খোশ গল্পে রত আফগানী পরিবারটি ফিরে যাবার জন্য উঠে পড়ে। আমরাও পাত তাড়ি গুটিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা দিই।
ইতোমধ্যে একদিন জামাই শহিদুল্লাহ প্ল্যান করে ফেলে মেলবোর্ন সিটিতে গিয়ে ডিনার করার জন্য। উপলক্ষ আমাদের বড়ো নাতনি ষোড়শী সুবাহর জন্মদিনের খানা। অতএব রোদেলা বিকেলের ছায়া সুনিবিড় ক্র্যানবোর্ন এর নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে এবার মূল শহর মেলবোর্ন এর পথে যাত্রা। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের যাত্রার শেষ পর্যায়ে আমরা মেলবোর্ন এর সিবিডি তথা সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট এর নির্দিষ্ট এলাকায় এসে পৌঁছি। পুরো এলাকাটি নানান দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার দাবার এর দোকানে ভর্তি। সড়কের দুই পাশে সারিবদ্ধ ওসব রেস্টুরেন্ট। দোকানের বাইরের ফুটপাতে চেয়ার টেবিল পাতানো রয়েছে। সেই টেবিল গুলো ঘিরে চলছে অগনিত নারী পুরুষের জমজমাট আড্ডা আর খানাপিনা। প্রচন্ড ভীড় ঠেলে আমাদের প্রত্যাশিত রেস্টুরেন্ট টি খুঁজে পেতে কষ্ট হয়েছে। আগে থেকে বুক করা না থাকলে এখানে সিট পাওয়া মুশকিল। এখানে ও দেখা গেল আফগানীদের জয় জয়কার। বেশির ভাগ দোকানের মালিক তারাই। প্রতিটি দোকানে নানান পদের মুখরোচক কাবাবের ছড়া ছড়ি। প্রচন্ড ভীড়ের কারণে ওয়েট্রেসরা খাবার সরবরাহ করতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে ফলে আমাদেরকে ও খাবার পেতে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। তানিয়ার মুখেই শুনতে পাই এ অঞ্চলে দোকানটির খুব খ্যাতি রয়েছে। তাই আগে ভাগে বুকিং না দিলে এখানে যায়গা পাওয়া যায় না। খানা শেষে বিল পরিশোধ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ি। আমার ক্রেডিট কার্ড টা কিছুতেই ব্যবহার করতে দিলোনা। শহিদুল্লাহ আমাকে থামিয়ে নিজেই বিল পরিশোধ করে দেয়। ভুরিভোজ শেষে আমাদের ফেরার পালা। মেলবোর্ন এর আলো ঝলমলে পরিবেশকে পিছনে রেখে আমরা ফিরে চলি নিরিবিলি শান্ত উপশহর ক্র্যানবোর্ন এর পথে।
ওদের বাসায় খুবই সুন্দর দুটো বিড়াল আছে। পরিবারের সবাই তাদেরকে সার্বক্ষণিক ভাবে কোলে পিঠে নিয়ে আদরে মাতিয়ে রাখে। পটি ট্রেনিং দেয়া শেনেল এবং হেজেল নামের পশমাবৃত বিড়াল দুটো মাঝে মধ্যে এসে আমাদের পায়ের কাছে গুটি শুটি মেরে বসে থাকে। এ বাসায় ওদের স্বাধীন ভাবে বিচরণের অনুমতি রয়েছে ফলে তারা কখনো সোফা, কখনো বিছানা আবার কখনো ডাইনিং টেবিলে উঠে গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে থাকে। তাদের জন্য রক্ষিত দানাদার খাবার ছাড়া অন্য কোন খাবার তারা স্পর্শ করেনা। এমনকি টেবিলে উঠে পায়চারি করলেও কোন খাবার দাবারে মুখ দেয়না। দেখতে দেখতে আমাদেরকে ও তারা আপন করে নিয়েছে। কিউট বিড়াল দুটো সারাক্ষণ এঘর সেঘর ছুটাছুটি করে। আমার মেয়ে তানিয়া বিড়াল দুটোকে কোলে নিয়ে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় । ওরাও মায়ের স্নেহের পরশ পেয়ে খুব আনন্দ উপভোগ করে। এখানে পথে ঘাটে নানান জাতের পাখির বিচরণ দেখা যায়। ওদের কে নিয়ে কেউ ঘাটাঘাটি করেনা ফলে মনের আনন্দে তারা দলবেঁধে ওড়াওড়ি করে। বাসার সামনে দেখা গেলো পাঁচ কেজি ওজনের দুটো মোটা চাউলের ব্যাগ। আমার নাতি আরিজকে জিগ্যেস করতেই সে বললো ওগুলো পাখিদের খাবার। সে প্রতিদিন সকালে উঠে সেখান থেকে মুঠো ভরে চাউল নিয়ে বারান্দায় রাখা একটা বেদিতে রেখে আসে। আর সারাদিন নানা ধরনের পাখি এসে সেই চাউল খেয়ে যায়। পশুপাখিদের প্রতি তাদের এই মায়ামমতা ভালোবাসা দেখে মনটা আমার আপ্লুত হয়ে গেলো।
