মছিউদ্দৌলা জাহাঙ্গীর
আসলে সৃষ্টিতে স্রষ্টার শৃঙ্খলিত হওয়া মানায় না বা চলে না। তাহলে সৃষ্টি কিন্তু দৃষ্টি কাড়তে পারে না, সৃষ্টিতে স্রষ্টাকে থাকতে হয় পুরা মুক্ত, তবেই হয় শুধু নবরূপ যুক্ত। অবশ্য বলছি না সেসব নস্য, যা কভু হয় না মানুষের নমস্য। অর্থাৎ কিছু কু-সৃষ্টি আছে সেসব নয়, সু-সৃষ্টির ক্ষেত্রে স্রষ্টাকে শৃঙ্খলমুক্ত হতে হয়। সৃষ্টি যদি হঠাৎ কেটে দৃষ্টিচ্যুত হয় মনের মিষ্টি তখন স্রষ্টার দূরীভূত রয়, সে ঘটনা তাহার কভু মনঃপূত নয়। আর এ কারণেই মনে হয় জার্মানির হেসে প্রদেশের অর্থমন্ত্রী থমাস শেফার হেসে হেসেই আত্মহত্যা করে ফেললেন। খবরে প্রকাশ দীর্ঘ দশবছর যাবৎ হেসের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন শেফার। সে প্রদেশকে তিনি নিজ প্রচেষ্টায় অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক সমৃদ্ধশালী করে তুলেছেন। এটি তাঁর একটি সৃষ্টিকর্মের অংশ, অবশ্যই এটি তাঁর একটি সৃজনশীল কাজ। করোনা এলে তিনি নাকি দিনরাত কাজ করছিলেন, যাতে করোনা তাঁর সৃষ্টিকর্মে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। তাঁর নির্মিত অর্থ ব্যবস্থাকে যেন আঘাত করতে না পারে। কিন্তু এত পরিশ্রমের পরও যখন দেখলেন করোনা তাঁর সৃষ্টিতে আঘাত করেফেলেছে, তাঁর প্রচেষ্টায় ব্যত্যয় ঘটিয়ে ফেলেছে নিজেকে, তখন আর সামলে রাখতে পারলেন না। সৃষ্টির উপর চরম আঘাত আসার প্রচন্ড মনস্তাপে চলন্ত ট্রেনের নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকে তিনি ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছেন। অতএব সৃষ্টি তেমন একটি জিনিস, নিজের জীবনের চাইতেও প্রিয়। নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে সৃষ্টিকে রাখতে চায় অক্ষত। ফলে শেফার হয়ে মহাক্ষিপ্ত নিজেকে করেছেন ট্রেনের তলে নিক্ষিপ্ত। হায়রে করোনা, কেন দিচ্ছিস মানুষকে এত যাতনা?
বলা হয় কাউকে কাবু করতে চাইলে তার সৃষ্টিকে আঘাত করো, করোনা দেখছি সেটাই শুরু করেছে। আবার কাউকে বাঁচাতে চাইলেও তার সৃষ্টিকে আঘাত করতে হয়। এক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী গির্জার চূড়ায় ছবি আঁকার কাজ পেলেন, কাজ শেষে নিজের অঙ্কিত ছবি দেখে তিনি বড় মুগ্ধ হলেন। সৌন্দর্যতা অধিক উপভোগ করতে ছবি পানে মুখ করে তিনি পিছাতে লাগলেন। যত পিছাচ্ছেন ছবিকে ততবেশী সুন্দর লাগছে, ফলে পিছাতে পিছাতে মাচার একদম প্রান্তে চলে এসেছেন তিনি। তাঁর অবস্থা দেখে তাঁর সহকারী ভীত হয়ে গেল, আরেক পা পিছালে অনেক উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে শিল্পীর মৃত্যু হবে। এ সময় সহকারী যদি ডাক দেয়, তবুও শিল্পী আঁৎকে উঠে পড়ে যেতে পারেন। ফলে সহকারী আর দেরী করল না, দ্রæত ছবিতে রং ঢেলে দিল। শিল্পী তখন দৌড়ে এসে রেগে সহকারীকে মারতে চাইলেন। সহকারী সব ঘটনা খুলে বললে শিল্পী তখন নিজের ভুল বুঝতে পারেন। তাহলে বুঝা যাচ্ছে বাঁচাতে গিয়ে অনেক সময় সৃষ্টিতে বিঘ্ন ঘটানো লাগে। তবে করোনা চিকিৎসায় তেজগাঁওয়ে আকিজ গ্রুপের হাসপাতাল সৃষ্টিতে কেন বিঘ্ন ঘটানো হল, বুঝলাম না। এখন সেটি কি মারতে, না বাঁচাতে, না উদ্দেশ্য হাসিলে তা আল্লাহ্ই জানেন।
অবশেষে হাসপাতাল নির্মাণ কাজ ফের শুরু হয়েছে শুনে শান্তি পেলাম, কারণ সৃষ্টিতেই তো আনন্দ। কিন্তু বনের বাঘে খাওয়ার আগে যে আমাদের মনের বাঘে খেয়ে ফেলে, সেটা হচ্ছে বড় বেদনার। এই যে দেখুন একজন মন্ত্রী, তিনি জার্মানির মত একটি উচ্চ প্রগতিশীল বিশ্বের মানুষ হয়েও অবসাদে আত্মহত্যা করলেন, বড়ই অনাকাক্সিক্ষত। আবার দেখলাম শ্রীলঙ্কায় করোনাক্রান্ত এক যুবকের কামড়ে এক বৃদ্ধা মারা গেলেন, মূলত তিনি ভয়েই মরেছেন। অনুরূপ ঘটনা আমাদের দেশেও ঘটেছিল সাতক্ষীরায়। ছেলের করোনা হয়েছে ইঞ্জেকশন দিয়ে তাকে মেরেফেলা হবে শুনে মা হার্টফেল করে মারা গেলেন। সে ভয় শুধু এখানে নয়, ইউরোপ-আমেরিকায় পর্যন্ত বিরাজ করছে। ব্রিটেনের রাণী ভয়ে প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভয়ে করোনা পরীক্ষা করাতে রাজি হচ্ছিলেন না। অবশ্য খেদায় পড়লে বাঘও বিড়াল হয়ে যায়। আর বিশ্ব পরিস্থিতি যখন এমন, বাংলাদেশে শুরু হল তখন লঙ্কাকাÐ। খেটে খাওয়া মানুষগুলি করোনার কথা ভাববে কি? লকডাউনে পেটের খাবার যোগাবে কেমনে সে চিন্তায় তারা অস্থির। ফলে পেটের তাগিদে কাজের খুঁজে এ দুর্যোগেও তাদের রাস্তায় বেরুতে হয়। এখন শরৎবাবুর বিলাসীতে, “যে ছেলেদের সকাল আটটায় বাহির হইয়া যাতায়াতে চারক্রোশ পথ ভাঙ্গিতে হয়। বর্ষায় মাথার উপর বৃষ্টির জল ও পায়ের নীচে হাঁটুকাদা এবং গ্রীস্মে জলের বদলে কড়া সূর্য ও কাদার বদলে ধূলার সাগর সাঁতার দিয়া স্কুলঘর করিতে হয়। সে দুর্ভাগা বালকদের মা-সরস্বতী খুশি হইয়া বর দিবেন কি? তাহাদের যন্ত্রণা দেখিয়া কোথায় যে তিনি মুখ লুকাইবেন, ভাবিয়া পান না।”
আমাদের দুর্ভাগাদের এসিল্যান্ড সায়মা-সরস্বতী খুশি হইয়া এমন বর দিলেন, খুশিতে তিন বৃদ্ধকান ধরিয়া লাফাইয়া উঠিলেন। সে খুশীতে সায়মা কাহাকে মুখ দেখাইবেন, ভাবিয়া পান না। আবার পুলিশ-সরস্বতীদের বরে অনেক হতভাগার পিঠে ছোপ ছোপ কালো দাগ পড়েগেছে । অবশ্য কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর পুষ্পবিতরণটা ভাল লেগেছে। দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষদের করোনা নয় ক্ষুধা-ই ভয়। ’ক্ষুধাররাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। ফলে ভাতের জন্য তাদের চেষ্টার নাই কোন ত্রæটি, করোনার প্রতি নাই ভ্রকুটি। খুশী তারা পেলে শুকনা খাবার দুটি, দরকার নেই তাদের কোন অবসর, কোন ছুটি। অতএব মৃত্যুভয়ে অনেকে পালিয়ে বেড়ালেও এই দুখী মানুষগুলা সদা প্রস্তুত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্যে। হায়রে কি নিষ্ঠুরতা দেখুন, ভিটামিন সি করোনাতে উপকারী। লেবুতে ভিটামিন সি আছে, এক টাকার লেবু হয়ে গেল পঁচিশ টাকা! আমাদের দেশের ব্যবসা, বিদেশে ব্যবসায়ীরা নাকি সারাবছর ব্যবসা করে আর উৎসব-দুর্যোগে করে সেবা। আমাদের দেশে সারাবছর করে ব্যবসা আর উৎসব-দুর্যোগে মারে থাবা। থাবা খেয়ে হয় সবে হাবা আঁৎকে উঠে খুঁজতে থাকে বাবা। সেদিন দেখলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া না কোথায় এক ছেলে করোনার ঔষধ বানিয়ে ফেলেছে। দেশের জন্য হলে নেবে ২৫ হাজার কোটি টাকা, বিশ্বের জন্য নিবে একলক্ষকোটি টাকা, তারপর হল শ্রীঘরে দেখা, হাহাহা। ওরে বাটপার, পারছ না করিতে আর কারবার। আবার দেখলাম আমাদের হাটহাজারীর মনসুর আলী বানিয়ে ফেলেছে করোনার ওষুধ, খেতে হবে ১২০ দিন। এখন করোনাতে যারা মরে লক্ষণ প্রকাশের পর তারা নাকি বাঁচেই মাত্র ১২ দিন। বাকী ১০৮ দিন কি তাহলে কবরে খাবে ?
কি যে বলব, বাটপারীর শেষ নাই, আবার দেখি খবরদারীরও শেষ নাই। পুলিশ-মেলিটারীরা এতোদিন বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঘরে থাকতে মিনতি করেছেন। সম্ভবত তাদের সহ্যেরও একটি সীমা আছে শুনেছি এখন প্রয়োজনে পিঠিয়ে বাড়ি পাঠাবেন। এসি ল্যান্ড ৭০ বছর বয়সীদের কান ধরে উঠবস করালেন, এরপরও আমজনতার হুশ ফিরেনি । এবার দেখলাম ঠাকুরগাঁওয়ে এক এসি ল্যান্ড এক ইউপি সদস্যকে লাঠিপেটা করলেন, তা’ও ঘর থেকে বের হয়েছেন বলে! মাশাল্লাহ্ এত তদারকি, বলে না ধরতে বললে বেঁধে আনে? । ঠিক আছে চতুর্দিকে মৃত্যুর মিছিল, গোটা বিশ্ব আতঙ্কের মধ্যে আছে। ফলে জার্মানির মন্ত্রীসহ অনেকেই আত্মহত্যা করছে, কেউ ভয়ে মারা যাচ্ছেন। এদিকে কাইশ্যাও মারা গেল আরো মারা গেলেন স্পেনের রাজকুমারী। এমন ভয়ানক পরিস্থিতিতে আমাদের খেটে খাওয়া মানুষরা রুটিরুজির সন্ধানে দিনরাত লড়াই করছেন। পেটের চাওয়ার কাছে তাদের জানের মায়াকে বিসর্জন দিতে হচ্ছে। এমন যখন পৃথিবীর অবস্থা, কেউ করছেন তখন নিজের ব্যবস্থা। ‘এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায়। এমন দিনে মন খোলা যায় এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরোঝরে তপনহীন’—- কবিগুরুর চরণ। প্রকৃতির এমন উন্মাদনা, এসময় না বললে তারে আর বলবে কখন? কিন্তু তাই বলে ২০২০- এর এই চৈত্র মাসকে কেন বেচে নিতে হলো থাইরাজাকে সে কথা বলার জন্য তারে? করোনায় মানুষ মরে রাজার আনন্দ বাড়ে। ২০ রক্ষিতা নিয়ে রাজা জার্মানির বিলাসবহুল হোটেলে আইসোলেশনে গেছেন। হায়রে রাজা করেছেন দারুণ ব্যবস্থা, মরলে যেন সবাইকে নিয়েই একসাথে কবরে যেতে পারেন, মিশরের ফারাওদের মত। ফারাওরা মারা গেলে নাকি তাদের সাথে পিরামিডের ভেতর দাসীদেরও জীবন্ত কবর দেয়া হত, যাতে সেখানেও সেবা করতে পারে। থাইরাজাও মনেহয় করে নিলেন সে ব্যবস্থা, হাহাহাহা।
কারো সর্বনাশ কারো পৌষ মাস, কেউ ভয়ে মরছে কেউ আনন্দেই কাটাচ্ছেন! থাইরাজা যেমন ফুর্তিতে মেতেছেন, আমাদের ব্যবসায়ীরা তেমন মূল্য বাড়িয়ে চলেছেন। এদিকে আবার ট্রাম্প বলেছেন, ‘মৃত্যু লাখ না ছাড়ালেই আমরা সফল।’ কথাটা তিনি যে সময় বলেছেন তখনও যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যু মাত্র দুই হাজার পাঁচশ। সে অবস্থায় তিনি লাখের চিন্তা করছেন। সেই লাখের ভেতর যদি নিজের অবস্থান হত, পারতেন কি তবে ওভাবে বলতে? পারতেন না, নিজের বেলায় দুধভাত পরের বেলায় কপালে হাত। থাক, যার যা ইচ্ছা তা করুক আমরা সেসব আর না ভাবি। কিন্তু চীনাইয়্যারা এত খাটাশ কেন? সাপ, বিচ্ছু, বাদুড়, বনরুই কিছুই বাদ দেয় না, যা পায় তা খায়। বলা হচ্ছে তাদের এ খাদ্যাভ্যাসের কারণেই করোনা, আবার কেউ কেউ বলছেন, জীবাণু অস্ত্র বানাতে গিয়ে তারা এ বিপর্যয় ঘটিয়েছে। যেটা হবে হোক সমাধান ইনশাল্লাহ্ অতি সন্নিকটে, এই বিপর্যয় থেকে আমরা অবশ্যই মুক্ত হব ইনশাল্লাহ্। তবে ধৈর্য ধারণ করতে হবে, অযথা ভয় পাওয়া চলবে না। প্রতিকার থেকে প্রতিরোধ উত্তম, তাই কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশনের নিয়মগুলি কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। কারণ এ রোগটি অতি ছোঁয়াচে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন এক ডাক্তারের সাথে করমর্দন করলেন। এক সপ্তাহ্ পরে ডাক্তারের করোনা ধরা পড়ল, আল্লাহ্ই জানেন পুতিনের কি অবস্থা, হাহাহা! ভয়পেয়ে আত্মহত্যা বা হার্টফেল কাপুরুষত্ব। মনে সাহস রাখুন, আল্লাহ্ নিশ্চয় সাহায্য করবেন।এদেশের মানুষ করোনার ছোঁয়ায় মরার আগে ক্ষুধার জ্বালায় মরবে। তাই তাদের ক্ষুধানিবারণ করতে হবে, সেজন্য সরকার, সম্পদশালী ও বিশ্ব-সংস্থাদের এগিয়ে আসতে হবে। শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে। শুনলাম সেনাবাহিনী কঠোর হবে, আগে সোহাগ করুন তথা খাবার দিন, তারপর কঠোর হোন।
লেখক : কলামিস্ট