কুতুব মিনার

3

হারুন-উজ-জামান

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণে একটি জায়গার নাম মেহরাওলি। এই মেহরাওলিতেই রয়েছে জগৎ বিখ্যাত একটি মিনার। নাম কুতুব মিনার। মিনার শব্দটির অবশ্য রয়েছে বিভিনড়ব অর্থ। এর মধ্যে একটি অর্থ হলো চ‚ড়াযুক্ত উঁচু স্তম্ভ। কুতুব মিনার বিশ্বের সর্বোচ্চ ইটের ক্সতরি চূড়াযুক্ত স্তম্ভ। এর উচ্চতা ২৩৮ ফুট। নীচের দিকে মিনারটির বেড় ৪৭ ফুট এবং এর উপরের অংশে বেড় ৯ ফুট। মিনারটি দূর থেকে দেখতে ইটের ভাটার চিমনির মতো। লাল বেলে পাথরের ইট দিয়ে ক্সতরি এ মিনার। মিনারটির গায়ে পবিত্র কোরআনের বিভিনড়ব বাণী নান্দনিক ডিজাইনে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
কে বা কারা কেনো নির্মাণ করেছেন এই মিনার, আর কেনোই বা এর নাম হলো কুতুব মিনার, এর পেছনে রয়েছে অনেক ইতিহাস। আর এ বিষয়ে নজর দিলে প্রথমেই আসে যার নাম তিনি হলেন ভারতের প্রথম মুসলমান শাসক এবং দিল্লি সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা কুতুব উদ্দিন আইবেক। তারই নির্দেশে ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয় কুতুব মিনারের নির্মাণ কাজ। কারো কারো ধারণা তার নামেই বুঝি মিনারটির নাম হয়েছে কুতুব মিনার। আসলে তা কিন্তু মোটেও নয়। কুতুব উদ্দিন আইবেক এ মিনার নির্মাণের উদ্যোক্তা হলেও সুফি সাধক খাজা মঈনুদ্দীন চিস্তির শিষ্য ও খলিফা সুফি কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী’র নামানুসারে এই মিনারটির নাম দেন কুতুব মিনার।
কুতুব মিনারের রূপকার কুতুব উদ্দিন আইবেক ছিলেন একজন তুর্কি। ১১৫০ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কিস্তানে তার জন্ম। জানা যায়, জন্ম থেকেই তার বাম হাতের একটা আঙ্গুল ছিলো কাটা। কারো কারো মতে তার বাম হাতের একটা আঙ্গুল ছিল ভাঙ্গা। আর চেহারা সুরতের দিক দিয়েও ছিলেন খুবই অসুন্দর ও কদাকর। তখন ছিলো ক্রীতদাসের যুগ। গরু ছাগলের মতো মানুষও বেচাকেনা হতো। মানুষ মানুষকে কিনে নিয়ে চিরদিনের মতো দাস হিসেবে ব্যবহার করত। কুতুব উদ্দিনকে দিয়ে কোন কাজ করানো যাবে না। সে হবে সংসারের বোঝা, এই কথা ভেবে তার অন্য ভাইরা, ইরানের খোরাসনের নিসাপুরের প্রধান কাজী ফকরুদ্দিন এর কাছে নামমাত্র মূল্যে কৃতদাস হিসেবে একদিন বিক্রি করে দেয় তাকে। ক্রীতদাস হলেও কুতুব উদ্দিনকে সন্তানের মতো ¯েড়বহ করতেন কাজী সাহেব। তার সন্তানদের সাথে তাকেও আরবী ফারসি ভাষা শেখার ব্যবস্থা করান। কুতুব উদ্দিনের অসাধারণ প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হন কাজী সাহেব। তাকে তীর ও ঘোড়া চালানো শিক্ষারও ব্যবস্থা করেন। অল্প দিনেই তরুণ কুতুব উদ্দিন তীর ও ঘোড়া চালানো রপ্ত করে ফেলে এবং যুদ্ধ বিদ্যায় হয়ে উঠে দক্ষ। হঠাৎ একদিন কাজী ফকরুদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন।
যুদ্ধ বিদ্যা ও রণকৌশলে পারদর্শী কুতুব উদ্দিন প্রতিদ্বন্ধী হয়ে উঠতে পারে এমন আশংকা কাজী ফকরুদ্দিন এর ছেলেরা তাকে গজনীর গভর্নর জেনারেল ময়েজ উদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরির কাছে তাদের দাস কুতুব উদ্দিনকে পানির দামে বিক্রি করে দেয়।
এ রকম একজন সুদক্ষ গোলামকে এতো অল্প টাকা পয়সা দিয়ে কেনা যাবে ভাবতেও পারেন নি ঘুরি। কয়েক দিনের মধ্যেই মোহাম্মদ ঘুরি দাস কুতুব উদ্দিনের মধ্যে আরো অনেক গুণের সন্ধান পান। আরবি ফার্সি ভাষায় দক্ষ শিক্ষিত এবং ঘোড়া চালনায় নৈপুণ্যের অধিকারী মেধাবী কুতুব উদ্দিনকে দাস থেকে মৌখিকভাবে মুক্তি দিয়ে তাকে আমীরে আকুয়া (রাজকীয় অশ্বশালার প্রধান) হিসেবে নিয়োগ দেন।