একদিন ভারতীয় এবং মালয় অধ্যুষিত ক্লাইড নামক এক উপশহরে যাই বেড়াতে। উপলক্ষ ঘুরাঘুরি করে সময় কাটানো। তানিয়া আমাদের জন্য একটা মালয়েশিয়ান হালাল রেস্তোরাঁর খোঁজ করছিলো। এ শহরের প্রতিটি সড়কের দুই পাশে অজগ্র ভারতীয় দোকানের ছড়াছড়ি। এলাকাটিতে এশীয় প্রবাসী ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপক পদচারণা লক্ষ্য করলাম। অনতিদূরে অবস্থিত বিখ্যাত মনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ক্যাম্পাস। আমাদের সাত জনের জন্য কোন রেস্তোরাঁতে বসার সিট পাওয়া মুশকিল হলো। চাইনিজরা খুবই গল্পপ্রিয়। দল বেঁধে সপরিবারে খেতে এসেছে তারা। সিট বুকিং দিয়ে রেস্তোরাঁর এক কোনায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে পা দুটো আমার ব্যাথা হয়ে গেছে। অতপর সিট খালি হলে তড়িঘড়ি গিয়ে তা দখল করে ফেলি। এবার খাবারের অপেক্ষা। মাত্র তিনজন ওয়েট্রেস এর পক্ষে লোকভর্তি এতবড় একটা রেস্তোরাঁ সামাল দিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। বেশ কিছুক্ষন পরে আমাদের প্রত্যাশিত খাবার এসে পৌঁছলে যেন দেহে প্রাণ ফিরে পাই। মালয়েশিয়ান অথেনটিক খাবার গুলো খুবই মুখরোচক।
একদিন সকালে নাস্তা সেরে আমরা রেইন ফরেস্ট দর্শনে রওয়ানা হই। এখান থেকে সোয়া ঘন্টার ড্রাইভে পাহাড়ি জনপদ ওয়ার টন এবং ইয়ারা ভ্যালির চূড়ায় অবস্থিত রেইন ফরেস্ট পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত একটি যায়গা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভ্রমণ পিপাসুরা সারাক্ষণ গিজ গিজ করছে এখানে। রাঙামাটির মতো আঁকা বাঁকা পাহাড়ি সড়ক বেয়ে ধীরে ধীরে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে আলো আঁধারী পরিবেশে অরণ্যের ভীতর গাড়ি প্রবেশ করলে ভয়ে গা শিউরে উঠে। একেবারে চূড়াতে নাম না জানা উঁচু গাছের শাখায় আবৃত সমতল চত্বর। সেখানে পৌঁছে ঘন অরণ্যের ভিতর চোখ পড়তেই কেমন জানি গায়ে হিম ধরে যায়। প্রায় সত্তর ফুট উঁচু কাঠের ওভার ব্রিজ দিয়ে পর্যটকরা হেঁটে চলেছে গভীর অরণ্যের ভিতর। এখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করার কোন উপায় নেই। চামচিকা, বাদুড় আর পেঁচার আওয়াজে সেকি ভীতিকর পরিবেশ।
অবশেষে আমরা রেইন ফরেস্ট এর বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ির পথ ধরি। আসার পথে পাহাড়ের ঢালুতে বিশাল বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠা গরু,ভেড়া ও ঘোড়ার খামার দেখা গেলো। বাসায় এসে জিরোবার আগেই তানিয়া তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে পাশের বাড়ির আঙিনার দিকে ছুটে গেল। পরে জানতে পারি এখানে কয়েকটা বিড়ালের পরিত্যক্ত কিছু ছানা পাওয়া গেছে। এগুলোর ভবিষ্যত নিয়ে তারা রীতিমতো উদ্বিগ্ন। তাই সেগুলো উদ্ধার করে ক্যাট রেসকিউ সেন্টারে দিয়ে আসলে অন্তত সেগুলো বেঁচে যাবে। আহা! অসহায় পশুর জন্য এত দরদ ভালোবাসা যদি আমাদের সবার থাকতো! অসহায় প্রাণীগুলোর প্রতি এদের সহমর্মিতা দেখে রীতিমতো অভিভূত হয়ে পড়ি।
রেইন ফরেস্ট এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে অক্ষুন্ন রেখে প্রাকৃতিক ভাবে বানানো ফুট ওভার ব্রিজ দিয়ে হাঁটতে গেলে আলো আঁধারীতে দাঁড়ানো উঁচু উঁচু হরেক রকমের গাছ গাছালীর দিকে তাকালেই ভয়ে শির দাঁড়া খাড়া হয়ে যায়। সে এক ভৌতিক পরিবেশ। চারিদিকে সুন সান নিরবতা। পাখিদের কিচির মিচির শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই। অবশেষে গা ছমছম করা পরিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে আমাদের গাড়ির খোঁজে হাঁটতে থাকি। অবশেষে আমরা খামার দেখা কেল। আসার পথে কফি খাওয়ার জন্য তানিয়া গুগলে সার্চ করে মেগডোনাল্ড এর ঠিকানা খুঁজছিলো। কিন্তু আমার নাতি নাতনিরা গো ধরে বসে, তারা ঐ দোকান থেকে কিছু কিনবেনা। কারণ ম্যাগডোনাল্ড এর খাবার বিক্রির টাকা দিয়ে ইসরায়েলকে মিসাইল কিনতে সাহায্য করা হচ্ছে যা ব্যবহার হবে মুক্তিকামী নিরীহ ফিলিস্তানীদের হত্যার কাজে। কি আশ্চর্য চিন্তা ধারা! আমরাতো কখনো এসব নিয়ে ভাবতে ও পারিনি। অবশেষে সেভেন ইলেভেন এর দোকান থেকে কফি খেয়ে ফিরে আসি।
