কর্ণফুলীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে বড় পরিকল্পনা

1

নিজস্ব প্রতিবেদক

কর্ণফুলী নদী রক্ষায় ছয় বছর পর আবারো অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে জোরালো পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে জেলা প্রশাসন। চলতি মাসের যে কোনোদিন উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হবে। উচ্ছেদের পর নদীর জায়গা যাতে পুনরায় বেদখল না হয় সে পথও খুুঁজতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নদী সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সাথে পরিকল্পনা প্রণয়নে বৈঠকের উদ্যোগ নেয়া হবে।
সর্বশেষ ২০১৯ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে কর্ণফুলীর পাড়ে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। পরে মামলার কারণে উচ্ছেদ অভিযান থমকে যায়। ২০১৪ সালে কর্ণফুলী তীর জরিপ করে দুই হাজার ১৮১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দখলকারী হিসেবে চিহ্নিত করে হাইকোর্টকে অবহিত করেছিল জেলা প্রশাসন।
কর্ণফুলীল দখল উচ্ছেদ নিয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম পূর্বদেশকে বলেন,‘কর্ণফুলী নদীর রায় হয়েছে। আমরা যে কোনো সময় উচ্ছেদে যাবো। আমরা উচ্ছেদ চালাতে যুগান্তকারী কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করবো। আপনারা দেখবেন আগামী সপ্তাহেই আমরা হয়তো উচ্ছেদে যেতে পারি। নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর।’
জানা যায়, ২০১০ সালে কর্ণফুলীর দখল উচ্ছেদে প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয়। কর্ণফুলীর দখল উচ্ছেদ ও দখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) নামে একটি পরিবেশবাদী সংগঠন রিট পিটিশন দায়ের করে। এই পিটিশনের রায়ের প্রেক্ষিতে আদালত জেলা প্রশাসনকে নদী জরিপ পরিচালনা করে দখল উচ্ছেদ ও দখলদারদের তালিকা প্রস্তুতের নির্দেশ দেয়। পরে দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত করে হাইকোর্টকে অবহিত করে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন প্রতিবেদন দেওয়ার পর মামলা চলাকালীন সময়ে ২০১৬ সালে বিএস ১ নম্বর খতিয়ানের ৮৬৫১ অনুযায়ী কর্ণফুলী নদী জাতীয় মৎসজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডকে ২০১৫ সালে লিজ দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে রায় দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। সর্বোচ্চ আদালত ২০১৯ সালে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। রায়ে দুই হাজার ১৮১টি অবৈধ স্থাপনা সরাতে ৯০ দিনের সময় দেওয়া হয়। এই আদেশের প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে ২৩০টি স্থাপনা উচ্ছেদ এবং ১০ একর ভূমি উদ্ধার করে। পরবর্তীতে জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতি উচ্চ আদালতে আপিল করে। গত ২ মার্চ কর্ণফুলীর দখল উচ্ছেদ নিয়ে মৎস্যজীবী সমিতির দায়ের করা আপিলের রায় দেয় উচ্চ আদালত। আপিল শুনানিতে কর্ণফুলীর দখল উচ্ছেদে নির্দেশনা দেয় আদালত।
কর্ণফুলী দখল উচ্ছেদ নিয়ে কাজ করা এইচআরপিবি এর পক্ষের কৌঁসুলি সিনিয়র এডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আদালতের রায়ের পর কর্ণফুলীর দখল উচ্ছেদে আর কোন বাধা নেই। আশা করছি দ্রæত সময়ের মধ্যেই উচ্ছেদ শুরু হবে। বেআইনিভাবে বন্দর কর্তৃপক্ষ জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতিকে নদীর জায়গা লিজ দেয়ায় উচ্ছেদ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,‘কর্ণফুলী নদীতে যে মৎস্য আড়তের জন্য এতদিন উচ্ছেদ থমকে ছিল সেই মৎস্য আড়ত উচ্ছেদের মধ্যদিয়েই এবারের অভিযান শুরু হবে। ডিসি মহোদয় রমজানের বাজার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা নিয়ে কিছুটা ব্যস্ত থাকায় একটু সময় নেয়া হচ্ছে। কর্ণফুলীর দখল উচ্ছেদ নিয়ে আদালতের রায়ের পর মন্ত্রণালয়সহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও অনেক সিরিয়াস।’
২০২২ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামের সাত উপজেলা ও রাঙ্গামাটির দুই উপজেলায় সমীক্ষা চালিয়ে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে দুই হাজার ৪৯২টি স্থাপনা চিহ্নিত করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। নদী কমিশনের তালিকায় দুই হাজার ৪৯২ অবৈধ স্থাপনার মধ্যে টিনের ঘর এক হাজার ৪৫৪টি, পাকা স্থাপনা ৫৭২টি, আধা পাকা স্থাপনা ৭০টি, মাটির ঘর ৯৩টি, ডকইয়ার্ড ১৬টি, স’মিল ২২টি, পল্ট্রি ও গরুর খামার ২০টি, তেলের দোকান ১১টি, জেটি ৬১টি, ইটভাটা ১২টি, কয়লার ডিপো একটি, বিদ্যুৎকেন্দ্র ১০টি, পুকুরচারটি, পানের বরজ একটি, শুঁটকির মাচান ছয়টি, বালুর ব্যবসা ছয়টি, শিল্প কারখানা ২০টি, সরকারি স্থাপনা ছয়টি ও অন্যান্য স্থাপনা ৫৫টি।
নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন নামে একটি সংগঠন ২০২১ সালে কর্ণফুলী নদী নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, শাহ আমানত সেতু এলাকায় কর্ণফুলী নদীর প্রবাহমান ধারা ছিল জোয়ারের সময় ৫১০ মিটার। ২০১৪ সালে পরিচালিত জরিপে ছিল ৮৮৬ মিটার। একইভাবে রাজাখালী খালের মুখে প্রশস্থতা ৪৬১ মিটার পাওয়া যায়, যা আগে ছিল ৮৯৪ মিটার। চাক্তাই খালের মুখে নদীর প্রশস্থতা ছিল ৪৩৬ মিটার, যা আগে ছিল ৯৩৮ মিটার। ফিরিঙ্গিবাজার মোড়ে নদীর প্রশস্থতা ছিল ৯০৪ মিটার, বন্দর কর্তৃপক্ষ খননের পর সেখানে নদী আছে ৭৫০ মিটার। বাকি অংশে ইচ্ছেমতো গাইড ওয়াল নির্মাণ করে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিয়েছে।তিন বছরের ব্যবধানে কর্ণফুলীর প্রবাহমান ধারায় আরো পরিবর্তন ঘটতে পাারে। একইভাবে বেড়েছে নতুন দখলদার।
চাক্তাই এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন,‘জেলা প্রশাসন ২০১৪ সালে দখলদারের যে তালিকা করেছিল তার দ্বিগুণ দখলদার এখনো আছে। নতুন জরিপ চালালে বুঝা যাবে গত দশ বছরে কর্ণফুলী নদীর দখলদার কত বেড়েছে। এখন তালিকা ধরে উচ্ছেদ না করে নদী যারাই দখল করেছে সবাইকে উচ্ছেদ করলে নদীটির প্রাণ ফিরবে। উন্নত দেশে নদীর পাড়ে বসার মতো কত সুন্দর পরিবেশ। অথচ আমাদের কর্ণফুলীর পাড় দখল করে বাজার, বস্তি গড়ে উঠেছে। উচ্ছেদ করা জরুরী।’