এম ডি ফরিদুল আলম
চীন হয়ে বিশ্বব্যাপী যখন কোভিড-১৯ মানবদেহে সংক্রমণ শুরু করলো তখন থেকে আমরা বাংলাদেশের জনগণ বেশ শংকিত ছিলাম। চীনের পর ইতালী, ফ্রান্স,কানাডা, আমেরিকাসহ ফরেন কান্টিগুলো যেভাবে মৃত্যুপুরীতে রূপ নেয় তাতে মনে হয়েছিলো বাংলাদেশে বাড়ি-ঘরে, রাস্তা- ঘাট, অলিগলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুধু মানুষের লাশ আর লাশ পড়ে থাকবে। যেখানে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে সামাল দেয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিলো। বাংলাদেশে যখন করোনার সংক্রমণ শুরু হলো তখন বাসার আশেপাশে কোন এম্বুলেন্স এসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে নিজের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করতো। মনে হতো কেউ করোনা সংক্রমিত হয়েছেন বা কেউ উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। মনে হতো যেনো মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তার বিশেষ দয়া হলো। বাহিরের দেশগুলোর মতো বাংলাদেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। করোনার টিকা কবে আসবে তা জনমনে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ালেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে টিকা এসে পৌঁছায়। ফেব্রুয়ারি ৭,২০২১ ইং তারিখে টিকা প্রদান কার্যক্রম শুরু হয়। জনমনে স্বস্তি ফিরে আসলেও টিকা নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা সমালোচনাও কম হয়নি। তবু যে যার সুবিধা মতো টিকা গ্রহণের জন্য নিবন্ধন করে আসছেন। তার মানে টিকা না নিয়ে যে উপায় নেই তা হয়তো অনেকেই এখন বুঝতে পারছেন। আমরা সবকিছু ফ্রি পেলে হুমড়ি খেয়ে পড়লেও করোনার টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে অনেকের আগ্রহে ধীরগতি মনে হচ্ছে। কিংবা সামনে আরো সময় এমন ভাবতে ভাবতে অনেকেই সময় নষ্ট করছেন। রিকশাচালক, দিনমজুর তথা খেটেখাওয়া মানুষের মধ্যে অনেকেই করোনার টিকা নেয়ার গুরুত্ব বুঝছেন না। অথচ বাংলাদেশ সরকার বিনামূল্যে টিকা নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। যদি টাকার বিনিময়ে টিকা নিতে হতো অনেকের ইচ্ছে সত্বেও সামর্থ্যের বিষয়টি অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতো। খেটে খাওয়া মানুষের সমস্যা হতো সবচেয়ে বেশি।
একসময় এনআইডি কার্ড ছাড়া কোনকিছুতে আবেদন, ব্যাংকিং কার্যক্রমসহ জরুরি কোন কাজ সম্পন্ন করা গেলেও এখন বাধ্যতামূলক। একইভাবে আগামীতে এমনও হতে পারে জরুরি কোন কাজে করোনা টিকার সনদ বাধ্যতামূলক। এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। মানবজাতি এমন এক জাতি যারা উদ্ভট কাজ করতে অভ্যস্ত। কোন সংকটপূর্ণ মুহুর্ত পেরুলেই মনে করি ঝামেলামুক্ত। করোনার ক্ষেত্রে এমনটি ভাবলে ভুলের মাশুল গুনতে বেশি সময় লাগবে না। হঠাৎ রাস্তাঘাটে প্রচুর মাস্কবিহীন মানুষের চলাচল বেড়েছে। তার মানে কি করোনায় মৃত্যুপুরীতে রূপ নেয়া ইতালী, আমেরিকার কথা মানুষ ভুলতে বসেছেন!? কেবল অফিস-আদালতে মাস্ক ব্যবহার করলেই চলবে না। বাহিরে ঝুঁকি কম নয়। সমুদ্রের গভীরের চেয়ে কিনারার আশপাশে অগভীর পানিতে হাঙ্গরের আক্রমণের ঝুঁকি কম হলেও ঝুঁকিমুক্ত নয়। তাই গভীর-অগভীর সমুদ্রের কথা না ভেবে সমুদ্রে যে হাঙরের অস্তিত্ব রয়েছে তা মূলত ভাবার বিষয়। বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান। তবে করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমে আসলেও জোয়ারের মতো আবারো তেড়ে আসছে। যা নতুন করে প্রতিদিনের ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ থেকে সহজেই অনুমেয়। হাতের নাগালে পেলেই এর ছোবল থেকে রেহাই পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট Worldometer-এর ১৮ মার্চ ২০২১ তারিখের তথ্যমতে, বিশ্বে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১২ কোটি ১৯ লক্ষ ৪৩ হাজারোর্ধ এবং মৃতের সংখ্যা ২৬ লাখ ৯৪ হাজারোর্ধ। যা দ্রুত ক্রমবর্ধমান। বাংলাদেশে ১৮ই মার্চ ২০২১ তারিখে একদিনে গত তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ করোনা সংক্রমণ সনাক্তের রেকর্ড করেছে, যা থেকে আমাদের এখনই সাবধান না হলে হয়তো সামনে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে সম্মুখসারির অনেককে আমরা হারিয়েছি। অনেক চিকিৎসক, নার্স করোনা সংক্রমিত রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে নিজেরাও সংক্রমিত হয়ে ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিক, ব্যাংক, কাস্টমারকেয়ারে গ্রাহক সেবায় নিয়োজিত সম্মুখসারির অনেকেই সংক্রমিত হয়ে করোনার কাছে হার মানতে হলো। একইভাবে এটর্নি জেনারেল, সচিব, সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, মেয়র থেকে শুরু করে সর্বস্তরের কেউ বাদ নেই করোনার ছোবল থেকে। পরিবাবের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে নি:স্ব হয়েছে অনেক পরিবার। আগামীতে যেনো কোন পরিবারে এমন পরিস্থিতি না হয় সেদিকে নজর দিলে হয়তো করোনার সংক্রমণ ঝুঁকি থেকে নিজেকে এবং আপনজনদের রক্ষা করা সম্ভব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুব শীঘ্রই মাঠে নামার খবর সংবাদ মাধ্যমে উঠে এসেছে। তাছাড়া করোনাকে ঘিরে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে দেশ ও দশের সুফল মিলবে নিশ্চয়ই। করোনার ভয়াবহতা পরবর্তীতে বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিও দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের শেয়ারবাজার। ব্যাংক, ইন্সুরেন্সসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিজস্ব গতি ফিরে পেয়েছে। এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে দেশের মানুষকে সংক্রমণমুক্ত থাকার চেষ্টা জরুরি। কারণ মানব সম্পদ সুস্থ থাকলে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে। করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি এড়ানোর পূর্বশর্ত হলো মাস্ক ব্যবহার করা। সেই সাথে প্রত্যেককে টিকাগ্রহণে সোচ্চার হতে হবে। নয়তো তীরে এসে তরী ডুবানোর মতো অবস্থা হতে পারে। করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সরকারের গৃহীত ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’’ নীতি নিঃসন্দেহে সঠিক সিদ্ধান্ত। তবে এই নীতি বাস্তবায়নে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। মাস্ক ছাড়া সবধরনের সেবা বন্ধ করলে মানুষের মাঝে নিঃসন্দেহে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে।
জানা যায়, মেক্সিকোর ব্লাইন্ড কেভফিশ প্রজাতির মাছের জন্ম পানির নীচে অন্ধকার গুহায়। শারীরিক গঠন বৃদ্ধির সাথে সাথে এদের চোখ বিলুপ্ত হতে থাকে। তবু এরা গভীর পানিতে অন্ধকার গুহায় নানান প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে। অথচ আমরা সবকিছু দেখতে পেয়েও নিজেদের ব্যাপারে সচেতন নই। হঠাৎ ক্রমবর্ধমান এই সংক্রমণ করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কাজেই দেশ ও দশের স্বার্থে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা জরুরী।
লেখক: প্রাবন্ধিক