ইয়াসির আবরার
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) বর্তমান বিশ্বের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির অন্যতম প্রধান প্রতীক। এই প্রযুক্তি মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা করেছে। শ্রমবাজারও এর ব্যতিক্রম নয়। আধুনিক শিল্প ও সেবাখাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে, যা চাকরির ধরন, সুযোগ এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। প্রযুক্তির এই প্রভাব নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে নানামুখী আলোচনা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে চাকরির বাজারে। এর ফলে অনেক প্রচলিত পেশা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষত, যেখানে বারবার একই ধরনের কাজ করতে হয়, সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের কাজের জায়গা দখল করছে। উৎপাদনশিল্প, গুদাম ব্যবস্থাপনা এবং ডেটা এন্ট্রির মতো ক্ষেত্রে অটোমেশনের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এসব কাজে কর্মীর প্রয়োজন কমে আসছে। একইসঙ্গে ব্যাংকিং, কাস্টমার সাপোর্ট এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো খাতে চ্যাটবট এবং ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টের ব্যবহার প্রচলিত চাকরিগুলোর গুরুত্ব কমিয়ে দিচ্ছে।
তবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুধু চাকরি সংকুচিত করছে না; এটি নতুন সম্ভাবনারও দ্বার খুলছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় দক্ষ পেশাজীবীদের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ডেটা সায়েন্স, মেশিন লার্নিং এবং সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো পেশাগুলোয় এখন বড় ধরনের কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। এগুলো এমন পেশা, যেখানে মানুষের সৃজনশীলতা এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। উন্নত বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ব্যবহার দ্রæতগতিতে প্রসারিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবা, উৎপাদন এবং রিটেইল খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। চীনও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে দেখছে। ২০৩০ সালের মধ্যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তিতে বিশ্বে শীর্ষস্থান অর্জনের লক্ষ্যে চীন ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। এসব দেশ দক্ষ শ্রমিক তৈরি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণা ও উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ব্যবহার এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। কৃষি খাতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর সীমিত ব্যবহার দেখা গেলেও ফসলের ফলন নির্ধারণ এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার মতো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবায় কিছু ক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-চালিত অ্যাপ এবং চ্যাটবট রোগ নির্ণয় ও পরামর্শে সহায়তা করছে। ব্যাংকিং খাতেও ডিজিটাল সেবার প্রসারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এসব প্রয়াস এখনো শহরকেন্দ্রিক এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর উন্নয়ন ও ব্যবহারে উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে রয়েছে বড় ধরনের বৈষম্য। উন্নত দেশগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহার করছে, যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলো এখনো এর উপযোগিতা অনুধাবন ও গ্রহণের প্রাথমিক ধাপে রয়েছে। এই বৈষম্য শ্রমবাজারেও স্পষ্ট। উন্নত দেশগুলোতে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের সুযোগ বেশি থাকায় তাদের শ্রমশক্তি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-নির্ভর পেশায় দ্রুত মানিয়ে নিতে পারছে। অন্যদিকে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দক্ষ জনবল তৈরির অভাব এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা চাকরির বাজারে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) আরেকটি বড় প্রভাব পড়েছে মানুষের সৃজনশীলতার ওপর। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যেখানে নানান কাজকে প্রতিস্থাপন করছে, সেখানে সৃজনশীল কাজের চাহিদা বেড়ে গেছে। ডিজাইন, গবেষণা, এবং উদ্ভাবনমূলক কাজে মানুষের ভূমিকা এখনো অপরিহার্য। শিল্প, সাহিত্য এবং গবেষণায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের সহায়ক হলেও এই কাজগুলোতে মানুষের সৃজনশীল চিন্তার বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর আরেকটি প্রভাব হলো চাকরির বাজারে অসমতা সৃষ্টি করা। যেসব পেশায় উচ্চ প্রযুক্তিগত দক্ষতা প্রয়োজন, সেসব ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ বাড়লেও সাধারণ এবং কম দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিকদের জন্য এটি হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং অটোমেশনের কারণে প্রায় ৮৫ মিলিয়ন চাকরি হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে একইসঙ্গে নতুন ধরনের ৯৭ মিলিয়ন চাকরি সৃষ্টি হতে পারে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি গ্রহণে যেসব দেশ পিছিয়ে রয়েছে, তারা কর্মসংস্থানের সংকট এবং শ্রমবাজারের বৈষম্যের মুখোমুখি হতে পারে। এ অবস্থায় প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
উপসংহারে বলা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) প্রযুক্তির কারণে চাকরির বাজারে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। এটি যেমন প্রচলিত চাকরির ধরণ এবং চাহিদাকে পাল্টে দিচ্ছে, তেমনি সৃজনশীল এবং প্রযুক্তিনির্ভর নতুন কর্মসংস্থানের পথ খুলছে। কিন্তু এই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন সঠিক প্রস্তুতি এবং দক্ষতার উন্নয়ন। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি একটি সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ উভয়ই। যদি সঠিকভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো যায়, তবে এটি শ্রমবাজারে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে।
লেখক : সহ-প্রতিষ্ঠাতা, ড্রিমানটিয়াস