কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে কি প্লাস্টিক তৈরি হতে পারে

53

প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য একটি বিশাল সমস্যা- প্রায় সাত লাখ ২৫ কোটি টন প্লাস্টিক আমাদের ভূমিতে ছেয়ে আছে এবং সমুদ্রকে ভরাট করে রেখেছে। এবং এই সমস্যা এখন সর্বত্র। তবে প্লাস্টিকের একটি ভালো দিকও রয়েছে- কেননা আমাদের প্লাস্টিকের প্রয়োজন এবং প্লাস্টিক যে বিংশ শতাব্দীতে মানুষের জীবনে বিপ্লব ঘটিয়েছে, তা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই।
আধুনিক ওষুধপত্র সম্পূর্ণরূপে প্লাস্টিকের উপর নির্ভরশীল- ভেবে দেখুন রক্তের ব্যাগ, টিউবিং এবং সিরিঞ্জ, পাশাপাশি গাড়ি এবং বিমানের অংশ- সবকিছুই প্লাস্টিকের উপর নির্ভরশীল- যা আমাদের পৃথিবী জুড়ে দ্রুত ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছে।
প্লাস্টিক তৈরির অর্থ হল জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ, যা কিনা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। তবে আমরা যদি কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত না করে প্লাস্টিকের গদি, ফোম ইনসিউলেশন, প্লাস্টিকের কাটলারি, বা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য খাবারের পাত্র তৈরি করার কোন উপায় খুঁজে পাই বা এমন কিছু বের করা যায়, যেটা বায়ুমন্ডল থেকে কার্বন অক্সাইড সরিয়ে ফেলবে, তাহলে কেমন হয়?
নতুন প্রযুক্তিগুলো, নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইডকে প্লাস্টিকে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, যেন পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে যে পরিমাণ গ্যাস ছাড়া হয় সেটা কমানো যায়। কিন্তু এই রূপান্তর কিভাবে সম্ভব? এর পিছনে যে বিজ্ঞান কাজ করছে সেদিকে নজর দেয়া যাক।
প্লাস্টিক হল সিনথেটিক পলিমার- এটি এক ধরনের লম্বা আকারের অণু। যা চেইনের মতো একটার সাথে একটা যুক্ত থাকে। ইউকে সেন্টার ফর কার্বন ডাই অক্সাইড ইউটিলাইজেশন (সিডিইউইউকে)-এর গবেষকরা, কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে কীভাবে নাইলন তৈরি করা যায় সেটার উপায় বের করেছেন।
নাইলন হল অ্যাক্রিলামাইড নামক এক ধরণের পলিমার- যা কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে তৈরি। আপনি কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে নাইলন তৈরি করতে পারবেন- এটা ভাবতে সত্যিই অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে, তবে আমরা এটি করেছি,- সিডিইউইউকের পরিচালক এবং শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. পিটার স্টাইরিং এ কথা বলেছেন।
জীবাশ্ম জ্বালানীকে কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার না করে আপনি এই শিল্পটি পুরো উল্টে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনি রাসায়নিক উপায়ে কার্বন ডাই অক্সাইডের বর্জ্য ব্যবহার করতে পারেন। যা পেট্রোকেমিক্যাল খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাবে।
বর্তমানে, বেশিরভাগ কার্বন ডাই অক্সাইডের নিঃসরণ কার্বনের ব্যবহার থেকে আসে না- এর পরিবর্তে, এই গ্যাস উৎপন্ন হয় অনেক রাসায়নিকের বাই প্রোডাক্ট হিসেবে। তবে গবেষকদের লক্ষ্য হল কারখানা থেকে নিঃসরিত কার্বনকে ধরে রাখা।
কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে প্লাস্টিক তৈরি করতে হলে বিজ্ঞানীদের পরিশীলিত অনুঘটক ব্যবহার করতে হবে, অর্থাৎ এমন কিছু পদার্থ ব্যবহার করতে হবে যা রাসায়নিক বিক্রিয়ার হারকে ত্বরান্বিত করবে।
জার্মানির পেট্রোকেমিক্যাল গ্রূপ কোভেস্ট্রোতে গবেষকরা কার্ডিয়ন ব্র্যান্ড নামে ২০% কার্বন ডাই অক্সাইড দিয়ে তৈরি গদি তৈরি করেছেন। তারা একটি ক্যাটালিস্ট বা অনুঘটক আবিষ্কার করেছেন যা কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য যৌগগুলোর মধ্যে একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, ফলস্বরূপ একাধিক রাসায়নিক উৎপন্ন হয়- যা থেকে তৈরি হয় পলিইউরেথেন। এই উপাদানটি গদি, কুশন এবং ফ্রিজ ইনসুলশেনে পাওয়া যায়।
বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ১৫ কোটি টনেরও বেশি পলইউরেথেন তৈরি হয়। এর কাঁচামাল হিসাবে কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যবহার করা হলে কার্বন নিঃসরণ কমানোয় বড় প্রভাব ফেলা সম্ভব হবে বলে জানানো হয়।
বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক তৈরি করছেন। কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে পলিইউরেথেন উৎপাদনকারী আরেক কোম্পানি যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ইকোনিক আশা করে যে, তারা দুই বছরের মধ্যে ফোমের পণ্যগুলো বাজারে তুলতে পারবে। পাশাপাশি থাকবে, কোটিং, সিলেন্টস এবং ইলাস্টোমার জাতীয় পলিমার যা রাবারের মতো স্থিতিস্থাপকতা সম্পন্ন।
কোম্পানির হেড অফ সেলস, লেই টেয়লর বলেছেন যে এই উপাদানগুলো প্রচলিত প্লাস্টিকের মানের সাথে মিলে যায়, কিছু ক্ষেত্রে সেই প্লাস্টিকের মানকেও ছাড়িয়ে যায়। আমরা আবিষ্কার করছি যে আমাদের কিছু উপকরণের পারফরম্যান্স আগের চাইতে উন্নত হয়েছে, যেমন এসব পণ্য স্ক্র্যাচ প্রতিরোধী আবার অনেক ক্ষেত্রে শিখা নিয়ন্ত্রণকারী।
ইকোনিকের ধারণা, সমস্ত পলিওলের ৩০% (ক্রস লিঙ্কিং এজেন্ট হিসাবে ব্যবহৃত অণু) যদি কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে তৈরি হয়, তাহলে এর ব্যবহারের ফলে বায়ুমন্ডল থেকে নয় কোটি টন কার্বন নির্গমন ঠেকানো সম্ভব – যা কিনা চার লাখ গাছ লাগানো কিংবা রাস্তা থেকে দুই লাখ গাড়ি সরিয়ে ফেলার সমান।
তাহলে আরও কী চাই, কারণ মানসম্মত কাঁচামাল থেকে এই কার্বন ডাই অক্সাইড অনেক সস্তা- এক টন প্রপিলিন অক্সাইডের জন্য যেখানে ২০০০ ডলার গুনতে হয় সেখানে প্রতি টন কার্বন ডাই অক্সাইডের দাম মাত্র ১০০ ডলার- তাই এই প্রক্রিয়াটি উৎপাদকদের প্রচুর অর্থ সাশ্রয় করতে সাহায্য করবে।
অন্যদিকে, বিজ্ঞানীরা পলিকার্বোনেট বিকাশের জন্যও কাজ করে যাচ্ছে। এই পলিকার্বোনেট পুনরায় ব্যবহারযোগ্য খাবারের পাত্র এবং শিশুর বোতল তৈরির জন্য ব্যবহার হয়। এগুলো তৈরি করা হয় কার্বন ডাই অক্সাইডের সঙ্গে চিনি মিশ্রণ ঘটিয়ে। যেমন-জাইলোস, যা ব্যবহৃত কফির গুড়ো থেকে তৈরি হয়।
বিপিএ ব্যবহার করে তৈরি করা বর্তমান পণ্যগুলির তুলনায় এই সুগার ভিত্তিক সমাধানটি যথেষ্ট নিরাপদ। ২০১০ সালে কানাডায় বেবি বোতল এবং সিপ্পি কাপে বিপিএ নামের রাসায়নিক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। আরও উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য হতে পারে কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে ইথিলিন উৎপাদন করা।
বিশ্বব্যাপী আমরা যে প্লাস্টিক তৈরি করি তার প্রায় অর্ধেক ইথিলিন দিয়ে তৈরি, যার কারণে এই ইথিলিন বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালে পরিণত হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের সোয়ানসি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এনরিকো আন্দ্রেওলি, পানি এবং বিদ্যুতের সাথে কার্বন ডাই অক্সাইড যুক্ত করে এমন একটি অনুঘটক বিকাশের চেষ্টা করছেন, যা থেকে ইথিলিন তৈরি করা যায়।
কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে উৎপাদিত ইথিলিন এবং সেটা দিয়ে তৈরি প্লাস্টিকের পলিথিন বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করতে প্রায় ২০ বছর সময় লাগতে পারে। তবে অধ্যাপক আন্দ্রেওলি বলেছেন যে এই লক্ষ্যটি অর্জন করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ফলপ্রসূ হবে।
আমরা ৩০ বা ৪০ বছরেও জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে ইথিলিন তৈরি করতে পারব না- তাই কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে এই ইথিলিন তৈরির অন্যান্য উপায় আমাদের খুঁজতে হবে।
কার্বন নিঃসরণের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবেশবান্ধব বলে দাবি করা পণ্য উৎপাদন করতে আরও বেশি জীবাশ্ম জ্বালানির প্রয়োজন হয়। কার্বন নিঃসরণের পেছনে, যন্ত্রের সাহায্যে ফসল তোলা কিংবা কারখানায় কাঁচামাল প্রক্রিয়াকরণের বিষয়টিকে আমলে নেয়ার আগে এটা দেখা প্রয়োজন যে প্রচলিত প্লাস্টিকের তুলনায় বায়োপ্লাস্টিক তৈরিতে আরও বেশি হারে কার্বন নির্গত হয়। যা কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে প্লাস্টিক তৈরির দিকে আমাদের আবার ফিরিয়ে নেবে- এটি হয়তো পৃথিবীর দূষণ সমস্যা সমাধান করবে না, তবে এটি অন্যান্য উপায়ে পৃথিবীকে আরও সবুজ করে তুলতে সাহায্য করবে।