কেন্দ্রে ভোটার আনতে কৌশলী বিএনপি

58

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য ঘরে ঘরে প্রচারণার কৌশল নিয়েছে বিএনপি। ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারলে নিজেদের প্রার্থী মেয়র নির্বাচিত হবেন, এমনটাই মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
রাজনীতিবিদদের মতে, গত কয়েক বছর ধরে ভোটের যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, তাতে জনগণ ভোটবিমুখ হচ্ছেন। নির্বাচনের পরিবেশ, প্রচার-প্রচারণা সব ঠিক থাকলেও ভয়ভীতিসহ নানা অভিযোগ উঠছে ভোটকেন্দ্র নিয়ে। যার কারণে কেবল বিরোধী দলের ভোটাররাই নন, সরকারি দলের ভোটাররাও ভোট দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছেন না। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, ভোটার খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর হয়ে যাবে এক সময়। যদিও নতুন প্রযুক্তি ইভিএমে আগে ভোট নেওয়া বা জালিয়াতি রোধ হবে, তবুও এতে ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগ) মাহবুবের রহমান শামীম বলেন, ভোটাররা কেন্দ্রে যেন আসেন সেজন্য আমরা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের প্রার্থী ও নেতাকর্মীরা ঘরে ঘরে গিয়ে ভোটারদের উৎসাহিত করছেন। ভোটাদের মধ্যে ভোট দেওয়া নিয়ে আস্থার সংকট আছে। এই সংকট দূর করবে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করবে। ভোটাররা কেন্দ্রে আসলে অবশ্যই বিএনপির প্রার্থী জয়ী হবেন।
টানা প্রায় ১৪ বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। রাজনীতির মাঠেও অনেকটাই কোণঠাসা বারবার ক্ষমতায় থাকা দলটি। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহতের ডাক দিয়ে ব্যর্থ হওয়া এবং এর পরের বছর ২০১৫ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক দফা দাবির আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ার পর রাজনীতির মাঠে ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে বিএনপি। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হওয়াটা (ব্যতিক্রম সিলেট) যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে দলটির কাছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিটি নির্বাচন। সা¤প্রতিক সময়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জয় পায় দলটি। এছাড়া সব নির্বাচনেই হেরেছে বিএনপি। হারার পর সরকারি দলের কারচুপি, হামলা-মামলা, কর্মীদের দাঁড়াতে না দেওয়া, কেন্দ্রে এজেন্ট দিতে বাধা দেওয়া, ভোটারদের আসতে না দেওয়াসহ নানা অভিযোগ তোলে দিলটি। কিন্তু এখন আলোচনায় আসছে শুধু সরকারি দলের কারণেই কী নির্বাচনে হারছে বিএনপি, নাকি নিজেদের সাংগঠনিক ব্যর্থতাও রয়েছে। চসিক নির্বাচনে আসলে কি ভোটারদের নির্বাচনে ফিরাতে পারবে বিএনপি?
নগর বিএনপির সিনিয়র সহ সভাপতি ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহŸায়ক আবু সুফিয়ান বলেন, আমরা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসার জন্য উৎসাহিত করছি। ভোটারদের মধ্যে যতক্ষণ পর্যন্ত ভীতি থাকবে ততক্ষণ তারা আসতে চাইবে না। নির্বাচন কমিশনকে ভোটার আনতে পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের লিফলেট বিতরণ হাসির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোটারদের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে আস্থা আনতে হবে। নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে ভোটাররা ভোট দিতে চলে আসবে।
সাধারণত জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেশি থাকে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন কাউন্সিলর প্রার্থীরা। এবার চসিক নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভূমিকা ও ভোটারের উপস্থিতি সামনের নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে।
নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর বলেন, আমরা প্রচারণা চালাচ্ছি কিন্তু সরকার বা নির্বাচন কমিশনের এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। আশাব্যাঞ্জক কিছু দেখছি না। বাস্তবমুখি কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। বক্তব্যে এসমস্ত বিষয় নিয়ে কথা বলছে, কেন্দ্রমুখি হতে বলছে, প্রচারণা বা প্রদক্ষপ নেই।
আবুল হাসেম বক্কর বলে, আমাদের মনে হচ্ছে কমিশন ইচ্ছাকৃতভাবে চারদিনের একনাগাড়ে ছুটির মধ্যে নির্বাচনের তারিখ দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেই। জনগণ ভোট দিতে আসতে চাচ্ছে, প্রশাসন নিরাপত্তা দিলে অবশ্যই সবাই নির্বাচনমুখি হবে।
বিএনপির নেতারা মনে করছেন, বিএনপিকে সরকার, পুলিশ, প্রশাসন এবং সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এতগুলো শক্তির সঙ্গে লড়াই করা দিন দিন দলটির জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। এতোকিছুর পরও ভোটাররা তাদের সঙ্গে আছেন। ভোটাররা বিএনপির উপর আস্থা রাখছেন। কিন্তু দল হিসেবে বিএনপির সাংগঠনিক ব্যর্থতা, ভোটারদের উজ্জীবিত করতে না পারা নির্বাচনে হেরে যাওয়ার মূলে কাজ করছে। প্রত্যেকটা নির্বাচনে সাংগঠনিক কী ধরনের দুর্বলতা ছিল, কোথায় কোথায় ব্যর্থতা রয়েছে, সেসব সংশোধনের কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সব মিলিয়ে বিএনপি মাঠে দাঁড়াতে পারেনি। আর এই সুযোগ নিচ্ছে সরকারি দল।
নগর বিএনপির সহ সভাপতি নিয়াজ মোহাম্মদ খান বলেন, আমরা ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসার আহŸান জানিয়ে ঘরে ঘরে ক্যাম্পেইন চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের প্রার্থী ও তৃণমূলের নেতারা ডোর টু ডোর ক্যাম্পেইন করছেন। সবাইকে আমরা বলছি, নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে আসার জন্য। আমরা ভোটারদের উৎসাহিত করে যাচ্ছি। এখন নির্বাচন কমিশনের ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ ভোট দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। নির্বাচন কমিশন পরিবেশ নিশ্চিত করলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ ভোট দিতে আসবে।
বিএনপির নগর বিএনপির মহিলা বিষয়ক সহ সম্পাদক ডা. লুসি খান বলেন, মানুষ ভোট দিতে চাচ্ছে। তবে সবার মধ্যেই ভীতি আছে। এরমধ্যেও সবাই ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে। অনেকে বলছে, ভোট দিতে গিয়ে তাদের আবার ফেরত আসতে হয়। নির্বাচন কমিশন চাইলে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারে। কমিশন ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত না করে যদি জেগে জেগে ঘুমায় তাহলে তো কিছু করার নেই।
বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির নিজস্ব একটি ভোটব্যাংক থাকলেও সেটাকে কাজে লাগাতে পারছে না দলটি। এমনকি সরকারি দলও নিজেদের ভোটব্যাংক কাজে লাগাতে পারছে না। তার মানে এই নয় যে, তাদের ভোট কমে গেছে। সমস্যা হচ্ছে, ভোটাররা এখন কম সংখ্যায় ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছেন। বিএনপির ভোটারা ভোটকেন্দ্রে সংখ্যায় কমে যাওয়ার পেছনে সরকারদলীয়দের ভয়ভীতি যেমন আছে, তেমনি দল হিসেবে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতাও দায়ী। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে, তাদের সাহস জোগাতে বিএনপিকে কাজ করতে হবে। সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে কর্মীদের পাশে আরও নিবিড়ভাবে থাকতে হবে।