কাল কালুরঘাট সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন

12

নিজস্ব প্রতিবেদক

২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল। মাঝখানে কেটে গেছে ১৫ বছর। প্রকল্প গ্রহণ, বিআইডব্লিউটি এর আপত্তি, ডিজাইন পরিবর্তন, প্রকল্প ফেরত, অর্থায়ন জটিলতা, ব্যয় বৃদ্ধিসহ প্রতিবন্ধকতায় কেটেছে পুরোটা সময়। এতদিন কালুরঘাটে নতুন সেতুর স্বপ্ন দুঃস্বপ্নই ছিল। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর প্রকল্পটির মোড় ঘুরে যায়। গত বছরের ৭ অক্টোবর প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন দেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর থেকে প্রকল্প কাজ শুরু হওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়। অবশেষে আগামীকাল প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস কালুরঘাট সেতুর ভিত্তিপ্রস্তরের মধ্যদিয়ে দীর্ঘ ১৫ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. সুবক্তগীন পূর্বদেশকে বলেন, ‘দীর্ঘ সূত্রিতার পর অবশেষে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা কালুরঘাট সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর করবেন। এতে চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের যে দাবি তা পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কালুরঘাট সেতু নির্মাণ করা হবে। ২০৩০ সালের মধ্যেই সেতু নির্মাণ কাজ শেষ হবে।’
রেলভবন সূত্র জানায়, কালুরঘাট নতুন সেতুর প্রকল্পে অর্থায়ন করছে দক্ষিণ কোরিয়া। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৫৬০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এরমধ্যে সাত হাজার ১২৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিল (ইডিসিএফ) এবং ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট প্রমোশন ফ্যাসিলিটি (ইডিপিএফ) এবং অবশিষ্ট চার হাজার ৪৩৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা বাংলাদেশ সরকারের। কালুরঘাট সেতুর মূল প্রকল্পের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ৭০০ মিটার রেল কাম রোড ব্রিজ নির্মাণ, ৬ দশমিক ২০ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট নির্মাণ, ২ দমমিক ৪০ কিলোমিটার সড়ক ভায়াডাক্ট, ৪ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার বাঁধ, ১১ দশমিক ৪৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ এবং আনুষঙ্গিক কাজ। নতুন নকশা অনুযায়ী সেতুর দুই পাশে দুই লেন করে চার লেনের সেতু তৈরি করা হবে। এক পাশে চলবে ট্রেন, অন্যপাশে বাস-ট্রাককসহ সাধারণ যানবাহন।

