মুহাম্মদ আয়াজ, কর্ণফুলী
চট্টগ্রাম শহর থেকে দেয়াঙ পাহাড়ে যেতে পার হতে হবে শাহ আমানত সেতু। সেখান থেকে কোরীয় রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের (কেইপিজেড) গেটে গিয়ে নামতে হবে। গেটে থেকে কেইপিজেড সড়ক ধরে এক কিলোমিটার গেলেই দেয়াঙ পাহাড়ের মরিয়ম আশ্রম।
চারদিকে পাহাড়ঘেরা সবুজ মাঠ। সুনসান পরিবেশ। হরেক রকম ফুল ও পাতাবাহার গাছে পাখিদের কলকাকলি। মাঠের একপাশে পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ির ধাপ। সিঁড়ি বেয়ে উঠলে দেখা যায় কাঁচেঘেরা যিশুমাতা মরিয়মের প্রতিকৃতি। আশপাশে বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন আশ্রম ও ধ্যানঘর। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের দেয়াঙ পাহাড়ের নিরিবিলি পরিবেশে অবস্থিত এই আশ্রমের নাম মরিয়ম আশ্রম। পর্তুগিজ বণিকদের হাতে পত্তন হওয়া প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো খ্রিস্টান পল্লিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই আশ্রম।
১৯৪৬ সালে ব্রাদার ফ্লেভিয়ান লাপ্লান্ত গড়ে তোলেন মরিয়ম আশ্রম উচ্চ বিদ্যালয়। এখানে বর্তমানে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। আশ্রমের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে ধ্যান-প্রার্থনার জায়গা, গির্জা, চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র, ছাত্রাবাস। এ ছাড়া তিনতলাবিশিষ্ট ধ্যানকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে, যাতে নির্জনে বসে ধ্যানসাধনা করা যাবে। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আয়োজন হয় দুই দিনব্যাপী মা মরিয়মের তীর্থ উৎসব। তীর্থ দর্শনে আসেন সারা দেশের মানুষ।
১৫১৮ সালে চট্টগ্রামে আসেন পর্তুগিজ বণিকেরা। ১৫৩৭ সালের দিকে তাঁরা দেয়াঙ পাহাড় এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। দক্ষিণ ভারতের কোচিন থেকে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য ১৫৯৮ সাল থেকে চট্টগ্রামে মিশনারি ও যাজকেরা আসতে থাকেন। যাদের মধ্যে প্রথম আসেন জেসুইট ধর্মসংঘের পুরোহিত ফাদার ফ্রান্সেসকো ফার্নান্দেজ। ১৫৯৯ সালে দেয়াঙে চট্টগ্রামের প্রথম গির্জা নির্মাণ করেন তিনি। ১৬০০ সালে তিনি চট্টগ্রাম শহরের বান্ডেল রোড ও জামালখান এলাকায় আরও দুটি গির্জা নির্মাণ করেন।
মরিয়ম আশ্রম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ব্রাদার সুমন জোসেফ কস্তা দৈনিক পূর্বদেশ’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, দেয়াং পাহাড়ের একটি প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে,পাঁচশত বছর আগে পর্তুগিজ আমল থেকে এখানে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করতে এসেছিলেন ধর্মযাজকরা।
তিনি আরও বলেন, মোগল আমল এবং ইংরেজ আমল থেকে খ্রিস্টানরা এখানে নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে, কিন্তু তারপরও এই দেয়াং পাহাড়ের মরিয়ম আশ্রমে থেকে মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করা হয়েছে। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ সকল ধর্মের জন্য আমরা কাজ করেছি এবং সবার কাছ থেকে নিপীড়নের শিকার হয়েছি তবুও আমরা কাজ করেছি মানুষের কল্যাণে। একটা সময় আরাকানিদের সাথেও মতবিরোধ তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টান সোসাইটির সাথে।
তিনি জানান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছুটা পূর্বে কানাডা থেকে চট্টগ্রামে আসেন ব্রাদার ফ্লেভিয়ান লাপ্লান্ত। তিনি দেয়াংয়ে এসে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আত্মসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি নানা সেবামূলক কার্যক্রমের উদ্যোগ নিয়ে তিনি এই আশ্রম গড়ে তুলেন। তিনি ১৯৪৬ সালে মরিয়ম আশ্রম উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যেখানে এখন দেড় হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছে।