কৃষকদের জীবন মানের উন্নয়নই পারে দেশের কৃষিখাতকে এগিয়ে নিতে

4

রতন কুমার তুরী

যে কৃষকরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এদেশে তাদের মূল্যায়ন ছিলনা কোনো কালেই। এখনও নেই। কোনো দিনও কোনো অনুষ্ঠানাদিতে কৃষকদের প্রধান অতিথি করে চেয়ার এগিয়ে দেয়া হয়না। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্য জনক যে, যে দেশের অর্থনীতি টিকে আছে কৃষকদের নিয়ে তাদের মূল্যায়ন করা হয়না।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। জন্মলগ্ন থেকে কৃষিই দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কৃষিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিল্পকারখানার কাঁচামালের চাহিদা পূরণ করে আসছে এই কৃষি খাত। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান অন্যান্য খাত, বিশেষত সেবা ও শিল্পখাতের তুলনায় পিছিয়ে পড়লেও কৃষির গুরুত্ব কোনো অংশেও কমেনি। গ্রামে বসবাসকারীদের ৯০ শতাংশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৯ অনুযায়ী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সেক্টরগুলোর মধ্যে কৃষি খাতে ৪০.৬ শতাংশ সবচেয়ে বেশি লোকের কর্মসংস্থান হয়। অন্যদিকে সেবা খাতে ৩৯ শতাংশ ও শিল্প খাতে ২০.৪ শতাংশ লোকের কর্মসংস্থান হয়। জিডিপিতে এই দুই খাতের চেয়ে কৃষি খাতের অবদান কম হলেও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কৃষি খাতই সবার ওপরে। দেশের বিপুলসংখ্যক লোকের খাদ্যের জোগান দেওয়া এবং বিপুলসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান করা কৃষি খাতই সবচেয়ে অবহেলার শিকার। আজকের বাংলাদেশ যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তা সম্ভব হয়েছে কৃষকের দিনরাত পরিশ্রমের ফলেই। আগে রাষ্ট্রকে খাদ্যচাহিদা মেটাতে বিপুল পরিমাণ খাদ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। কৃষি খাতে এই সাফল্যের পেছনে বর্তমান সরকারের অনেক কৃষিবান্ধব নীতি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু কেমন আছেন আমাদের কৃষকেরা? তাদের জীবনমানের উন্নয়ন কতটুকু হয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর যতটা সহজে দেওয়া যাবে বাস্তবতা তার চেয়ে অনেক কঠিন। রাষ্ট্রের আয়ের বিশাল একটা অংশ আসে ঐ দরিদ্র কৃষকের ঘামের টাকায়। কিন্তু কৃষকেরাই এই দেশে সবচেয়ে অবহেলার শিকার। গত ধানের মৌসুমে ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক একটা প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। পরে সরকারের পক্ষ থেকে ধান ক্রয়ের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু এই সুবিধা পুরোপুরি কৃষকদের কাছে কতটুকু পৌঁছেছে?
শুধু ধান কেন, কোনো ফসলেরই ন্যায্যমূল্য কৃষকরা পাচ্ছে না। আমাদের দেশের বেশির ভাগ কৃষকই নিম্নবিত্ত। কৃষিই তাদের আয়ের একমাত্র উৎস। যখন একটা ফসল তারা জমি থেকে তোলে, তখন বেশির ভাগ কৃষকই সেগুলো বিক্রি করে ফেলে। কারণ পরবর্তী সময়ে যে ফসলটা জমিতে চাষাবাদ করবে, তার জন্য যে অর্থ প্রয়োজন সেটির উত্স হচ্ছে আগের ফসল বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থ। ফলাফল যা দাঁড়ায় সেটি হচ্ছে, ভরা মৌসুমে কোনো ফসলেরই তেমন দাম থাকে না। কিন্তু কৃষককে এটি বিক্রি করতেই হয়। বড়ো বড়ো ব্যবসায়ী এগুলো কিনে মজুত করে রাখে। পরবর্তী সময়ে দাম বাড়লে তারা বিক্রি করে; না হয় নিজেরাই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলাফল যা দাঁড়ায় সেটি হচ্ছে, একদিকে কৃষক ন্যায্যমূল্য পায় না অন্যদিকে ভোক্তাদেরও বেশি দামে পণ্যটি ক্রয় করতে হয়।
কয়েকবছর আগে পেঁয়াজ-সংকট দেশের আলোচিত একটি বিষয় ছিল। ভারত হঠাত্ পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলে, সঙ্গে সঙ্গে পেঁয়াজের দাম বেড়ে ১৪০ ২০০ টাকাতে দাঁড়ায়। সরকার বিকল্প হিসাবে মিশর, মিয়ানমার চীন, তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা শুরু করে। কিন্তু কৃষকের কান্না উপেক্ষিতই থেকে গেল। দেশে যে পরিমাণ পেঁয়াজের চাহিদা তার চেয়ে উৎপাদনের পরিমাণ কম এটা সত্য। কিন্তু তার চেয়ে বড়ো সত্য এদেশের কৃষকরা পেঁয়াজের মৌসুমে এক মণ পেঁয়াজ ৬০০-৭০০ টাকা বিক্রি করেছে, যা উৎপাদন খরচের চেয়েও কম। যেখানে জীবন, জীবিকার জন্য একজন কৃষক জমি আবাদ করে সেখানে তাকে উলটো লোকসান গুণতে হচ্ছে। শুধু পেঁয়াজ আর ধান কেন, দেশের উল্লেখযোগ্য অর্থকড়ি ফসল পাট। সেই পাটের মূল্যও চরম হতাশাজনক। কেউ খোঁজ রাখল না! পাটের মৌসুমে এক মণ পাট বিক্রি হয়েছে ১৫০০/১৬০০ টাকা। যেখানে এক মণ পাট উত্পাদনে খরচ ২ হাজার টাকার কাছাকাছি। কয়েক বছর আগে খুলনায় পাটকল শ্রমিকদের বেশ কয়েকবার বেতনের দাবিতে ধর্মঘটই প্রমাণ করে কেমন নড়বড়েভাবে যাচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রীয় পাটকলগুলো। অথচ ভারত আমাদের পাট আমদানি করে সেগুলো পুনরায় রপ্তানি করে বেশ লাভবান হচ্ছে।
এই অবস্থা দুইভাবে দূর করা যেতে পারে। প্রথমত, কৃষকদের জন্য পর্যাপ্ত ঋণ সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে, যেন তারা মৌসুমে কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য না হয়। দ্বিতীয়ত, সরকারের পক্ষ থেকে ফসলের মৌসুমে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল ক্রয় করতে হবে। কৃষকের ভাগ্যের উন্নয়নে প্রয়োজনে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর ক্ষতিপূরণের কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। সর্বোপরি কৃষকের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ যেন কৃষকই পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ কৃষক বাঁঁচলেই বাচবে দেশ। আমরা কৃষকদের কাছ থেকে ফসল চাইছি। চাইছি অধিক ফলন কিন্ত তাদের জীবন মানের প্রতি আমরা কখনই নজর দিচ্ছিনা। ভাবছিনা অধিক পরিশ্রমে এদেরও অসুখ বিসুখ হতে পারে।
এদেরও পরিবার পরিজন আছে, আছে হাসি কান্নার জীবন। একজন কৃষকের রোগ হলে তার ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা খুব একটা কঠিন কাজ নয় কিন্তু এটা আমরা কখনও চিন্তাও করিনা। সময় এসেছে দেশের কৃষকদের যথাযথ মূল্যায়ন ও তাদের জীবন মান উন্নয়নের প্রতি বছর দেয়ার।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক