কাসেম আলী রানার একটা চিত্তাকর্ষক উপন্যাস ‘কাজল পাখি’

2

এমরান চৌধুরী

‘কাজল পাখি’ কাসেম আলী রানার একটি কিশোর উপন্যাস। কোনো সাদামাটা উপন্যাস নয়। জমজমাট কাহিনি, রুদ্রশ্বাসে পড়ার আগ্রহ জাগানিয়া একটি উপন্যাস। নামটি সহজ সরল, মোলায়েম হলেও উপন্যাসে চিত্রিত চরিত্রগুলো মোটের ওপর সরল রেখার মতো সহজ নয়। একটি বাক্য বা অনুচ্ছেদ পাঠের পর বুকের ভেতর জেগে ওঠে পরের অনুচ্ছেদে যাওয়ার তীব্র কৌতূহল। এই কৌতূহল পাঠককে ছাড় দেবে না যতক্ষণ তার শেষাবধিনা পৌঁছা যায়।
কাসেম আলী রানার লেখালেখির সাথে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। অথচ তিনি লিখছেন অনেক দিন ধরে। এই যে তাঁর সৃজন সম্ভারের সাথে পরিচিত হতে না পারা এটা পাঠক হিসেবে আমার দীন তাই বলা যায়। বছর দুয়েক আগে তাঁর একটি কিশোর কবিতার বইয়ের পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখেছিলাম। ছড়া-কবিতা লিখিয়ে হিসেবে তিনি যতটা পরিচিত তার চেয়ে বেশি পরিচিত নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে। তাঁর এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২০। এই ২০ টি বইয়ের মধ্যে নাট্যগ্রন্থ ৪টি, ছড়াগ্রন্থ ৬টি, কিশোর কবিতা ১টি, অণুকাব্য ১টি, কাব্যগ্রন্থ ২টি, উপন্যাস ৫টি। তাঁর সৃষ্টিসম্ভার দেখে বলা যায় তাঁর বিচরণক্ষেত্র বর্ণিল ও বহুদূর বিস্তৃত।
কাজল পাখি কথা শিল্পী, নাট্যকার কাসেম আলী রানার ষষ্ঠ উপন্যাস। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে কখনো একটিকে ভৌতিক, কখনো রহস্য, কখনো কল্পবিজ্ঞান, কখনো অতি প্রাকৃত উপন্যাস বলে মনে হতে পারে। যে প্রকরণেই পড়ুক না কেন এটি নিঃসন্দেহে টানটান উত্তেজনায় ভরা একটি কিশোর রহস্য উপন্যাস। এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কিশোর রাফি। পাশাপাশি বিজ্ঞানী ড. হামদাদ খান এবং কাজল পাখি ও প্রধান চরিত্রের কম নয়। এই তিনজনকে ঘিরে কাজল পাখি উপন্যাসের কাহিনির শুরু, বিস্তৃতি ও পরিণতি । কাহিনির প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হিসেবে আরও ডজন খানেক চরিত্র এসেছে মূল চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে। যেমন ড. হামদাদ খানের সহযোগি হিসেবে এসেছে সহকারি বিজ্ঞানী হামিদ মির্জা এবং রুবানাম জুমদার। রাফির স্কুলের প্রধান শিক্ষক, ডেইজি টিচার, আলেয়া টিচার, মন্দিরা টিচার, হুজুর এবং স্বপ্না মাসি। রাফির বন্ধু হিসেবে এসেছে তাসিন এবং জয়। আগেই উল্লেখ করেছি উপন্যাসের নামটি মোলায়েম হলে ও পাখিটি কিন্তু মোলায়েম নয়। কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি, ‘এ রকম অবাক করা পাখি ড. হামদাদ খান নিজ চোখে এর আগে দেখেননি।… পাখিটি বারবার চেহারা বদলাচ্ছে। একবার ময়না, একবার টিয়া, আবার শঙ্খচিল, না হয় ঘুঘু।’ পরক্ষণে পাখিটি রূপ পরিবর্তন করে হয়ে গেল আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েল।
বোঝাই যাচ্ছে কাজল পাখি সাধারণ কোনো পাখি নয়। পাখিটির রয়েছে নানারূপ ধারণের ক্ষমতা। এই বহুরূপী কাজল পাখি ও টিফিন চুরির রহস্য উদঘাটন নিয়ে আবর্তিত হয়েছে উপন্যাসের এক একটি পর্ব। প্রতিটি পর্বেই রয়েছে ভৌতিক আবহ। ঝিম ধরে গায়ে। কখনো ভয়ার্ত ভাব আসে।
