নিজস্ব প্রতিবেদক
কক্সবাজারসমুদ্র সৈকত এখন পূর্ণাঙ্গ পর্যটননগরী। নানা অবকাঠামো নির্মাণ ও যাতায়াত সুবিধার কারণে কক্সবাজারের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। পর্যটকদের আকর্ষণও বেড়েছে চোখে পড়ার মতোই। বন্ধের দিনগুলোতে তাই কক্সবাজার নগর অতীতের চেয়েও বেশি লোকারণ্য থাকে। বছরের দুই ঈদে ও পর্যটন মৌসুমে কক্সবাজার সৈকতে মানুষের ভিড়ে হাঁটা-চলাও দায়। পূর্ণাঙ্গ বুকিং থাকে হোটেল-মোটেলগুলো। সড়কে বাড়ে যানজট। এমন ঘিঞ্জি পরিবেশে অবকাশ যাপনে যাওয়া মানুষের আনন্দ ফিকে হয়ে যায়। যে কারণে পর্যটকরা কিছুটা নিরিবিলি পরিবেশেই অবকাশযাপনের জন্য এখন কক্সবাজার শহর ছেড়ে ইনানীর বিস্তৃত নীল জলরাশির সৈকতের দিকেই বেশি ঝুঁকছেন। ঝামেলাবিহীনভাবে সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে ঘুরে বেড়ানো ও সৈকত পরিদর্শনে পর্যটকদের পছন্দ এখন ইনানী। এক পাশে পাহাড়, অন্যপাশে নীল জলরাশির সৈকত, মাঝখানে নয়নাভিরাম প্রকৃতি আর নিরব-যানজটমুক্ত সড়কই যেন পর্যটকদের ইনানীমুখী করতে উৎসাহিত করছে। তবে রেজুখালের উপর নির্মিতব্য সেতুর কাজ চলায় কিছুটা দুর্ভোগে পড়লেও উচ্ছ¡াসে ভাটা দেখা যায়নি পর্যটকদের মাঝে।
রেজুখালের উপর নির্মাণাধীন সেতুটির কাজ সম্পন্ন হলে উখিয়া উপজেলার ইনানীসহ কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত অঞ্চলসমূহে পর্যটনখাতে মাইলফলক হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয়রা জানান, এক সময় কক্সবাজারে শুধুমাত্র বাসযোগেই পর্যটকরা আসা-যাওয়া করতেন। এখন ট্রেন ও বিমানে প্রচুর পর্যটক যাতায়াত করছেন। চারটি ট্রেন ও বিমানের প্রতিটি ফ্লাইটই থাকে পর্যটকে ঠাসা। অর্থাৎ বাস, ট্রেন ও বিমানে- তিনভাবেই পর্যটকরা এখন কক্সবাজার যাচ্ছেন স্বাচ্ছন্দের সাথেই। পাশাপাশি চট্টগ্রামসহ আশেপাশের জেলা-উপজেলাগুলো থেকেও প্রচুর পর্যটক বেড়াতে যাচ্ছে। এতে কক্সবাজার শহরে মানুষের চাপ বাড়ে। বিশেষ করে পর্যটন মৌসুম ও দুই ঈদে মানুষের ভিড় থাকে প্রচুর। যে কারণে প্রচুর মানুষ এখন নিরিবিলি ও শান্ত পরিবেশ থাকার জন্য ইনানীর দিকে ঝুঁকছেন।
আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে উখিয়া উপজেলার ইনানী এলাকার সমুদ্রঘেঁষা গ্রামগুলোর পাশেই সমুদ্রঘেঁষে তৈরি হয়েছে অসংখ্য হোটেল-গেস্ট হাউজ। আছে থ্রি স্টার থেকে ফাইভ স্টার মানের হোটেলও। মানসম্পন্ন খাবারের হোটেলও আছে সেখানে। এক সময় কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়া পর্যটকরা মেরিন ড্রাইভ সড়কে গাড়ি নিয়ে সকালে গিয়ে বিকেলেই ফিরতে হতো কক্সবাজার শহরে। মনোমুগ্ধকর পরিবেশ-প্রকৃতি আর সুযোগ-সুবিধাসমৃদ্ধ হওয়ায় এখন মানুষ ইনানী সমুদ্র এলাকা ও মেরিন ড্রাইভেই নিরাপদে রাত্রীযাপন করতে পারায় সেদিকেই চলে যান শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। আগে কক্সবাজার শহর থেকে ইনানী ঘুরে ফিরে আসতেন পর্যটকেরা। এখন ইনানী থেকে কক্সবাজার শহরে সকালে এসে বিকেলে ইনানীতে ফিরছেন তারা। কোলাহল-যানজটপূর্ণ শহর থেকে একটু দূরে প্রশান্তিময় ভ্রমণ নিশ্চিত করতেই পর্যটকদের ইনানীমুখী হওয়া বলে তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
