কুরআন-হাদিস ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মাহে রমজান

1

মাওলানা এম সোলাইমান কাসেমী

রোজা ফার্সি শব্দ। অর্থ উপবাস। রোজার আরবি শব্দ হচ্ছে ‘সাওম’। আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায়-আল্লাহ্ তায়ালার নির্দেশ পালনার্থে সুব্হি সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকাই হচ্ছে ‘সাওম’। এ রমজানে সিয়াম পালনের তাগিদ দিয়ে আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- ‘রমজান মাস, যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের হিদায়াতের জন্য এবং হিদায়াতের সুসপষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে এই মাস পায় সে যেনো রোজা পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান এবং কঠিন করতে চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ করো এবং তিনি তোমাদের যে হিদায়ত দিয়েছেন, তার জন্যে আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৫) যে ব্যক্তি রমজান মাসে রোজা পালন করবে, আল্লাহ্ তায়ালা তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’-(সহিহ আল-বুখারি, হাদিস নং- ১৯০১)।
অভিজ্ঞ গবেষক ও চিকিৎসকগণ দেখতে পেয়েছেন, সর্বক্ষণ অনিয়মিত আহার, সীমাতিরিক্ত ভোজন ও দূষিত খাদ্য খাওয়ায় শরীরের কোষে কোষে এক প্রকার বিষাক্ত উপকরণ ও উপাদানের সৃষ্টি হয় এবং তা জৈব বিষ হিসাবে জমা হয়। বার বার প্রতিদিন এমনটা ঘটার কারণে দেহের নির্বাহী ও কর্মসম্পাদন অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলো বিষাক্ত উপকরণ ও জৈব বিষ দমনে অক্ষম হয়ে পড়ে। ফলে তখন শরীরে জটিল ও কঠিন রোগের জন্ম হয়। দেহের মধ্যকার এমন বিষাক্ত ও দূষিত উপাদানগুলো অতিদ্রæত নির্মূলকরণের নিমিত্তে পাকস্থলিকে মাঝে মধ্যে বিশ্রামে রাখা একান্ত প্রয়োজন। রোজা হলো একমাত্র সহায়ক। যার বিকল্প কল্পনা করা যায় না। ১৯৬০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. গোলাম মোয়াজ্জেম কর্তৃক ‘মানব শরীরের উপর রোজার প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণামূলক নিবন্ধ অনুযায়ী জানা যায়, রোজায় শরীরের ওজন সামান্য হ্রাস পায় বটে, তবে তা শরীরের কোন ক্ষতি করে না বরং শরীরের মেদ কমাতে রোজা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অপেক্ষা অধিক কার্যকর। তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার আলোকে আরও জানা যায়, যারা মনে করেন রোজা রাখলে শূল-বেদনার প্রলোপ বৃদ্ধি পায়, তাদের এ ধারণা সঠিক নয় বরং ভোজনে তা বৃদ্ধিপায়। প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ হোসেনের নিবন্ধ থেকে জানা যায়, যারা নিয়মিত সিয়াম পালন করে সাধারণত তারা বাতরোগে, বহুমূত্র, অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যধিতে আক্রান্ত কম হয়। ডা. ক্লাইভ-সহ অন্যান্য চিকিৎসা বিজ্ঞানী পর্যন্ত স্বীকার করেছেন, ইসলামের সিয়াম সাধনার বিধান স্বাস্থ্যসম্মত এবং ফলপ্রসূ, আর তাই মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার রোগ- ব্যাধি তুলনামূলকভাবে অন্য এলাকার চেয়ে কম দেখা যায়।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম কম খাওয়ার জন্য বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। ক্ষুধা লাগলে খেতে বলেছেন এবং ক্ষুধা না লাগলে খাওয়া বন্ধ করার জন্য উপদেশ দিয়েছেন যা চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্মত। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে দীর্ঘজীবন লাভ করার জন্য খুব বেশি খাওয়ার প্রয়োজন নেই। এখন আধুনিক বিজ্ঞান ও কিছু অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মতামত উল্লেখ্য করা হলো।