ড. হামদাদ খানের ওপর অর্পিত হয়েছে এই পাখির আসল পরিচয় উদঘাটনের দায়িত্ব। ভেটেরিনারি ইউনিভার্সিটি তাঁকে এই দায়িত্ব দিয়েছে। এই বিস্ময়কর পাখিটির ধরন জানতে ড. হামদাদ খান সারা পৃথিবীতে পাখি সম্পর্কিত যত বই আছে সব সংগ্রহ করলেন। তারপর তিনি রাফিকে নিয়ে নেমে পড়লেন পাখিটির পরিচয় উদঘাটনে। পাখিটির বয়স জানা গেল চারশ বছর ছয়মাস আটাশ দিন। পাখিটি নিয়ে ড. হামদাদ খান যখন ব্যস্ত তখন তাঁর ডাক পড়ল রাফির স্কুলের টিফিন চুরির রহস্য উদঘাটনে।
রাফিদের স্কুলে প্রতি দিন টিফিন চুরি হয়। তবে সব ক্লাসে নয়, ষষ্ঠ শ্রেণিতে। রাফি ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তাই এটা তার মাথা ব্যথার কারণ, সে সাথে আছে স্কুল ও টিচারদের সুনামের প্রশ্ন। শিক্ষার্থীরা যখন অ্যাসেম্বিলিতে যায় তখনই এই ঘটনা ঘটে। প্রথম প্রথম স্কুলের টিচাররা বিষয়টি বিশ্বাস করতে পারেনি। পরে দেখা গেল ঘটনা টিঠিক। টিফিন চুরি রোধে রাফি, তাসিন এবং জয়, এই তিন বন্ধু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। পাহারা বসানো হলো। ক্লাস পরিবর্তন করা হলো। দু’একদিন না হলেও আবার একই অবস্থা। এই নিয়ে প্রধান শিক্ষক, স্কুল কমিটি, অভিভাব করা উদ্বিগ্ন হলো। অনেকে স্কুলে আছর আছে মনে করে নিজেদের ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে টিসিনিতে শুরু করল। স্কুলের হুজুর টিফিন চোর ধরতে ষষ্ঠ শ্রেণির সকল ছাত্রকে চালপড়া খাওয়ালেন। পরদিন হুজুরের চাকরি চলে গেল।
এদিকে হেড টিচার নিজেই চাকরি ছেড়ে দিলেন। স্বপ্না মাসি স্কুলে ভূত-পেতœীর আছর আছে বলে রিজাইন লেটার দিলেন। বুক ধড়পড় করা এক একটা মুহূর্ত। ‘রাফি স্পষ্ট দেখতে পেল, আলেয়া টিচারের বড় বড় চোখের ভেতর থেকে একটা কাক বের হয়ে এলো। কাকা করে ডাকতে লাগল। আলেয়া টিচারকে দেখা যাচ্ছে না। রাফি ভয়ে কাঁপতে শুরু করল। শেষমেশ কী ঘটেছিল? চোর ধরা পড়েছিলকি? ড. হামদাদ খান কি করলেন? কাজল পাখি আসলে কি? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে উপন্যাসটি একবার অবশ্যই পড়া দরকার।
কাসেম আলী রানার গদ্য কথন চমৎকার। তাঁর রসবোধ অসাধারণ। বাক্য চয়নে তিনি পাঠককে আনন্দ সাম্পানে বেড়িয়ে আনার প্রয়াস পেয়েছেন। যেমন কাজল পাখি বলল, ‘রাফিটা খেতে মজাদার হবে। ওটা সিজার বয়। সিজার বয় খেতে খুবই স্পেশাল টেস্ট স্যার।’ কিংবা ‘ঝিনাইদহের খাঁটি ঘি দিয়ে বরবটি ভর্তা, আলু কুচি দিয়ে কাপ্তাই লেকের কাচকি মাছের চড়চড়ি, আর হলো পুঁই-বিচি, কলমি ফুল দেশি মসুর ডাল দিয়ে রান্না। সাদা সরু চালের ভাত। দারুণ একটা লাঞ্চ হয়ে যাবে। হা হা হা।’ এ রকম মজার মজার বাক্য গঠনের মধ্যে দিয়ে ঔপন্যাসিক পাঠককে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন অবিরাম।
মোমিন উদ্দিন খালেদের নান্দনিক প্রচ্ছদে চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শৈলী থেকে প্রকাশিত উপন্যাসটির দাম রাখা হয়েছে ২৫০ টাকা। আমরা এই কিশোর উপন্যাসটি কিশোর তরুণদের পাশাপাশি বড়দের কাছেও সমানভাবে সমাদৃত হবে বলে প্রত্যাশা করছি।