আমার মেয়ে তানিয়ার বাসাটা ক্র্যানবোর্ন নর্থ এ অবস্থিত। এখান থেকে আমরা কাঁচা বাজার সদাই করার জন্য একদিন ২৫ মিনিট এর দূরত্বে ডেনডেনং উপশহরের একটি মার্কেটে গেলাম। অত্যন্ত সাজানো গোছানো বাজারটিতে ঢুকে দেখি এলাহী কান্ড। লোকে গিজ গিজ করছে বাজারের ভিতরে। শাক- সব্জি থেকে শুরু করে প্রতিটি তাক ফল-ফলাদিতে ভরপুর। প্রতিটি দ্রব্যের রেক এ দাম লেখা আছে। কাজেই মূলা-মূলির প্রশ্নই আসেনা। কিছুক্ষণ পর পর জিনিস পত্রের দাম পরে যাচ্ছে দেখে অবাক হলাম। পাঁচ মিনিট আগে যে টমেটো তিন ডলার কেজিতে ছিলো সেটা এখন দোকানী দুই ডলারে নামিয়ে এনেছে। অন্যান্য কাঁচামালের দামেও পরিবর্তন করা হচ্ছে। অতপর ক্রেতাদের হুড়োহুড়ি। কার আগে কে কিনবে এই নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে। আমি দূরে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম আমরা কোন্ অরাজক দেশে বাস করি। যেখানে প্রতিনিয়ত বিক্রেতারা বিভিন্ন প্রতারণা, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দিয়ে ক্রেতাদের ঠকিয়ে চলেছে। এদিকে জামাই শহিদুল্লাহ এক কার্টন কিউই ফল নিয়ে হাজির। দাম শুনে আমি অবাক। মাত্র পাঁচ ডলার। প্রয়োজনীয় সদাই শেষে আমরা ফিরে আসি ডেরাতে। আসার পথে তানিয়ার মুখে শুনি এ সমস্ত অঞ্চলের পুরো এলাকাতে আফগানীদের বাস। এমনকি ওদের বাসার আশেপাশে সবই আফগানী পরিবারের আবাসন।
ইতোমধ্যে একদিন পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে মেলবোর্ন সিটিতে গেলাম। উদ্দেশ্য সন্ধ্যায় রোড সাইড রেস্টুরেন্টে বসে ইফতারী সেরে নেওয়া এবং রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করা। এখানকার বিখ্যাত ক্রাউন গ্রুপের মালিকানায় রয়েছে পাশাপাশি আট দশটা দালান। তার সব কটাই হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং কেসিনোতে ভর্তি। তারই একটা খাবার দোকানের বারান্দায় বসে খাবার সেরে নিই। রাতের মেলবোর্ন এর ঝলমলে আলোতে আকাশ চুম্বি ভবন গুলো ঝিলমিল করছে। ইয়ারা রিভার নামে খ্যাত ছোট নদীটি শহরের সৌন্দর্য অনেক খানি বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশী বিদেশি পর্যটকদের নিয়ে নদীর বুকে ছুটে চলেছে বিভিন্ন আকারের নৌযান। এদিকে রাত ঘনিয়ে আসতেই নারীপুরুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে। ইতোমধ্যে আমরা খাওয়া-দাওয়া শেষে ফিরে যেতে মনস্থ করি। জিপিএস এর নির্দেশনা মেনে জামাই শহিদুল্লাহ শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে অবশেষে ফ্রীওয়েতে এসে হাজার হাজার গাড়ির মিছিলে ঢুকে পড়ে। এখানে এক শত কিলোমিটারের নিচে গাড়ির গতি নামলে জরিমানা গুনতে হবে সেই নির্দেশনা কিছুক্ষণ পর পর দেখানো হচ্ছে। আরেকটা সতর্কতা মূলক বোর্ড নজরে পড়লো যেখানে স্পষ্ট লেখা রয়েছে ‘পুলিশ ক্যান ক্যাচ ইউ এনি টাইম,এনি হয়ার’। আবার জিপিএস মনিটরিং থেকে মোবাইলে মহিলার সতর্ক বার্তা আসলো ৩৫০ মিটার দূরত্বে পুলিশের গাড়ি আছে। কি আশ্চর্য! ঠিক ঐ দূরত্বে গাড়ি পৌঁছতেই দেখি রাস্তার পাশে লাল বাতির সংকেত দিয়ে পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। চলবে –
লেখক : প্রাবন্ধিক