জার্মানির ডাক্তার ফেডারিক হভম্যান (জন্ম ১৬৬০ মৃত্যু ১৭২৪) বলেছেন, ‘রোজার মাধ্যমে মৃগীরোগ, গ্যাস্ট্রিক ও আলসারের চিকিৎসা করা যায়।’ ইটালির বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী মাইকেল এংলো ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। ৯০ বছর বয়স পার হওয়া সত্ত্বেও তিনি কর্মক্ষম ও কর্মঠ ছিলেন। তাকে এর রহস্য সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমি বহু দিন আগ থেকেই মাঝে মাঝে রোজা রেখে আসছি। আমি প্রত্যেক বছর এক মাস, প্রত্যেক মাসে এক সপ্তাহ রোজা রাখি এবং দিনে তিন বেলার পরিবর্তে দুই বেলা খাবার খাই। ক্যাব্রিজের ডাক্তার লেখার জিম। তিনি ছিলেন, ফার্মাকোলজি বিশেষজ্ঞ। সব কিছু গভীরভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে তার স্বভাব। তিনি রোজাদার ব্যক্তির খালি পেটের খাদ্য নালীর লালা, স্টোমাক সিক্রেশন সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরী পরীক্ষা করেন। এতে তিনি বুঝতে পারলেন, রোজার মাধ্যমে ফুডপার্টিকেলস বিহীন পাকস্থলি দেহের সুস্থতার বাহন। বিশেষত পাকস্থলীর রোগের আরোগ্য গ্যারান্টি।
সিগমন্ডনারায়েড মনস্তত্ত¡ বিজ্ঞানী এর মন্তব্য। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট মনস্তত্ত¡ বিশারদ। তার আবিস্কৃত থিওরী মনস্তত্ত¡ ক্ষেত্র পথ নির্দেশকের ভূমিকা পালন করে। তিনিও রোজা এবং উপবাসের একনিষ্ট সমর্থক ছিলেন। তিনি বলেন, রোজার মাধ্যমে মস্তিস্কের এবং মনের যাবতীয় রোগ ভালো হয়। মানুষ শারিরিক ভাবে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকুল পরিস্থিতির মুখো- মুখি হয়। কিন্তু রোজাদার ব্যক্তির দেহ ক্রমাগত চাপ সহ্য করার যোগ্যতা অর্জন করে। রোজাদার ব্যক্তি খিচুনি এবং মানসিক রোগ থেকে মুক্তি লাভ করে। এমনকি কঠিন রোগ থেকে মুক্তি লাভ করে এবং এ রোগের সম্মুখিন হওয়া থেকে বিরত থাকে। আলেকজান্ডার গ্রেট এবং এরিস্টল। উল্লিখিত দু’জনই ছিলেন নামকরা ব্যক্তিত্ব। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা বিশ্বখ্যাত। তারা মাঝে মাঝে ক্ষুধার্ত বা উপবাস থাকাকে দেহের সুস্থতা ও সবলতার জন্য খুবই উপকারী বলে মনে করেন। আলেকজান্ডার গ্রেট বলেন, আমার জীবনে অনেক ব্যতিক্রমধর্মী অভিজ্ঞতা এবং ঘটনা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, সকাল সন্ধা যে আহার করে সে রোগ মুক্ত। আমি ভারতে এরকম প্রচন্ড উষ্ণ এলাকা দেখেছি। যেখানে সবুজ গাছ পালা পুড়ে গেছে। কিন্তু সেই তীব্র গরমের মধ্যেও আমি সকালে এবং বিকালে খেয়েছি। সারাদিন কোনো প্রকার পানাহার করিনি। এর ফলে আমি অনুভব করেছি এক নতুন অফুরন্ত প্রাণ শক্তি। (আলেক জান্ডার গ্রেট, মাহফুজুর রহমান আখতারী)।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র প্রফেসর’স মোরপান্ড বলেছেন, আমি ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি জানার চেষ্টা করেছি। রোজার অধ্যায় অধ্যায়নের সময় আমি খুবই মুগ্ধ ও অভিভূত হয়েছি। চিন্তা করেছি ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য এক মহা ফর্মুলা দিয়েছে। ইসলাম যদি তার অনুসারীদের কোনো বিধান না দিয়ে শুধু রোজা দিত তবুও এর চেয়ে বড় নেয়ামত আর কিছু হত না। বিষয়টি নিয়ে আমি একটু গভীর চিন্তায় মনোনিবেশ করলাম। তাই বাস্তব অভিজ্ঞতার জন্য আমি মুসলমানদের সাথে রোজা রাখতে শুরু করলাম। দীর্ঘ দিন যাবৎ আমি পাকস্থলি রোগে ভূগছিলাম এবং কিছুদিন পর আমি সুস্থ্যতা বোধ করলাম। দেখলাম রোগ অনেকটাই কমে গেছে। আমি রোজা চালিয়ে গেলাম এতে দেহ আরো উন্নতি পরিবর্তন উপভোগ করলাম। কিছুদিন পর লক্ষ্য করলাম আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছি। এক মাস পর আমি নিজের মাঝে এক অসাধারণ পরিবর্তন অনুভব করলাম। রমজান মাসে নাক, কান, গলার অসুখ কম হয়। জার্মানি, ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎকদের একটি টিম এ সম্পর্কে গবেষণা করার জন্য এক রমজান মাসে পাকিস্তান আসে। তারা গবেষণা কর্মের জন্য পাকিস্তানের করাচী লাহোর এবং ফয়সালাবাদ শহরকে মনোনীত করেছেন সার্ভে করার পর তারা যে রির্পোট দিলেন তার মূল কথা ছিলো নিম্নরূপ। মুসলমানরা নামাজের জন্য যে অজু করে সেই অজুর কারণে নাক, কান গলার অসুখ কম হয়। খাদ্য কম খাওয়ার কারণে পাকস্থলী এবং লিভারের অসুখ কম হয়। রোজার কারণে তারা মস্তিষ্ক এবং হৃদরোগের আক্রান্ত কম হয়। পরিশেষে বলা যায় যে, রমজানের রোজার প্রায় সকল বিধি-নিষেধই স্বাস্থ্যবিধি সম্মত। আল্লাহপাক আমাদেরকে প্রকৃত রোজাদার হওয়ার এবং উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করতে পারার তৌফিক দান করুন।

লেখক: ইসলামী গবেষক ও প্রাবন্ধিক