কঠিন চীবর দানোৎসব এবং নাগিতাপদান

1

ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু

বুদ্ধের ধর্মে ভিক্ষুসঙ্ঘের ত্রৈমাসিক প্রথম বর্ষাবাস সমাপনের পর আশ্বিন পূর্ণিমার পরদিন হতে কার্তিক পূর্ণিমা পর্যন্ত এক মাস সময়ের মধ্যে বর্ষাবাসকারী ভিক্ষুসংঘকে কঠিন চীবর দান করতে ভগবান বুদ্ধ নির্দেশ দিয়েছেন। কঠিন চীবর দানের উৎপত্তি বিষয়ে, কেনো কঠিন চীবর দান করতে হয়, কিভাবে, কোন ভিক্ষুকে কঠিন চীবর দান করতে হবে, চীবরের বিধি বিধান, সে সব বিষয়ের বিবরণ আমরা বিনয় পিটকের অন্তর্গত মহাবর্গ গ্রন্থের কঠিন স্কন্ধ বিভাগ, বিনয়ের অর্থকথা ‘সামন্তপাসাদিকা’ এবং প্রাতিমোক্ষের অর্থকথা ‘কঙ্খাবিতরণী’ গ্রন্থ হতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অবগত হই। কঠিন চীবর দানের ফলে গ্রহীতা এবং দাতার পুণ্যানিসংস সম্পর্কেও সেখানে উল্লিখিত হয়েছে।
আমাদের বাংলা ভাষায় শ্রদ্ধেয় ধর্মতিলক স্থবির রচিত ‘সদ্ধর্ম রতœাকর’, শ্রদ্ধেয় সমণ পূর্ণানন্দ সামী রচিত ‘রতœমালা’ শ্রদ্ধেয় জিনবংশ মহাস্থবির রচিত ‘সদ্ধর্ম রত্ন চৈত্য’ এবং শ্রদ্ধেয় ধর্মপাল মহাথের রচিত ‘সদ্ধর্ম রত্নমালা ‘সহ আরও কিছু নিত্যপাঠ্য পূজা, বন্দনা, সুত্রপাঠ ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্বলিত পুস্তক সমূহে কঠিন চীবর দানের বর্ণনা করতে গিয়ে সেখানে অরহত নাগিত স্থবিরের ভাষিত কঠিন চীবর আনিসংস গাথা সমূহ প্রদত্ত হয়েছে। সদ্ধর্ম রত্ন চৈত্য গ্রন্থে নাগিত স্থবিরের মুখ নিঃসৃত ৩৬ টি গাথা প্রদত্ত হয়েছে। বাংলা ভাষায় রচিত পুস্তক সমূহের কোনো গ্রন্থের একটিতেও গ্রন্থকারেরা উল্লেখ করেননি যে, তাঁরা গাথাগুলি ত্রিপিটকের বা অর্থকথার বা টীকা বা অনুটীকা বা অন্যকোন পালি গ্রন্থের কোথা হতে নিয়েছেন। কোথাও কোনো উৎস তথ্যসূত্রের উল্লেখ নাই।
আমি নিজেও ‘বুদ্ধ বন্দনা ও সাধনা পদ্ধতি’ গ্রন্থটি রচনার সময় গাথাগুলির উৎস সন্ধান করতে ত্রিপিটকের গাথা সূচীতে গিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। অট্ঠকথা ও টীকায়ও দেখেছি। কিন্তু কোথাও গাথাগুলি আমার দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় স্বীয় গ্রন্থে সেগুলি লিপিবদ্ধ করিনি।
শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন কঠিনানিসংস দেশনার গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, গাথাগুলি ‘নাগিতোপদান’ হতে সংগৃহীত। সেখানে বলা হয়েছে যে, কামাবাচর লোকের কুশল কর্মের মধ্যে কঠিন চীবর দান হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ পুণ্য কর্ম। অরহত নাগিত স্থবির তাঁর ভাষিত গাথার মধ্যে বলেছেন-
