আকতার কামাল চৌধুরী
ইসরায়েলে এক চোখ ধাঁধানো আক্রমণে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের জানান দিয়েছিল হামাস গত বছরের ৭ অক্টোবর সোমবার। সেই সাঁড়াশি আক্রমণ হামাসকে রাতারাতি বৈশ্বিক আলোচনার টপিকস-এ পরিণত করে।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহব্বল ইসরায়েল সেদিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ছাপিয়ে ‘ইসরায়েলের গোয়েন্দা ব্যর্থতা, একইসাথে তাদের অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অকার্যকারিতাই দুনিয়ার সর্বত্র আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।
এই ঘটনায় মুসলিম বিশ্বে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। হামাস যোদ্ধাদের অন্তহীন মনোবল, নিখুঁত রণকৌশল, গোপনীয়তা রক্ষার পারঙ্গমতা বিশ্বে আলোচনার জন্ম দেয়।
৭ অক্টোবর, সেই ঘটনার এক বছর। এই এক বছরের ইতিহাস, গাজায় রক্তগঙ্গা বয়ে যাওয়ার ইতিহাস। একইসাথে ৪১ হাজারেরও অধিক ফিলিস্তিনির নির্মম মৃত্যুর সাথে এক লাখেরও অধিক পঙ্গু হওয়ার ইতিহাস।
এই এক বছরে ইসরায়েলের একতরফা আক্রমণে গাজার সুউচ্চ অট্টালিকা থেকে অফিস-আদালত, কল-কারখানা, বাড়িঘর মাটির সাথে মিশে যায়। জীবন বাঁচাতে মরিয়া গাজাবাসী সহায়-সম্বল ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটতে থাকে। যারা আজ অনেকটা খোলা আকাশের নিচে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। মৃত্যু প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাদের।
ইসরায়েলের হত্যাকাÐ থেকে কেউ কি বাদ পড়েছে? না, কেউ বাদ পড়েনি। নারী, শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ, সাংবাদিক, জাতিসংঘের ত্রাণকর্মী থেকে সবাই-ই আছে নিহতের তালিকায়।
একইভাবে যদি প্রশ্ন করা হয় ইসরায়েল কোথায় কোথায় বোমা ফেলেনি! এর উত্তরেও বলতে হয়, বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদ্রাসা, শিশু হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, জাতিসংঘের আশ্রয়শিবিরেও। এমনকি হাসপাতালের আঙ্গিনায় পলায়নপর ফিলিস্তিনিদের জীবন্ত মাটি চাপাও দেওয়া হয়। বহু পরিবার আছে এই এই যুদ্ধে যাদের আর কেউ-ই বেঁচে নেই।
প্রথমদিকে হামাস কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল বটে। তা-ও তাদের দেশপ্রেম আর অদম্য মনোবলের কারণে। কিন্তু ইসরায়েলের সর্বাত্মক আক্রমণের মুখে তারা আর দাঁড়াতেও পারেনি। ইসরায়েলের সর্বাধুনিক অস্ত্রের মোকাবেলায় হামাসের গতানুগতিক অস্ত্রগুলো কোনো কার্যকারিতাই দেখাতে পারেনি।
প্রতিরোধ মানে-সুরঙ্গ থেকে কিছু রকেট ছোঁড়া পর্যন্তই। পরে তা-ও অকার্যকর করে ফেলে ইসরায়েল। এভাবে যুদ্ধ হয়ে পড়ে একতরফা, একপেশে, ক্রমান্বয়ে তা একক নেতৃত্বে, ইসরায়েলের-ই হাতে।
এক বছরের এই যুদ্ধে লাভ-ক্ষতির হিসাব মিলাতে গেলে হামাসের প্রাপ্তির খাতায় কিছুই নেই। বরং ক্ষতির হিসাব লিখতে গেলে খাতায় তুলোবে না। ১১৩৯ জন ইসরাইলীর প্রাণের বিনিময়ে ৪১ হাজারের অধিক ফিলিস্তিনিকে প্রাণ দিতে হয়েছে।
পুরো গাজা শহর এখন মৃত্যুপুরী। চারদিকে শুধু ধ্বংসলীলা। মাটির সাথে মিশে আছে অংসখ্য দালান। আন্দাজ করা হয়, সেই দালানের নিচে মরে পঁচে আছে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি হতভাগ্য ফিলিস্তিনির দেহ। বোমার আঘাত এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, ধসে পড়া দালান থেকে তাদের উদ্ধার করাও সম্ভব হয়নি।
হামাসের শক্তি এখন নিঃশেষ। তারা হতাশ, হতোদ্যম। তাদের গোপন সব রণকৌশল এখন ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হাতের মুঠোয়। হাজার হাজার সৈন্য, ডজন ডজন শীর্ষ কমান্ডারের মৃত্যুতে দিশেহারা হামাস এখন হতাশার সাগরে ডুবে আছে। তারা ভূমি হারা, সম্পদ হারা।