প্রকল্পের শুরু যেভাবে : ২০১০ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সেবার জন্য ‘দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং মিয়ানমার সীমান্ত ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ’ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি জরাজীর্ণ কালুরঘাট রেল সেতুর পরিবর্তে একটি রেল ও সড়ক সেতুর নির্মাণে উদ্যোগ নেয় রেল মন্ত্রণালয়। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২০১২ সালে তাইওয়ানের রেলসেতু অবকাঠামো নির্মাণ প্রকৌশল ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ওয়াইকন কোম্পানি লিমিটেড, দেশীয় প্রতিষ্ঠান স্মেক, এইস কনসালট্যান্ট লিমিটেড এবং ইঞ্জিনিয়ার কনসোর্টিয়াম যৌথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করে।
সমীক্ষায় রেলের জন্য সিঙ্গেল লাইন ও সড়কের জন্য দুই লেনের একটি রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণের পরামর্শ আসে। সমীক্ষায় কর্ণফুলী নদীর পানি স্তর থেকে সেতুর ব্যবধান (নেভিগেশন) মাত্র ৭ দশমিক ৬২ মিটার ধরে ২০১৪ সালে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ইডিসিএফ থেকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার প্রস্তাব পাঠায় ইআরডি। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এই প্রকল্পে দুই লেনের সড়ক এবং এক লেনের রেল সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।
২০১৮ সালের কালুরঘাট সেতু নির্মাণে তোড়জোড় শুরু হলে ২০১৯ সালে বিআইডব্লিউটিএ কর্ণফুলী নদীর ওপর সেতুর উচ্চতা নিয়ে আপত্তি তুলে। পরে কালুরঘাট পয়েন্টে রেল কাম রোড সেতুর জন্য নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স ১২ দশমিক ২ মিটার করায় কোরিয়া আবার সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করে। নতুন সমীক্ষা অনুযায়ী ডুয়েলগেজ রেল সেতুতে ডাবল লাইন এবং দুই লেন সড়ক পথের সংস্থান রাখা হয়।
প্রস্তাবিত নতুন নকশা অনুযায়ী, কর্ণফুলী নদীর ওপর বিদ্যমান রেলসেতুর ৭০ মিটার উজানে নতুন সেতু নির্মিত হবে। সেতুর দুই পাশে দুই লেন করে চার লেনের সেতুর তৈরি করা হবে। এক পাশে চলবে ট্রেন, অন্যপাশে চলবে বাস-ট্রাকসহ সাধারণ যানবাহন। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৭০০ মিটার। পানি থেকে সেতুর উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটার। ভায়াডাক্টসহ সেতুর দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ছয় কিলোমিটার। সেতু নির্মাণ, ভায়াডাক্ট, অ্যামব্যাঙ্কমেন্ট, সড়ক ভায়াডাক্ট ও রেল ট্র্যাক স্থাপনের কাজগুলো ছিল প্রকল্পের আওতায়। এরপর ওই সমীক্ষা অনুযায়ী ব্যয় প্রাক্কলন করে ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট প্রকল্পটির চ‚ড়ান্ত অনুমোদনের জন্য একনেক উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী একনেক বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের নকশা দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। রেল ও সড়ক পথে চলাচলের আলাদা নকশা এবং সড়কের জন্য দুই লেনের পাশাপাশি ডাবল রেললাইন স্থাপনের নির্দেশ দিয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন না দিয়ে ফেরত দেন। এরপর ইডিসিএফ নতুন নকশার জন্য ২০২১ সালের অক্টোবরে দায়িত্ব দেয়া দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান দহওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কো-অপারেশন জেভিকে। ওই নকশায় কালুরঘাটে রেল-কাম সড়ক সেতুটি পদ্মাসেতুর আদলে দ্বিতল সেতু তৈরির নকশা করা হয়। ওই নকশা অনুযায়ী সেতুর নিচতলায় ডাবল লাইনে রেল এবং উপরের তলায় দুই লেনে গাড়ি চলার কথা ছিল। ওই নকশায় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা। পরে ২০২২ সালে আরো একটি নকশা প্রস্তুত করা হয়। নতুন নকশা অনুযায়ী সেতুর দুই পাশে দুই লেন করে চার লেনের সেতু তৈরি করা হবে। এক পাশে চলবে ট্রেন, অন্যপাশে বাস-ট্রাককসহ সাধারণ যানবাহন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর কালুরঘাট সেতু নির্মাণ প্রকল্পের মোড় ঘুরে যায়। প্রকল্পটি যাতে দ্রুত সময়ে বাস্তবায়ন হয় সে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এরই অংশ হিসেবে গত বছরের ৭ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন দেন। গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয় রেলওয়ে কর্মকর্তা আবুল কালাম চৌধুরীকে। যিনি এর আগে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের অতিরিক্ত পিডি ছিলেন। আগামীকাল কালুরঘাট সেতু নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তরকে কেন্দ্র করে বোয়ালখালীসহ পুরো চট্টগ্রামে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
তিনদফা ব্যয় বৃদ্ধি : ২০১৫ সালে যখন কালুরঘাট সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় তখন প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। পরে বিআইডব্লিটিএর আপত্তির পর ২০২১ সালে নতুন ডিজাইনে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলে তখন ব্যয় ধরা হয় ছয় হাজার ৩৪১ কোটি টাকা। সর্বশেষ ডিজাইন অনুযায়ী নতুন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিকার কারণে ১১শ কোটি টাকার প্রকল্পটি সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা হয়েছে।

কালুরঘাট সেতুর সুফল : প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে নির্বিঘœ ও নিরবচ্ছিন্ন রেল যোগাযোগ নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সংযোগের সুযোগ তৈরি হবে। বর্তমানে পুরানো ও জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতু দিয়ে ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ট্রেন চলাচল করতে পারে না। এছাড়া মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরে এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য যেমন চাঙ্গা হবে, তেমনি এ রুটের গুরুত্বও বাড়বে। ইতোমধ্যেই দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন চালুর মাধ্যমে ঢাকা ও কক্সবাজারের মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। ফলে পর্যটন নগরীর সঙ্গে নির্বিঘেœ যোগাযোগ নিশ্চিত করতে বিদ্যমান পুরাতন সেতুর পাশে কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর নতুন রেল-কাম-সড়ক সেতুর ভূমিকা বাড়বে। পর্যটনের বিকাশ ঘটবে।
বোয়ালখালীর বাসিন্দারা জানান, শহরের অতি কাছে হলেও এক কালুরঘাট সেতুর কারণেই আমরা অনেকদূর পিছিয়ে। এ সেতুতেই সময়ঘণ্টা ব্যয় হওয়ায় কাছে হলেও সুযোগ সুবিধায় আমরা পিছিয়ে। শহরের কাছাকাছি উপজেলাগুলোয় যে পরিমাণ উন্নয়ন হয়েছে কালুরঘাট সেতু নির্মিত না হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে আমরা পিছিয়ে আছি। কালুরঘাটের বর্তমান দফায় দফায় সংস্কার করা হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি। যে কারণে নতুন সেতু নির্মাণের দাবি বোয়ালখালীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর।
কধুরখীল এলাকার বাসিন্দা শাপলা চৌধুরী বলেন, ‘কালুরঘাট সেতুতেই বোয়ালখালীর উন্নয়ন বন্দি ছিল। এই সেতুটি হবে এমন কথা দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসলেও কিছুই হয়নি। বারবার সেতু নির্মাণ এলাকা পরিদর্শন হয়েছে শুনেছি, কাজ কবে হবে এমন ধারনা কেউ দিতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকার কালুরঘাট সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করছে এটা আনন্দের খবর। কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মিত হলে আমাদের দুঃখ ঘুচবে এবং দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটবে।’