‘কঠিনদানং দত্বান সঙ্ঘে গুণ বরুত্তমে।
ইতো তিংসে মহাকপ্পে নাভি জানামি দুগ্গতিং।’
অর্থাৎ আমি একবার গুণোত্তম সঙ্ঘকে কঠিন চীবর দান করেছিলাম। সে পুণ্যফলে ত্রিশ মহাকল্প পর্যন্ত দুর্গতি কি তা অনুভব করি নাই।’ তিনি আরও উল্লেখ করেছেন-‘তখন হতে প্রত্যেক জন্মে আমি জাগতিক সমস্ত রকমের ভোগ্য বস্তু সমূহ লাভ করেছি, কঠিন চীবর দানের প্রভাবে আমি অনেক ধনী হয়ে উন্নত বংশে জন্ম গ্রহণ করেছি। ‘
তিনি আরও বলেছেন যে, কঠিন চীবর দানের প্রভাবে আমি কখনও চারি অপায়াদি দুর্গতি ভূমিতে জন্ম গ্রহণ করি নাই। সবসময় উচ্চতর মনুষ্যকুলে এবং দেবকুলে উৎপন্ন হয়েছি।’ ভদন্ত নাগিত স্থবির ঘোষণা করেছেন যে-‘তিনি দেবরাজ ইন্দ্র হয়ে দেবলোকে শতাধিকবার জন্ম গ্রহণ করে দিব্যসুখ ভোগ করেছেন, সহস্রাধিকবার পৃথিবীতে চক্রবর্তী রাজা হয়ে সংসারকে শাসন করেছেন। এসবই হল কঠিন চীবর দানের পুণ্যফল।’
যাহোক, বর্তমান সময়ে আমাদের ভিক্ষুসঙ্ঘেরা এবং উপাসক-উপাসিকারা কঠিন চীবর দানকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কঠিন চীবর দানকে উপলক্ষ্য করে অনেক বস্তুও দান দিয়ে থাকেন। কঠিনানিসংস বর্ণনায় বলা হয়েছে-
‘যাবতা সব্ব দানানং খুদ্দকানি বহুনি চ।
একস্স কঠিন দানস্স কলং নগ্ঘন্তি সোলসিং।’
অর্থাৎ ছোট-বড় যত প্রকারের দান রয়েছে, সব কিছু দান করলেও একখানা কঠিন চীবর দানের ষোল ভাগের একভাগ পুণ্যও হবেনা।’ উক্ত গাথাগুলির উৎস জানা না গেলেও যেভাবে কঠিন চীবর দানের অকল্পনীয় ফলের কথা বর্ণনা করা হয়, তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে উপাসক-উপাসিকাগণ কঠিন চীবর দান করতে হুরমুড়িয়ে পড়েন। কারণ, তাঁরা সর্বোত্তম বা সর্বাধিক পুণ্য লাভ করতে চান।
আমি ইহাও কোন কোন ভিক্ষুর দেশনায় নাগিত স্থবিরের উদ্ধৃতি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে শুনেছি যে, যাঁরা একবার কঠিন চীবর দান করবেন, তাঁরা কখনও অপায় দুর্গতিতে জন্ম গ্রহণ করবে না।’
অথচ বৌদ্ধ মূল পিটকীয় গ্রন্থের বক্তব্য হল-অপায় রোধ হয় একমাত্র স্রোতাপত্তি ফলে প্রতিষ্ঠিত হলে। অন্য কোন উপায়ে চারি অপায় রোধ অসম্ভব বলে খুদ্দক পাঠের রতন সুত্রেও বুদ্ধ উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি কথা উল্লেখ করছি যে, বুদ্ধ পরবর্তী সময়ে রচিত পালি সাহিত্যে অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যেগুলি বুদ্ধ ভাবনা ও বুদ্ধ ভাবনার বিপরীত।
লেখক : বৌদ্ধ গবেষক