এই যুদ্ধে হামাসের প্রাণপুরুষ ইসমাইল হানিয়াকে স্ত্রী, সন্তান, নাতি-নাতনিসহ জীবন দিতে হয়। ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করা হয় ইরানের রাজধানীর একটি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনের কক্ষে। বলতে গেলে এই হত্যাকাÐ ফিলিস্তিনে ইসমাইল হানিয়া যুগের অবসান ঘটায়।
এই যুদ্ধের কারণে ইসরায়েলের সাথে ইরানের তিক্ততা চরমে পৌঁছে। এটি শুধু তিক্ততার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, লেবাননের রাজধানী বৈরুতে মিসাইল হামলা চালিয়ে ইসরায়েল ইরানের শীর্ষ কমান্ডার কাসেম সোলাইমানীসহ আট শীর্ষ কমান্ডারকে হত্যা করে।
এই যুদ্ধের একক সফল্য ইসরায়েলকে আরও বেপরোয়া, আরও দুর্বিনীত করে তোলে। এমনকি এর রেশ ধরেই ইসরায়েল লেবাননে প্রাণঘাতী হামলা চালায়। এ হামলায় হিজবুল্লাহ প্রধান নসরুল্লাহ নিহত হন। এটা ইসরায়েলের এ-যাবৎকালের সবচেয়ে বড়ো সফল্য দাবি করা হয়।
নাসারুল্লাহ হত্যা ইরানের জন্য এক চপেটাঘাত বটে। সম্মান বাঁচাতে ইরানও তেল আবিবে ১৮০টি ব্যালেষ্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে।
উজ্জীবিত ইসরায়েল এখন ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহকে নির্মূলে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। ইতোমধ্যে আকাশে-স্থলে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছে। পাশাপাশি ইরানের তেলক্ষেত্র ও পারমাণবিক স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পরিকল্পনাও সাজাচ্ছে।
এতোসব অভাবনীয় ঘটনার জন্ম কিন্তু সেই হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের রেশ ধরেই। সবমিলিয়ে এই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যকে এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিনত করেছে।
হামাস এখন পথহারা, উদভ্রান্ত এক পথিক, বলতে গেলে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা তাদের। চরম কোনঠাসা হামাস জীবন, সম্পদ, ভূখন্ড বাঁচাতে মরিয়া। যুদ্ধবিরতির জন্য ইসরায়েলকে দেওয়া আগের কঠিন শর্ত থেকেও সরে আসে। কিন্তু কিছুতেই দমতে রাজি নয় ইসরায়েল।
এক্ষণে হামাস না পারছে সামনে, না পারছে পেছনে সরতে। তাদের এখন ‘বজ্র আঁটুনি ফোস্কা গ্যারো’ অবস্থা। এ-অবস্থায় পর্যুদস্ত হামাসের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দয়ার উপর নির্ভরশীলই বলতে হবে।
যুদ্ধে অতিরিক্ত প্রাণহানি দেখলে অভিভাবক হয়ে যুক্তরাষ্ট্রই ইসরায়েলকে কিছুটা শাসন করে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করতে নিজেদের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ইসরায়েলকে সাপ্লাই দেয়।
আবার মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির মূলমন্ত্র দ্বি-রাষ্ট্রতত্ব নিয়ে নিজেদের মতামতের প্রচারও করে, যা হামাসকে প্রলুব্ধ করে। অর্থাৎ হামাস এখন নিরুপায়।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর মুসলিম জাতি বিশ্বজয়ের যে আনন্দ উপভোগ করেছিল, বছর না ঘুরতেই তা বুমেরাং হয়ে যায়। আনন্দ দূরে থাক, ফিলিস্তিনিদের জীবন বাঁচালোই এখন দায় হয়ে পড়েছে।
২০০১ সালের নাইন ইলেভেনে টুইন টাওয়ারে হামলার মতো অপরিণামদর্শী ও হুজুগী সিদ্ধান্তের খেসারত মুসলিম জাতিকে এখনও দিতে হচ্ছে।
একইভাবে ‘৭ অক্টোবরও হাজার হাজার ফিলিস্তিনির জীবন, সম্পদ, বাসস্থান কেড়ে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, মধ্যপ্রাচ্যকে অগ্নিকুÐ বানিয়ে ইসরায়েলকে আরও সর্বগ্রাসী, আরও পরাক্রমশালী হওয়ার পথ তৈরি করে দিয়েছে।
এই ‘৭ অক্টোবর’ ফিলিস্তিনিদের আজীবন-লালিত স্বাধীনতার সোনালী স্বপ্নকেও এক অন্ধকার সুরঙ্গে ফেলে দিয়েছে। অথচ, এই স্বাধীনতা তাদের ন্যায্য অধিকার। ইতিহাসে এটাই হয়তো ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যের নির্মম লিখন।
লেখক : প্রাবন্ধিক