১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত ত্বরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি হিসেবে কুতুব উদ্দিন আইবেক মোহাম্মদ ঘুরির পক্ষে যুদ্ধ করে বিজয়ী হন। ইতোমধ্যে আরো কয়েকটি রাজ্য জয় করে ফেলেন। তারপর তার বিশ্বস্ত অনুচর হিসেবে কুতুব উদ্দিন আইবেকের জয় করা অঞ্চল সমূহের শাসনভার এবং ভারত অভিযানের দায়িত্ব দিয়ে স্বদেশে (গজনী) প্রত্যাবর্তন করেন মোহাম্মদ ঘুরি।
দিল্লি বিজয়ের পর ১১৯২ থেকে ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোহাম্মদ ঘুরির প্রতিনিধি হিসেবে কুতুব উদ্দিন আইবেক দিল্লি শাসন করেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি হিন্দু রাজ্য হানসি, সামানা, আজমীর, মিরাট, দিল্লি, কনৌজ, গুজরাট, বাদায়ুন, কালিঞ্জর ইত্যাদি রাজ্য জয় করেন। দিল্লি জয়ের পর লাহোর থেকে রাজধানী এক সময় নিয়ে আসেন দিল্লিতে। দিল্লির প্রথম স্বাধীন মুসলিম শাসক কুতুব উদ্দিন আইবেক।
১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে মোহাম্মদ ঘুরি গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হলে কুতুব উদ্দিন আইবেককে দিল্লির সিংহাসনে বসানো হয়। অবশ্য সিংহাসনে বসার পূর্বে ঘোর রাজ্যের উত্তরাধিকার মোহাম্মদ ঘুরির ভাতিজা সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ কুতুব উদ্দিন আইবেককে আনুষ্ঠানিকভাবে দাস থেকে মুক্তি দেন এবং মুক্তির সনদ তার হাতে তুলে দেন। দাস মুক্ত হয়ে কুতুব উদ্দিন ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে থেকে ১২১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সুলতান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। লাহোরে পোলো খেলার সময় ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে আহত হন এবং ১২১০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন কুতুব উদ্দিন আইবেক।
কুতুব উদ্দিনের নামের শেষে আইবেক শব্দটি কেনো হলো তা নিয়ে আছে ভিনড়বমত। আইবেক একটি তুর্কি শব্দ। এর অর্থ চন্দ্র দেবতা। কারো কারো মতে চন্দ্রগ্রহণ কালে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন বলে তার মা বাবা তাকে আইবেক বলে ডাকতেন। আবার কারো মতে তুর্কিস্তানের এক উপজাতি আইবেক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে তিনি আইবেক হিসেবে পরিচিতি পান। কুতুব উদ্দিন আইবেক কেনো কুতুব মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেন এর কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায়, কুতুব উদ্দিন নিজে ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তার সর্বশেষ মনিব মোহাম্মদ ঘুরি ছিলেন মুসলমান। কুতুব উদ্দিন আইবেক একে একে অনেক রাজ্য জয়ের স্মৃতিস্বরূপ এবং ইসলামের বিজয় গাঁথা বিশ্ব দরবারে উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে মোহাম্মদ ঘুরির পরামর্শে ১১৯৯ খ্রিষ্টাব্দে শুরু করেন মিনারটির নির্মাণ কাজ।
