কিশোরদের সুস্থ মানসিক বিকাশে মানবিকবোধের শিক্ষা

1

রতন কুমার তুরী

শিশুকাল পেরিয়ে একজন শিশু যখন কৈশোরে পা দেয় তখন তার দেহগত এবং মনোজাগতিকগত ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তখন সে নিজেকে অনেকটা স্বাধীন মনে করে। পিতা-মাতার শাসন কিংবা সামাজিক অনুশাসনগুলো তখন তার তেমন একটা ভালো লাগেনা। ঠিক এ বয়সেই কিশোরদের জন্য পিতা-মাতা কিংবা অভিভাবকদের কিছু করণীয় থাকে। এ সময় যেহেতু সন্তানরা বন্ধনহীন জীবন কাটাতে চায় সেহেতু এ বয়সটিতেই সঠিক পথের দিশা না পেলে সে যে কোনো সময় পথভ্রষ্ট হতে পারে। কিশোরদের এ বয়সটিতে যাতে তাদের সুস্থ মানসিক বিকাশ ঘটে সে বিষয়ে অভিভাবক কিংবা সমাজকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পাড়ায় যদি একটি খেলার মাঠ একটি লাইব্রেরি কিংবা কিশোরদের সুন্দর মানস গঠনে একটি ক্লাব থাকে তাহলে তারা সবাই একসাথে জড়ো হয়ে সামাজিক কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারবে। খেলার মাঠে নিয়মিত খেলা, লাইব্রেরিতে নিয়মিত বিভিন্ন বইপত্র পড়ে সময় কাটাতে পারা একজন কিশোরের জন্য খুবই উপকারী। এতে তার মানসিক গঠন সুস্থ হয় এবং চিন্তা চেতনায়ও সে অনেক বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে দূর অতীতে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ছিল একান্নবর্তী পরিবার ভিত্তিক ফলে, কিশোররা যৌথ পরিবারে বড় হয়েছে অনেকটা আদরে আবার অনেকটা শাসনে। বিশাল যৌথ পরিবারে বাবা,কাকা,জেঠা, জেঠি, নানু, দাদুদের সাথে থাকতে হতো কিশোরদের। পরিবারের সব কাজ করতো বড়রা। ছোটরা সারাদিন খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো আর সন্ধ্যা হলে বই নিয়ে টেবিলে বসতো। এটা তাদের এক ধরনের রুটিন ছিল। তবে ছোটখাটো কিছু কাজ তাদের করতে হতো। যেমন, ডাকবাক্সে একটি চিঠি পোস্ট করে দিয়ে আসা। বাজার থেকে এক দিস্তা খাতা নিয়ে আসা, পাশের বাড়িতে এক বাটি মিষ্টি দিয়ে আসা ইত্যাদি। তখন কম্পিউটার ছিলনা, ছিলনা মোবাইল। কিশোরদের সময় কাটাতে হয়েছে মাঠে, কিংবা বাড়িতে বইয়ের টেবিলে ফলে তাদের মানসিক গঠন মানবিকতাকে ছুঁয়ে গেছে।
বর্তমানে কিশোরদের খেলাধূলা, বইপড়া এবং সুশিক্ষায় মনোযোগী হওয়ার চাইতে মোবাইলে আসক্তি বেশি। এরা রাতদিন মোবাইল নিয়ে দিন কাটায় ফলে এদের মধ্যে মানবিকবোধ কমে গেছে। মোবাইলে সারাক্ষণ ডুবে থাকার ফলে কিশোরদের এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আজ বিপথে চলে গেছে। দেশে কিশোর গ্যাং সৃষ্টি হয়েছে। মাদকে আসক্ত হয়েছে হাজার হাজার কিশোর।