কিডনীর পাথর নিরাময়ে হোমিওপ্যাথি

1

ডা. প্রধীর রঞ্জন নাথ

কিডনী পাথর রোগ নিরাময়ে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের প্রয়োগ সংকেত নিয়ে আজকের আলোচনা। বিবিধ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিডনীতে পাথর অবস্থা বিরাজ করে। কিডনীতে কেন পাথর হয় সঠিক চিত্র পাওয়া না গেলেও স্বাভাবিকভাবে যেসব কারণগুলো ধরা হয় তার মধ্যে পুষ্টিকর খাদ্য ও একটি মস্ত ব্যাপার। কম মাত্রায় পানি খেলে মূত্রের পরিমাণও কমে যায়। কিডনীর পাথর একটি জটিল রোগ। দিনে দিনে রোগ বাড়তে থাকে। পাথর একসময় অস্ত্রোপচার করে বের করতে হয়। আবার অতি ক্ষুদ্র পাথরটা মূত্রের সাহায্যে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। ৩০ এর ওপরে বয়স্ক লোকের মধ্যেই এটা বেশি দেখা যায়। এটা একরকম দীর্ঘস্থায়ী রোগ। অবহেলায় কিডনী নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
এই রোগের কারণ :
* শরীরে ভিটামিন ‘এ’ এর স্বল্পতা।
* আবহাওয়া ও পেশাগত কারণ।
* বেশিক্ষণ মূত্র থলিতে মূত্র জমা থাকা।
* দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ ও ইনফেকশন।
* মূত্রে বিভিন্ন মাত্রায় লবণের আধিক্য।
* প্যারাথাইরয়েড হরমোনের প্রভাব।
* ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার বেশি গ্রহণ।
* রক্তের ইউরিক এসিডের মাত্রা বেশি হলে (গাউট রোগে)।
* পানি বেশি পরিমানে না খেলে।
বিভিন্ন প্রকার পাথরের বিবরণ :
* ক্যালসিয়াম অক্সালেট।
* ক্যালসিয়াম ফসফেট।
* ইউরিক এসিড
* সিসটিন
* ম্যাগনেশিয়াম এমোনিয়াম ফসফেট।
কিডনীতে পাথর কিভাবে সংগঠিত হয় : প্রস্রাবে দ্রবীভূত ফসফেট, অক্সালেট, ইউরিক এসিড, ক্যালসিয়াম, ইউরেট, প্রভৃতি পদার্থ থেকে গিয়ে মূত্রের সাথে কিডনীতে দীর্ঘসময় অবস্থান করে। এভাবে দীর্ঘসময় অবস্থানের পর পাথরের আকার ধারণ করে এবং দিনে দিনে আরও বড় হতে থাকে।
এই রোগের লক্ষণ : কিডনী এলাকায় তীব্র ব্যথা (পিঠের দিকে) অনুভূত হয়। বেশী জোড়ে হাটা-চলা বা ঝাঁকিতে ব্যথা বাড়ে। পাথর আপনা হতেই নিচের দিকে অর্থাৎ বের হবার চেষ্টা করে তখন ব্যথা তীব্রতর হয় এবং কুচকী, পেটে ও লিঙ্গে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে। রোগী ঘামতে থাকে এবং বমি করে। ঘনঘন অল্পমাত্রায় তীব্র জ্বালাকর প্রস্রাব হয় এবং মূত্র বন্ধও হতে পারে। প্রচন্ড শীত অনুভব এবং জ্বর আসে। রোগীর মুখে ফ্যাকাশেভাব এবং অস্থিরতায় ভোগে, মূত্রের সাথে কখনও কখনও রক্ত ও আসতে পারে। কিডনীর স্থানে টিপলে পিঠ ও তলপেটের মাংসপেশি শক্ত মনে হয়। ব্যথার তীব্রতা থেমে গেলেও রোগী ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
পরীক্ষা নিরীক্ষা : এক্স-রে পরীক্ষায় অনেক সময় ধরা না পড়লেও কিডনীর ইউ, এস, জি (আল্ট্রাসনোগ্রাফি) করলে পাথরের অবস্থান ধরা পড়ে।