কুতুব উদ্দিন আইবেকের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় মিনারটির প্রথম ও দ্বিতীয় তলা। তৃতীয় এবং চতুর্থ তলা নির্মিত হয় তার জামাতা সুলতান শামসুুদ্দিন ইলতুতমিস (সুলতানা রাজিয়ার পিতা) এর তত্ত্বাবধানে। আর পঞ্চম তলার নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয় সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের হাতে। কুওয়াত উল মসজিদ সংলগড়ব এই মিনার থেকে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পূর্বে আজান দিতেন মোয়াজ্জিন। অনেক দূর থেকে শোনা যেতো শ্রুতি মধুর এ আজান। আফগানিস্তানের জাম মিনার এর অনুকরণে নির্মাণ করা হয় মিনারটি। মিনারটির প্রতি তলায় রয়েছে ঝুলন্ত বারান্দা, কিন্তু ভিতর থেকে বারান্দায় যাওয়ায় কোন ব্যবস্থা রাখা হয় নাই। মিনারের দরজা দিয়ে ঢুকে ৩৭৯টি সিঁড়ি ধাপ পেরিয়ে উঠতে হয় মিনারের চূঁড়ায়, অবশ্য বর্তমানে বন্ধ রয়েছে মিনারের দরজা, তাই এখন আর কেউ উঠতে পারে না মিনারের চূঁড়ায়। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা ডিসেম্বর মিনারে ঘটে এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। তখন মিনারের দরজা দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে উঠা যেতো মিনারের চূঁড়ায়। কোন এক এক্সিবেশনে অংশ নিতে স্কুলের অনেক ছেলেমেয়ে কুতুব কমপ্লেক্স আসে সেদিন। মিনারের দরজা দিয়ে ছেলেমেয়েরা মিনারের চূঁড়ায় উঠতে যাওয়ার সময় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। মিনারের ভেতরটায় সূর্যের আলো না থাকায় ঘন অন্ধকারে ভয়ে ছেলেমেয়েরা চিৎকার করে দ্রুত নামার সময় ৪৭ জন ছাত্র-ছাত্রী মারা যায়। আর আহত হয় প্রায় দুই শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বেও বিভিনড়ব সময়ে
শতাধিক লোক মিনারের চূঁড়া থেকে লাফ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু মিনারের গেইট বন্ধ করা হয়নি। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর মর্মান্তিক দূর্ঘটনার পর থেকে বন্ধ করে দেয়া হয় মিনারের খোলা দরজা। সেই থেকে সংস্কার বা মেরামত ব্যতীত কুতুব মিনারের চূঁড়ায় উঠার পথ হয়ে যায় রুদ্ধ।
কুতুব মিনারকে কেন্দ্র করে শুরুতেই গড়ে উঠে একটি কমপ্লেক্স। এই কমপ্লেক্সকে বলা হয় কুতুব কমপ্লেক্স। ১০০ একর জমির উপর স্থাপিত এ কমপ্লেক্সে রয়েছে কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ (এ মসজিদটি বর্তমানে নেই, তবে মসজিদটির স্থান এবং কিছু চিহ্ন আজও রয়েছে), আলাই মিনার, আলাই গেট, সুলতান ইলতুতমিস, সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবন, সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী এবং ইমাম জামিনের সমাধি ও তেইশ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ছয় টনের বেশি ওজনের চকচকে একটা লোহার পিলার। ২৭টি প্রাচীন হিন্দু ও ক্সজন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে সংগ্রহ করা উপাদান দিয়ে ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে কুওয়াত উল ইসলাম মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করেন কুতুব উদ্দিন আইবেক।
বেশ কয়েকবার ভূমিকম্পের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কুতুব মিনার ও কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদটি। কুতুব মিনার অনেকবার সংস্কার করা হলেও মসজিদটি আর সংস্কার করা হয় নি কখনো। ফলে মসজিদটির আঙিনা, করিডোর ও অন্যান্য অনেক চিহ্ন থাকলেও নেই মসজিদ ভবনটি ।
মুসলিম শাসনের গৌরবোজ্জ্বল অতীত জানান দিয়ে যাচ্ছে এই কুতুব মিনার। এ মিনারকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে। দিল্লি আসলে আগ্রার তাজমহল দেখতে যায় যতো লোক, তার চেয়েও বেশি লোক দেখতে আসে কুতুব মিনার।