কক্সবাজার পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত। দেশের বৃহত্তম পর্যটন নগরীর মূল আকর্ষণ এই সমুদ্র সৈকত। দেশ বিদেশের অসংখ্য পর্যটকের ভীড়ে সাংবৎসর মুখর থাকে এ সৈকতনগরী। ইদানিং সৈকতের বিভিন্ন স্থানে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্টদের সৈকত রক্ষায় দ্রæত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। আগের দুই বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও ভেঙেছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন অংশ। জোয়ারের সময় ভেঙে তলিয়ে যাচ্ছে সৈকত ও সড়ক, ধসে যাচ্ছে বাঁধের জিও ব্যাগ, উপড়ে পড়ছে ঝাউগাছ; যাতে ঝুঁকিতে পড়ছে সৈকতের বিভিন্ন স্থাপনা। সৈকতে প্রথমবারের মতো ব্যাপক আকারের ভাঙন দেখা দেয় ২০২২ সালের আগস্টে। পরের বছর একই মাসে জোয়ারের ভাঙনে বিলীন হয় মেরিন ড্রাইভের দুই কিলোমিটার অংশ। এবার ভাঙন দেখা দেয় সেপ্টেম্বরে। টানা সাত দিনের অতি ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পর ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ৫ কিলোমিটার সৈকত। ভাঙনের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সৈকতের কয়েকটি অংশ। এবার অবশ্য এই ভাঙনের কারণ ও প্রতিকার নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে একটি প্রতিবেদন মিলেছে, যেটি এই সমস্যা সমাধানের পথ খুলে দিতে পারে।
কক্সবাজার সৈকতের পূর্ব দিকে পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে আকস্মিক বন্যা ও ভ‚মি ধসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়মিতই ঘটে। কিন্তু বিগত ১০ বছরের তুলনায় এ বছরের বন্যা তুলনামূলক দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় এবং ব্যাপক আকারে সৈকতে ভাঙন হওয়ায় তা পরিদর্শনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। টানা তিন বছর ভাঙনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিওআরআই) তাদের এনভায়রনমেন্টাল ওশানোগ্রাফি অ্যান্ড ক্লাইমেট ডিভিশন এর ছয় সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে। ভাঙন প্রবণ এলাকা পরিদর্শন শেষে ওই দল একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে সৈকতে ভাঙনের কারণ ও প্রতিকারে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ দলটি সৈকতের নাজিরারটেক হতে টেকনাফ পর্যন্ত মোট ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ সড়ক ও উপক‚ল বরাবর ভাঙন পরিস্থিতি পরিদর্শন করে। তারা সুগন্ধা, লাবণী, কলাতলী ও প্রেসিডেন্ট বিচ পয়েন্ট এবং মেরিন ড্রাইভ সড়কের দরিয়ানগর থেকে হিমছড়ি এলাকা পর্যন্ত বেশ কিছু অংশে ভাঙন দেখতে পায়। প্রতিবেদনে চলতি বছর সৈকতের ভাঙনের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যাকে। গত ১৩, ১৪ ও ১৫ সেপ্টেম্বর যথাক্রমে ১৬৭ দশমিক ৩৬, ৩৩২ দশমিক ৭৬ এবং ১২৬ দশমিক ২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে কক্সবাজারে। ১৩ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর সাত দিনের ভারি বৃষ্টির কারণে হিমছড়ি থেকে দরিয়ানগর পর্যন্ত এলাকায় ব্যাপক পাহাড় ধসও ঘটে।
বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান ও জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বলেন, ‘কলাতলী সৈকতে বালির নিচে প্লাস্টিক, পলিথিন, এমনকি ইট-সুড়কির সন্ধান মিলেছে। কক্সবাজার শহরের পানি এই সৈকত ধরে সাগরে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে কোনো ড্রেনেজ সিস্টেম নেই’।
তাদের অনুসন্ধান বলছে, বর্ষায় যখন সাগরের পানি কলাতলী দিয়ে সাগরে গেল, সেই ধারাটা আর সৈকত সামলাতে পারেনি। কারণ, বালির নিচে প্লাস্টিক পলিথিন ও ইট-সুড়কি থাকায় সেখানে সৈকত এটাচড (সংযুক্ত) ছিল না। ফলে ভাঙন ধরে, সৈকতের পাশে ড্রেন হেলে পড়ে যায়। কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ‘কক্সবাজার শহর থেকে বর্ষার পানি আগে সুগন্ধা পয়েন্ট দিয়ে বাঁকখালী নদীতে গিয়ে পড়ত। এখন সেই ড্রেনেজ সিস্টেমটি নষ্ট। তাই শহরের পানি কলাতলী পয়েন্টে সৈকতের উপর দিয়ে সাগরে গিয়ে পড়ছে। গত মাসে শহরে বন্যা এবং কলাতলী ও আশেপাশের এলাকায় সৈকতে ভাঙনের এটা মূল কারণ’।
সুগন্ধা পয়েন্টে ভাঙনের কারণ কিছুটা ভিন্ন তুলে ধরে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘সেখানে সৈকতে বালু ও মাটির মিশ্রণ পাওয়া গেছে।। ওখানে সৈকতের পাশে যে কংক্রিট সড়ক তাতে ড্রেনেজ সিস্টেম আছে কিন্তু সেটার দেয়ালও ভেঙে গেছে পানির তোড়ে। মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন দরিয়া নগর থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত পাহাড়ের মাটি আবার নরম। সে কারণে টানা বৃষ্টি হলে ওই এলাকায় পাহাড় থেকে বড় গাছ ধসে পড়ে। এই তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেখানে মাটির বন্ধন ক্ষমতা কম হওয়ায় পাহাড়ে ধস নামে। আর সৈকতের ওই অংশ তুলনামূলক নিচু হওয়ায় সেখান দিয়ে পাহাড়ি ঢলের পানি সাগরে নামে। ফলে সৈকতেও ধসের সৃষ্টি হয়’।
বালিয়াড়ি ধ্বংস বাড়াচ্ছে ক্ষতি পূর্ণিমার জোয়ারে সৈকতের কলাতলী, সুগন্ধা, সিগাল, লাবণী ও শৈবাল পয়েন্টের প্রায় ৩০০-৩৫০ ফুট সৈকত জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়, ভেসে যায় বিভিন্ন অংশে সাগর তীরের বাঁধের জিও ব্যাগ। জোয়ারের পানি নামার পর এসব স্থানে দেখা যায় ভাঙা সৈকতের। কক্সবাজার শহর সংলগ্ন সৈকতের প্রায় ৮০ কিলোমিটার জুড়ে বিভিন্ন পয়েন্টে ভাঙন প্রতিরোধে তিন ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থার সুপারিশ করেছে বিশেষজ্ঞ দল। সুপরিশ অনুসারে সৈকতের ভাঙ্গন রোধে বিশেষজ্ঞদের নির্দেশিত পথে পর্যটেন মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং স্থানীয় প্রশাসনের সম্মিলিত উদ্যোগে জরুরি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি সমগ্র দেশবাসির।