পথ্য ও স্বাস্থ্য শিক্ষা : প্রচুর পানি খাবার অভ্যাস করা উচিত। স্বাভাবিক সব খাবার খাওয়া ভালো। প্রতিদিন উষ্ণ পানি বদনার নলে করে একটু উপুড় থেকে গোটা পিঠে ঢাললে খুবই আরাম পাওয়া যায়। রেনাল কলিক জনিত বেদনার সময় রোগীর কোমরে ও পেটে সেঁকতাপ প্রয়োগ করা যেতে পারে। মূত্রের সহিত ইউরিক অ্যাসিড ক্রিষ্টাল বাহির হলে আমিষ জাতীয় খাদ্যাদি, যথা- মাছ, মাংস ও ডিম বর্জন করা উচিত। অকজ্যালেট ক্রিষ্টাল নির্গত হলে বেশি শাক সবজী খাওয়া অনুচিত। পথ্য সম্বন্ধে এইরূপ ব্যবস্থা দ্বারা ভবিষ্যতে পাথুরী হবার সম্ভাবনা অনেকটা কমান যায়। অতিরিক্ত মিষ্টান্নাদি ভোজন এবং মদ্যপান ত্যাগ করা কর্তব্য। যাতে প্রচুর পরিমাণে প্রস্রাব হতে পারে তজ্জন্য প্রচুর জল, বার্লির সরবত ইত্যাদি পান করা উচিত। কচি ডাবের জল পাথুরী রোগের পক্ষে হিতকর। প্রস্রাবে অক্জ্যালেট ক্রিষ্টালযুক্ত রোগীর পক্ষে মাটির নীচে জন্মে এরূপ দ্রব্যাদি যথা- আলু, মুলা, আদা, পেঁয়াজ, রশুন ইত্যাদি বর্জনীয়।
হোমিওপ্যাথিক প্রতিবিধান : কিডনীর পাথর সারাতে হোমিওপ্যাথিতে অত্যন্ত ফলদায়ক ওষুধ আছে। যা অন্য প্যাথিতে নেই। নির্দিষ্ট মাত্রায় লক্ষণ সাদৃশ্যে নিম্নলিখিত ওষুধ ব্যবহারে এই রোগ সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করে।
(১) প্রদাহ বা পাথুরীজনিত কিডনী শুল। কিডনী প্রদেশের প্রচন্ড বেদনা ইউরেটার বাহিয়ে মূত্রস্থলীতে বিস্তৃত হয়। শ্বাস গ্রহণেও বৃদ্ধি। হঠাৎ মূত্রবেগ এবং মূত্র ত্যাগকালে জ্বালা ও মূত্রনালীর মধ্যে স্ফীতিবোধ। মূত্রের বর্ণ ঘোর এবং রক্ত বা কিডনীর এপিথেলিয়াম এবং ইউরিক অ্যাসিড যুক্ত। রোগীর মুখমন্ডল শুস্ক ও ঘোর বর্ণে আর্জেন্টাম নাইট্রিকাম ভাল ফলদায়ক।
(২) তীব্র বেদনা মূত্রস্থলীর মধ্য দিয়ে পাদদেশ পর্যন্ত প্রধাবিত হলে বার্ব্বেরিস নির্দ্দিষ্ট।
(৩) কটিদেশে চাপবোধ। ঝাঁকনি লাগলে কিডনী ও কটিদেশে বেদনাবোধ। মূত্রস্থলীর মধ্যে পাথুরী। মূত্রস্থলী মধ্যে কুন্থনবেগ ও পুনঃ পুনঃ মূত্রবেগও নালীমধ্যে জ্বালাবোধে ক্যালকেরিয়া কার্ব ভালো কাজ দেয়। ক্যালকেরিয়া পাথুরী পীড়ার একটা প্রতিষেধক ওষুধ।
(৪) ক্যান্থারিস- মূত্র পাথুরী শুল নিবারণের পক্ষে ইহা শ্রেষ্ঠ ওষুধগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইহা স্থানীয় উত্তেজনা হ্রাস করে বিনা ক্লেশে পাথুরী নির্গমনে সহায়তা করে।
(৫) বিন্দু বিন্দু মূত্রত্যাগ। মূত্রে শ্লেষ্মা ও লিথেটস্ এর আধিক্য। উভয় কিডনীতে ও মূত্রস্থলীতে অতীব্র, গভীর বেদনা ও জ্বালা যন্ত্রনাতে ইউপেটেরিয়াম পার্পিউরিয়াম ফলদায়ক।
(৬) মূত্র ত্যাগের পূর্বে কটিদেশে তীব্র বেদনা এবং তা মূত্র ত্যাগের পর উপশম। মূত্র ঘোলা, দুগ্ধবৎ এবং দুর্গন্ধময় তলানি যুক্ত। মুত্রমধ্যে পাথুরী নির্গমন ও প্রদাহে লাইকোপোডিয়াম ভাল কাজ দেয়।
(৭) মূত্র পাথুরী জনিত তীব্রশুল। মূত্রনালী মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা এবং পাথুরী নির্গমনবৎ অনুভূতি ও যন্ত্রণার সময়ে বরফ পানের ইচ্ছা ও লিঙ্গমূলে আড়াআড়িভাবে কর্তনবৎ তীব্র বেদনায় মেডোরিনাম ব্যবহৃত হয়।
(৮) মূত্রে যদি অক্সালিক অ্যাসিড বর্তমান থাকে এবং উহাই যদি পাথুরীর প্রধান উপাদান হয় তবে মুত্র পাথুরীতে নাইট্রিক এসিড ব্যবহার্য্য। এছাড়া ক্যালকেরিয়া রিনালিস, এপিজিয়া রেপেন্স, এরিজেরন, না´ভমিকা, সার্সাপ্যারিলা, প্যারেরা ব্রেভা, সলিডেগো, ট্যাবাকাম, ডায়োস্কোরিয়া, ইকুইসেটাম, বেলেডোনা, বেজ্ঞোয়িক এসিড উল্লেখযোগ্য। তারপরেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থেকে ওষুধ সেবন করা উচিত।

লেখক : হোমিও চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক