কাউন্সিলর গোলাম হায়দার মিন্টূ আর নেই

101

পরণে খাদির পাঞ্জাবি-পায়জামা। খাবারে নিরামিষভোজী। সাদাসিদে স্বভাবের এ মানুষটি টানা সাত বার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর-কমিশনার ছিলেন। তিনি হলেন নগরীর ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাইয়্যেদ গোলাম হায়দার মিন্টু (মিন্টু কমিশনার)। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৪টায় ঢাকার ইমপালস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলেসহ অসংখ্য স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
সর্বশেষ অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্যানেল মেয়র নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার মৃত্যুতে প্যানেল মেয়র নির্বাচন স্থগিত করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় নগরীর প্যারেড ময়দানে তাঁর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেন। জানাজা শেষে তাকে হযরত মিছকিন শাহ (রহ.) মাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের উপ-দফতর সম্পাদক ও আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী গণমাধ্যমে বলেন, মিন্টূ ভাই করোনা পজেটিভ হয়েছিলেন। কিছুদিন পর নেগেটিভ আসে। কিন্তু ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ১৩ মার্চ উনাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ (বৃহস্পতিবার) ভোরে তিনি মারা যান। সত্তরের দশকে ভাসানীপন্থী বাম রাজনীতি থেকে উঠে আসা মিন্টূ ১৯৭৭ থেকে ৮১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম পৌরসভার কমিশনার ছিলেন। ১৯৯৪ সাল থেকে টানা ছয়টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি কাউন্সিলর পদে জয়ী হয়েছেন। পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। সর্বশেষ তিনি চকবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ছিলেন। তবে জনপ্রতিনিধির কর্মকান্ডের বাইরে রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় ছিলেন না। জনপ্রতিনিধি হিসেবে সততার জন্য যেমন আলোচিত ছিলেন, তেমনি খুবই সাধারণ ও ব্যতিক্রমী জীবনাচারের জন্যও আলোচনায় থাকতেন। খাদি পাঞ্জাবি-পায়জামা ছাড়া আর কিছু গায়ে দেননি জীবনভর। প্রাণী হত্যার বিরুদ্ধে ছিলেন। সেজন্য গত ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিরামিষ খেতেন। ছিলেন দেশি-বিদেশি বৈচিত্র্যের একজন সংগ্রাহকও। সাহিত্য-গান ভালোবাসতেন। যৌবনে মিন্টু ও তার বন্ধুরা মিলে চকবাজারের একটি খাবার হোটেলকে ঘিরে ব্যতিক্রমী সাহিত্যচর্চা ও আড্ডা গড়ে তুলেছিলেন। মূক ও বধিরদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাদের ভাষা বুঝতেন, তারাও কাউন্সিলর মিন্টূর ভাষা বুঝতেন। তাদের অনেকেই ছিলেন তার দৈনন্দিন পথচলার সঙ্গী। নির্বাচনে নেমে প্রচারণাও চালাতেন ভিন্নভাবে। বিভিন্ন নির্বাচনে দেখা গেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নিয়ে এলাকায় এলাকায় ঘুরছেন। নিজের জন্য ভোট চাচ্ছেন, আবার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের তার নিজের চেয়ে বেশি যোগ্য বলে পরিচয় করে দিচ্ছেন। যোগ্য মনে হলে তাদেরও ভোট দেওয়ার জন্য বলেছেন।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের ভোটের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন ম্যাজিকম্যান। অজ্ঞাত কারণে যুবক বয়সে সংসার জীবনে আগ্রহ ছিল না তার। প্রয়াত সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুরোধে ৪৮ বছর বয়সে সংসারজীবন শুরু করেন। সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টুকে ভোটের রাজনীতিতে অনেকে রহস্য মানবও বলতেন। জামায়াত শিবিরের ঘাঁটি নগরীর চকবাজারে তিনি সাত বার কাউন্সিলর-কমিশনার নির্বাচিত হলেও ছিল না কোন নিজস্ব বাহিনী। নির্বাচন আসলে এলাকার সর্বস্তরের মানুষ তাকে জেতাতে মাঠে নামতেন। প্রতিবারই জামায়াত-বিএনপির শক্তিশালী প্রতিপক্ষ তার সাথে নির্বাচন করেছেন। ২০১৫ সালের নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতের একক প্রার্থী ছাড়াও আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিল আরও ৭ জন। সে নির্বাচনে সবাই তার জয়ের আশা ছেড়ে দিলেও চার হাজার ৯০৫ ভোটের ব্যবধানে নিকটতম প্রার্থীকে হারান তিনি। বারবার তার কাছে পরাজিত হওয়ার পর গত সিটি নির্বাচনে জামায়াতে ইসলাম তার বিপক্ষে প্রার্থী দেওয়ার আর সাহস করেনি। বিএনপি এবং দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত একাধিক শক্ত প্রার্থীর বিপক্ষে নির্বাচন করেও গত নির্বাচনে তিনি টানা ৭ম বারের মতো জয়ী হয়েছিলেন।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, সর্বশেষ নির্বাচনে তিনি কেবল এলাকায় পোস্টারিং করেছিলেন। অতীতের নির্বাচনে তার কোন পোস্টার ছিল না, নির্বাচনী ক্যাম্পেও কোন খাবার বা জাঁকজমকের আয়োজন থাকত না। নির্বাচনে যারা কাজ করতেন তাদের জন্য রাস্তার পাশে দোকান থেকে কখনো বিস্কুট কিনে খেতে দিতেন। এতেই এলাকাবাসী তাকে জেতাতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। উল্লেখ্য, ১৮৬৩ সালে গঠিত চট্টগ্রাম পৌরসভা ১৯৮২ সালে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনে রূপ লাভ করে। এসময় তিনি পৌর কমিশনার নির্বচিত হয়েছিলেন। পরে ১৯৯০ সালে সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তর হয়। ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এরপর ২০০০, ২০০৫, ২০১০, ২০১৫ এবং সর্বশেষ গত ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৬ষ্ঠ নির্বাচন।
এদিকে তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু এলাকাবাসীর অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। নিজের নির্বাচনী এলাকার উন্নয়ন নিয়ে তিনি সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। উনার মৃত্যুতে নগরবাসী একজন সাদামাটা সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিকে হারালো।
তিনি বারবার নির্বাচিত হয়ে অপরাজেয় হিসেবে রেকর্ড গড়েছিলেন। আরেকটি বিষয়ে তিনি বিজয়ী ছিলেন, রাজনীতিতে অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে তিনি একজন উদাহরণ। নিরামিষ ভোজী ছিলেন, গান্ধীর অহিংস নীতির প্রতি তার অত্যন্ত শ্রদ্ধাবোধ ছিল, সাধারণ মানুষের অত্যন্ত কাছে থাকতেন। খুব মার্জিতভাবে কথা বলতেন, মানুষের সেবায় নিজেকে আজীবন বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি।
মিন্টুর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সাইয়্যেদ গোলাম হায়দার মিন্টুর মৃত্যুতে একজন গুণী মানুষকে আমরা হারালাম, যিনি সবসময় জনগণের কাতারে ছিলেন এবং সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন।
এছাড়া শোক প্রকাশ করেছেন চসিকের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, সাবেক প্রশাসক ও নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন। তারা শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।