অমল বড়ুয়া
রাষ্ট্র ও জনগণ একে অপরের পরিপূরক। জনগণ ছাড়া যেমন রাষ্ট্র হয় না, রাষ্ট্র ছাড়া তেমন জনগণও হয় না। জনগণ ও সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম। রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হচ্ছে জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকা। এই সেবার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- নিরাপত্তা (বাহ্যিক ও আভ্যন্তরিণ বিপদ থেকে সুরক্ষা), মৌলিক চাহিদা পূরণ (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র, আবাসন), কর্মসংস্থান, ধর্মীয় স্বাধীনতা, মানবাধিকার সংরক্ষণ করা, বাক্ স্বাধীনতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সংরক্ষণ; আয়-বৈষম্য দুরীকরণ ও সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন নিশ্চিত করা এবং জনগণের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিতকরণে একচেটিয়া বাণিজ্যরোধ। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী- ‘কোন রাষ্ট্রকে তখনই কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বলা যেতে পারে যখন রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিককে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে এবং বেকারত্ব, অসুস্থতা, বৈধব্য অথবা অন্য কোন কারণে জীবিকার্জনের অক্ষমতায় সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করে।’ অর্থাৎ কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হলো এমন এক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে সরকার রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসমূহকে শক্তিশালীকরণে মঙ্গলজনক ও ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। রাষ্ট্র নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার মাধ্যমে তাদের ন্যুনতম চাহিদাগুলি পূরণ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকে। এছাড়া রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিকের ন্যায়বিচার, সাম্য, সমমর্যাদা, স্বাধীনতা, মানবাধিকার ইত্যাদি সুনিশ্চিত করে। আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্র হলো গণতন্ত্র, কল্যাণ ও পুঁজিবাদের একটি স্বতন্ত্র সমন্বয়ের স্বরূপ।
কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা খুবই প্রাচীন। অখন্ড ভারতীয় সম্রাট অশোক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে প্রথম কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার প্রবর্তন করেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন- ‘সকল মানুষই আমার সন্তান’ এবং ‘আমি যতই পরিশ্রম করি না কেন, আমি সমস্ত প্রাণীর কাছে ঋণ পরিশোধ করার জন্যই চেষ্টা করি।’ এটাই ছিল বিশে^ রাজতন্ত্রের সম্পূর্ণ নতুন আদর্শ ও কল্যাণ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন। খ্রিস্টপূর্ব ১২৩ অব্দে রোমান সাম্রাজ্যে গাইউস গ্রাকাসের প্রস্তাবে এবং রোমান প্লেবিয়ান কাউন্সিলের অনুমোদনে নিয়মিত শস্য বন্টন আইনের মাধ্যমে শুরু হয় কল্যাণ রাষ্ট্রের যাত্রা। চীনে হান রাজবংশের সম্রাট ওয়েন (২০৩-১৫৭ খ্রিস্টাব্দ) আধুনিক কল্যাণ নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিভিন্ন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আশি বছরের বয়োবৃদ্ধদের জন্য পেনশন, খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা, সেই সাথে বিধবা, এতিম এবং বৃদ্ধাদের জন্য আর্থিক ও ঋণ সহায়তা, কর অব্যাহতি ইত্যাদি। সম্রাট ওয়েন করদাতার অর্থের অপচয় রোধে সচেষ্ট ছিলেন। খলিফা ওমর সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে আরবে জনকল্যাণে রাষ্ট্রীয় বাজেটে কর আরোপের ধারণাটি চালু করেন। সম্ভবত নতুন রোমান সাম্রাজ্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এর প্রচলন শুরু করেছিলেন। জাকাত হল ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি এবং রমজানের পর বছরে একবার অসহায়দের জন্য অর্থ প্রদানের জন্য মৌলিক সীমার উপরে উপার্জনকারী সমস্ত ব্যক্তিদের ২ দশমিক ৫ শতাংশ আয়কর প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়। উমর (৫৮৪-৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) রাশিদুন খিলাফতের নেতা, বায়তুল-মালের (কোষাগার) মাধ্যমে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিষ্টটল এবং আধুনিক অর্থশাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা এডাম স্মিথের লেখায় কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের খোঁজ মেলে। বিসমার্ক কল্যাণমূলক কাজ বা পদক্ষেপের মাধ্যমে ১৮৮০ সালে জার্মানীতে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু করেন। শিল্পায়ন যুগে ঊনিশ শতকে জাতি রাষ্ট্র গঠন এবং গণতান্ত্রিককরণের ফলে আর্থ-সামাজিক উত্থানের সময় কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের উদ্ভব।
বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে একনায়ক ফ্যাসিবাদী কিংবা কর্তৃত্ববাদী সরকার সবক্ষেত্রেই কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রচলিত ছিল; মূলত: উৎপাদনশীলতা, জাতীয় ঐক্য এবং সামাজিক শান্তি বজায় রাখার জন্য তারা সকলেই চিকিৎসা সেবা, পেনশন, সাশ্রয়ী আবাসন এবং গণপরিবহন প্রদান করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সামাজিক গণতান্ত্রিক দলগুলো মার্কসবাদকে বাতিল করে পুঁজিবাদের মধ্যে একটি অস্থায়ী লক্ষ্য বা নিজের মধ্যে একটি চ‚ড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে কল্যাণ রাষ্ট্রকে একটি রাজনৈতিক লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। কারণ, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র জনগণের সার্বিক কল্যাণের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