এদের ফেরাতে হবে সুপথে এবং এদের জন্য সুন্দর একটা সমাজ বিনির্মাণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কিশোরদের জন্য খেলাধুলা সুস্থ মানবিক চর্চার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তার সাথে সাথে এটি কিশোরদের শারীরিক গঠনে সহায়তা করে। খেলাধূলায় মেতে থাকলে কিশোররা পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। মুলতঃ আমাদেরকে কিশোরদের আলোর পথে আনতে হলে সমাজের প্রত্যেককে দায় নিতে হবে। কিশোরদের বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই তাদের মধ্যে মানবিকতার বিষয়গুলো ভালো করে মাথায় ঢুকাতে হবে। খারাপ সঙ্গ ত্যাগ, মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্ত না হওয়া, মানুষের সাথে খারাপ আচরণ না করা, সবাইকে সম্মানের চোখে দেখা, জীবন চলার পথে সৎ থাকা ইত্যাদি বিষয়গুলো যদি তাদের মাথায় একবার ঢুকানো যায় তাহলে তারা আর কখনও পথভ্রষ্ট হবেনা। বর্তমান আধুনিক যুগে প্রায় সবাই মোবাইল ছাড়া অচল। এ ক্ষেত্রে কিশোরদের একটি বিরাট অংশ বলা চলে মোবাইল আসক্ত। এসব কিশোরদের মোবাইল আসক্ত থেকে অচিরেই ফেরাতে হবে এবং এদের বোঝাতে হবে যে, মোবাইল দুনিয়া থেকে আরো মজার এবং শিক্ষণীয় দুনিয়া আছে তাদের জন্য। তাহলো মজার মজার বই পড়া, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, প্রকৃতির সাথে মিতালি করা, পাখির রাজ্যে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি। এসব বিষয়ে তাদের আকৃষ্ট করতে পারলেই তারা আর অন্য দুনিয়ায় পা বাড়াবেনা। প্রকৃতপক্ষে কিশোররা স্বভাবতই এডভেঞ্চার প্রিয় হয়। এদের মাঝে মধ্যে বিপজ্জনক নয় এমন সাহসী কাজে উৎসাহ দিতে হবে। মুলতঃ কিশোর বয়সেই একজন ছেলে বা মেয়েকে জীবন সম্পর্কে ভালো ধারনা দিতে পারলে তাদের জীবন সুন্দরভাবে গড়ে ওঠে। মুলতঃ কিশোরদের জীবনাচরণে নৈতিকতা বিষয়টি তাদের পিতা-মাতারাই ঠিক করে দিতে পারে আর এটি একবার ঠিক করে দিতে পারলে কিশোররা চারিত্রিকভাবে খুবই শক্তিশালী হয়। সে কখনও অন্যায়ের পথে পা বাড়ায়না। বর্তমানে আমাদের সমাজে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়া কিশোরদের বিরাট অংশ ছোট পরিবারে মানুষ হচ্ছে সেখানে অনেক সময় এরা পিতা-মাতাকে সবসময় পায়না। একা বাসায় থাকতে থাকতে অনেক কিশোর একসময় মানসিক রোগীতে পরিণত হয়ে যায়। একান্নবর্তী পরিবারে থাকলে যা কখনও হতোনা। পিতা-মাতা চাকুরীজীবী হলে কিশোর সন্তানদের নিয়ে ভয় অনেক বেশি কারণ শহরের চার দেয়ালের বাসায় তাদের মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকেনা যার ফলশ্রুতিতে কিশোর সন্তানটির দিনদিন বায়না বাড়তে থাকে এবং একসময় সে উৎশৃংঙ্খল আচরণ করে।
তাই পিতা-মাতাদের উচিত তার কিশোর বয়সী সন্তানটির খোঁজখবর রাখা এবং তাকে মাঝেমধ্যে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওয়া। কিশোর দের মানসিক বিকাশের ওপর নজর দিতে পারলে একটি সমাজ সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে যেতে পারবে। কারণ আগামী দিনের সমাজ এবং রাষ্ট্র পরিচালনা করবে এ কিশোররাই সুতরাং কিশোরদের সুস্থ এবং যথাউপযুক্তভাগে গড়ে তোলা আমাদের এবং সমাজের দায় রয়েছে। তাই আসুন কিশোরদের সুস্থ এবং জনকল্যাণ মুলক পথে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলি এবং আমরা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করি।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক