কর্ণফুলীর ৩০ কিলোমিটার মিঠা পানির রিজার্ভার হুমকিতে

5

নিজস্ব প্রতিবেদক

কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট থেকে রাঙ্গুনিয়ার চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার এলাকা মিঠা পানির রিজার্ভার হিসেবে সংরক্ষিত। কর্ণফুলী ও হালদা নদীর পানি পরিশোধন করেই চট্টগ্রামে সরবরাহকৃত পানির ৯২ শতাংশ যোগান দেয়া হয়। কিন্তু দিনে দিনে লবণাক্ততা বাড়তে থাকায় হুমকির মুখে পড়েছে কর্ণফুলীর মিঠা পানির রিজার্ভার। কর্ণফুলী নদী ভরাট ও কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানি নির্গমন কম হওয়ার কারণেই লবণাক্ততা বাড়ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই রিজার্ভার রক্ষায় বড় ধরনের উদ্যোগ না নিলে চট্টগ্রামে পানি সংকট বাড়তেই থাকবে। পাশাপাশি কৃষি সেচ ব্যবস্থাও হুমকির মুখে পড়বে। এছাড়াও তিন পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড় ক্ষয়রোধক বনাঞ্চল তৈরি না করে উল্টো পাহাড় কাটা, পাহাড়কে ধরে রাখার মতো গাছ না লাগিয়ে পাহাড় ক্ষয় হয় এমন গাছ লাগানোর কারণেও পাহাড়ের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে ঝিরি-ঝর্ণাগুলোও শুকিয়ে যাওয়ায় পাহাড় থেকে সমতলে আসছে না মিঠা পানি। এর ফলেও চট্টগ্রাম নগরসহ সমতলে পানির সংকট তীব্রতর হচ্ছে।
এদিকে, ইতোমধ্যে কর্ণফুলীর মিঠা পানির রিজার্ভারখ্যাত ৩০ কিলোমিটার এলাকায় যাতে লবণাক্ততা না বাড়ে সেজন্য বিকল্প চিন্তা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ওয়াসা। এই দুই দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, আগামি ৫-৭ বছরে চট্টগ্রামে পানির চাহিদা আরও ২০ কোটি লিটার বাড়বে। কর্ণফুলী নদীতে লবণাক্ততার যে সমস্যা সেটি নিরসনে বিকল্প পথ খোঁজা হচ্ছে। কর্ণফুলীর পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। এই পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে হলে কালুরঘাট থেকে চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট পর্যন্ত নদী ড্রেজিংয়ের আওতায় আনতে হবে।
ওয়াসা জানায়, চট্টগ্রামের ৬৫ শতাংশ মানুষ পানি পাচ্ছে। বর্তমানে চট্টগ্রামে পানির চাহিদা ৫৬ কোটি লিটার। দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা ৫০ কোটি লিটার। কর্ণফুলী পানি শোধনাগার-১ ও ২ থেকে ১৪ কোটি করে মোট ২৮ কোটি লিটার পানি পাওয়া যায়। মদুনাঘাট পানি শোধনাগার ও মোহরা পানি শোধনাগার থেকে ৯ কোটি করে ১৮ কোটি লিটার পানি পাওয়া যায়। সবমিলে দৈনিক ৪৬ কোটি লিটার পানি কর্ণফুলী ও হালদা নদী থেকেই পরিশোধন করা হয়। যা কালুরঘাটের পরে থাকা কর্ণফুলী নদী থেকেই তোলা হয়। গভীর নলক‚প থেকে চার কোটি লিটার পানি পাওয়া যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে এই পানির রিজার্ভারে লবণাক্ততা বেড়েছে। শুষ্ক মৌসুম আসলেই কর্ণফুলী নদীতে লবণাক্ততার প্রবণতা বাড়ে। এতে নগরীতে সরবরাহ করা পানি পরিশোধনের পরেও লবণাক্ততা রয়ে যাওয়ায় ওয়াসার পানি পানে আগ্রহ কমছে। লবণ পানি নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়লে পানি সরবরাহও কমিয়ে দেয় ওয়াসা। মূলত চৈত্র-বৈশাখ মাসে কাপ্তাই হ্রদে পানি কমলে কর্ণফুলীতে পানি কমে যায়। এতে উজানে লবণের পানি উঠে যায়। কালুরঘাটের উজানে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করলেই ওয়াসার পানিতে লবণাক্ততা বাড়ে। কর্ণফুলীর উজান থেকে পানির চাপ বাড়লে লবণাক্ততা পানি উপরে উঠতে পারে না। লবণাক্ত পানি কোনোভাবে কর্ণফুলীতে পতিত হওয়া হালদার মুখে পৌঁছলেই ওয়াসার পানিতে লবণ মিলে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘লবণাক্ততার কারণে পানি সরবরাহে সমস্যা হয়। বৃষ্টি না হলে এবং কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে গেলে লবণাক্ততা বাড়ে। কর্ণফুলী ও হালদার লবণাক্ততা সমস্যা সমাধানে বিকল্প পথ খোঁজা হচ্ছে’।
জানা গেছে, কাপ্তাই হ্রদে পানি কম থাকার অন্যতম কারণ পাহাড় থেকে পানি না আসা। পাহাড় কেটে সাবাড় ও পাহাড়ি পানির প্রবাহপথ বন্ধ হয়ে যাওয়া অন্যতম কারণ। ফলে নদীতে পানি কম থাকার কারণে সাগরের পানি প্রবেশ করে লবণাক্ততা বেড়ে তা খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার এলাকার পানি লবণাক্ত। কালুরঘাট থেকে চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার এলাকার পানি মিঠা। কর্ণফুলীতে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকলে কালুরঘাটের উপরে লবণ পানি যেতে পারে না। কোনো কারণে পানি প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হলে লবণ পানি উজানে উঠে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কর্ণফুলী ও হালদা নদীর মিঠা পানির রিজার্ভার। বর্তমানে পানি কমলে লবণ পানি হালদার মুখে চলে যায়। আগামিতে যদি লবণ পানি কর্ণফুলীর আরও উজানে উঠে যায় তাহলে বিপদ বাড়বে। এই মিঠা পানির রিজার্ভার ঠিক রাখতে কর্ণফুলী ড্রেজিং করতে হবে। ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহদাত হোসেনের সাথেও আলোচনা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পাউবো কর্মকর্তারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড রাঙামাটি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা পূর্বদেশকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে সরবরাহকৃত পানিতে লবণাক্ততা কমাতে হলে কর্ণফুলী নদীর মিঠা পানির রিজার্ভার সুরক্ষিত রাখতে হবে। এই নদীতে প্রতিনিয়ত লবণ পানি বাড়ছে। কালুরঘাট থেকে চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার এলাকা ড্রেজিং করা জরুরি। ইতোমধ্যে ১০ কিলোমিটার ড্রেজিং শেষ হয়েছে। বাকি অংশ ড্রেজিং করা গেলেই পানির স্রোত বেড়ে কালুরঘাটের উপরে লবণাক্ত পানি যেতে পারবে না। কোনোকারণে লবণ পানি আরও উপরে উঠলে বিপদ বাড়বে। তখন শুধু সুপেয় পানি নয়, কৃষি ব্যবস্থাতেও বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হবে’।
বিশ্ব পানি দিবস আজ
প্রতিবছরের ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা ও নিরাপদ পানির ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার উপর গুরুত্বারোপ করে এবারের পানি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘হিমবাহ সংরক্ষণ’। ১৯৯৩ সালের জাতিসংঘ সাধারণ সভায় ২২ মার্চকে বিশ্ব পানি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। দিবসটি পালন উপলক্ষে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মসূচি পালন করবে।