কক্সবাজারে ঈদ-উল আযহার ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া ঢাকার পর্যটক শাহরিয়ার সোনম পূর্বদেশকে বলেন, ‘আগে একবার ঈদের ছুটিতে কক্সবাজার বেড়াতে এসে পরিবেশটা অনেক ঘিঞ্জি লেগেছিল। তাই এবার অনেকটা নিরিবিলি পরিবেশে থাকার জন্য ইনানীকেই বেছে নিয়েছি। কক্সবাজার শহরে ঘুরতে আসলেও রাত্রীযাপনসহ অধিকাংশ সময় কাটিয়েছি ইনানীতে। সেদিকের পরিবেশ অনেক শান্ত ও মনোমুগ্ধকর। হোটেলে থাকা ও খাওয়া-দাওয়া মিলিয়ে সেদিকটায় অনেক ভালো লাগে’।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ইনানীর পর্যটন বিকাশে প্রধান যে বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দিয়েছি সেটি হচ্ছে নিরাপত্তা। পর্যটকরা যাতে কোনোরূপ হেনস্থার শিকার না হন, ভালোভাবেই যাতে অবকাশযাপন করতে পারেন সেদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি আছে। এছাড়াও ইনানীতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর স্থাপনা থাকায় নিরাপত্তা অনেক বেশি। ইট কংক্রিটের শহর ছেড়েই কক্সবাজারে পর্যটকরা বেড়াতে আসে। যে কারণে কক্সবাজার শহরে ইট কংক্রিট ছেড়ে গ্রামীণ পরিবেশের স্বাদ নিতে ইনানীতে আসতে চান পর্যটকরা। পর্যটকরা অবকাশযাপনের যে নিরিবিলি পরিবেশ পছন্দ করে তার সবটাই ইনানীতে আছে। যেভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে, ইনানী সৈকত একটি সময় কক্সবাজারের যে সৈকতগুলো আছে সেগুলোর সাথেই যুক্ত হবে।
তিনি বলেন, মেরিন ড্রাইভ সড়কে রেজুখালের উপর যে সেতুটি আছে সেটি নড়বড়ে ও একমুখী হওয়ায় প্রায় সময় সেতুতে যানজট লেগে থাকে। যে কারণে রেজুখালের উপর নতুন সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এই সেতুটি নির্মিত হলে ইনানী হবে কক্সবাজারের পর্যটনের পূর্ণাঙ্গ হাব। ইনানীতে এখন সী পার্ল হোটেল, বে-ওয়াচ, ডেরা, অ্যাংকরের মতো ভালোমানের হোটেল আছে। যেখানে থাকার পরিবেশ কক্সবাজার শহরের নামিদামি হোটেলের তুলনায় ভালো। ছুটির দিনগুলোতে এই চার হোটেল খালি পাওয়া কঠিন। ইনানীতে নিরাপত্তা বাড়ায় এবং পর্যটনের নানা সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে পর্যটকদের আস্থা এখন শহর ছেড়ে গ্রামে। আমরা আশা করছি সেতুটি নির্মাণ হলে ও সড়ক বড় হলে ইনানীতে পর্যটনশিল্পে মাইলফলক হবে।
ইনানী এলাকার বাসিন্দা রাসেল আহমদ বলেন, কক্সবাজার শহরের পরিবেশ অনেক ঝামেলাপূর্ণ। যে কারণে ঢাকার অধিকাংশ পর্যটক আসেন ইনানীতে। কক্সবাজারে যেতে হলে লিঙ্ক রোড, বাস টার্মিনাল ও ডলফিন মোড়ের যানজটে নাকাল অবস্থায় পড়তে হয়। আর ইনানীতে যারা অবকাশযাপন করেন তারা রামু হয়ে সরাসরি ইনানীতে আসতে পারে। মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রশস্তকরণ ও রেজুখালে সেতুর কাজ পুরোপুরি শেষ হলে ইনানীতে মানুষের ভিড় আরও বাড়বে।