একটি জনবান্ধব ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে নয়মাস ব্যাপি যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। অর্ধশত বছরের বন্ধুর পথ-পরিক্রমায় বাংলাদেশ সেই কাঙ্খিত কল্যাণ রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় ও সুসংহত করতে পারেনি এখনো। এতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর পরিকল্পনাহীনতা ও কমিটমেন্টের অভাব, স্বেচ্ছাচারিতা, অপশাসন, দুর্নীতি ও গণতন্ত্রের অভাব। সবচেয়ে দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই পঞ্চাশ বছরেও গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া। সুতরাং রাষ্ট্রীয় সংস্কারের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কল্যাণ রাষ্ট্রে উত্তরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত কল্যাণ রাষ্ট্র তার সমস্ত নাগরিকের কল্যাণ সুনিশ্চিত করে। যেখানে সরকার খুব আন্তরিক এবং সক্রিয়ভাবে সামাজিক কল্যাণ এবং অর্থনৈতিক সমতার আদর্শ ধারণ ও তার বাস্তবায়ন করে। কল্যাণ রাষ্ট্র এমন একটি ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক নিরাপত্তা বলয় তৈরী করে যেখানে ব্যক্তি এবং পরিবারগুলিকে দারিদ্র্য ও পরনির্ভরশীলতা থেকে রক্ষা পেতে সহায়তা করে। মোটকথা, কল্যাণ রাষ্ট্র সামাজিক কল্যাণের নিশ্চয়তার উপর জোর দেয়। শুধু অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমেই কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, জনগণের সামগ্রিক কল্যাণের মাধ্যমেই কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এই কল্যাণ রাষ্ট্র সকলের সমান সুযোগ, সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের নীতির উপর ভিত্তি করে তার নাগরিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মঙ্গল রক্ষা করে। এ রাষ্ট্র জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের কল্যাণের স¦ার্থে কাজ করে।
কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তনে রাষ্ট্রের সকল প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের নৈয়ায়িক আচরণ ও কার্যদক্ষতা বলবৎ থাকা অত্যাবশ্যক। রাষ্ট্রের প্রশাসনিক সমস্যার কারণে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবর্তন দীর্ঘায়িত হতে পারে। কাজেই কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রশাসনের প্রধান বাধাগুলি দুর করা জরুরী। এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র পরিচালনায় দক্ষতা নিশ্চিত করা; সেবাগ্রহিতাদের পরিষেবাগুলির অর্থায়নের জন্য সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বন্টন নিশ্চিতকরণে বিধিবদ্ধ আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করা; প্রশাসনিক শুদ্ধাচার ও নৈতিকতা সুনিশ্চিত করা এবং সেবাদাতাদের ইতিবাচক ও ন্যায়ভিত্তিক আচরণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে কল্যাণ রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথ মসৃণ হবে। বর্তমান যুগে রাষ্ট্রের কাজ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কল্যাণকামী রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটছে। বাংলাদেশও কল্যাণমুখী বহু কর্মকান্ড হাতে নিয়ে কল্যাণকামী হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেছে। এর ফলপ্রসু বাস্তবায়নে এখনই প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নেয়া জরুরী। দেশকে কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করতে যে সব বিষয়গুলোর উপর জোর দিতে হবে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ; দুর্নীতি নির্মূল; সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ; সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা; আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং নৈয়ায়িক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন; সাম্যভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে একচেটিয়া বাণিজ্যরোধ; দারিদ্র্য ও বেকারত্ব নিরোধে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন। এক্ষেত্রে দারিদ্র্য বিরোধী কর্মসূচি এবং ব্যক্তিগত কর ব্যবস্থাকেও কল্যাণ রাষ্ট্রের দিক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ব্যক্তিগত করব্যবস্থা মূলতঃ এর প্রগতিশীলতা আয় বণ্টনে বৃহত্তর ন্যায়বিচার অর্জনের জন্য ব্যবহার করা হয়, যা কেবল রাজস্ব বাড়ানোর জন্য এবং এছাড়াও এটি সামাজিক বীমা প্রদান এবং অন্যান্য সুবিধায় অর্থায়নের জন্য ব্যবহৃত হয়। আর কল্যাণ রাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য ও অন্যতম একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল সামাজিক বীমা, এই ধরনের বীমা সাধারণত ব্যক্তি এবং পরিবারকে সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে করা হয়। রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো জনকল্যাণ এই জনকল্যাণের মহত্তম কর্মযজ্ঞকে এগিয়ে নিতে বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় উত্তরণ জরুরী। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থাই সকল প্রকার বৈষম্য-দুর্নীতি, অপশাসনের মূলে কুঠারাঘাত করে একটি মননশীল পরিশীলিত দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত নৈয়ায়িক সমাজ ও শাসনব্যবস্থার গোড়াপত্তনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট