সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরুর সাথে সাথে বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থক বা অনুসারীদের মধ্যে সংঘাত-সহিংসতাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সংঘর্ষ এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার জড়িয়ে পড়ছে সরকারি দল সমর্থিত ও একইদলের সমর্থনবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র পরিচয়ে কাউন্সিলর প্রার্থীদের অনুসারীরা। মূলতঃ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই এসব সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। নির্বাচনের ভোটগ্রহণের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে এ ধরণের সংঘাত আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সাধারণ ভোটার ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা।
তবে, নির্বাচন কমিশন ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা যে কোনও ধরণের নির্বাচনী সংঘাত-সহিংসতা ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছেন। বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডকে অপেক্ষাকৃত সংঘাতপ্রবণ হিসেবে বিবেচনায় রেখে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে নির্বাচন কমিশন থেকে এরই মধ্যে সিএমপি কমিশনারকে বলা হয়েছে। নির্বাচনের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী এবং বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার যাতে কেউ করতে না পারে সে ব্যাপারেও সময়মত পদক্ষেপ নেয়ার জানান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান এ বিষয়ে পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা সাত-আটটি ওয়ার্ডকে শুরু থেকে সংঘাতপ্রবণ হতে পারে এরকম বিবেচনায় নিয়েই আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেছি। পাশাপাশি নির্বাচনের আগে নির্ধারিত সময়ে আমরা বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র থানায় জমা নেয়ার নির্দেশনা প্রচার করব। নির্বাচন শেষে সেগুলো পুনরায় থানা থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন লাইসেন্সধারীরা।’
সিএমপি কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান প্রত্যেক ওয়ার্ডে দল সমর্থিত বা স্বতন্ত্র প্রার্থী যারা রয়েছেন, তাদের পূর্বের রেকর্ডপত্র আমরা যাচাই করে দেখছি। পাশাপাশি তালিকা ধরে অবৈধ অস্ত্রধারী বা সন্ত্রাসীদের কে কোথায় অবস্থান করছে বা এলাকায় কেউ চলাফেরা করছে কিনা সেসব আমরা খোঁজ রাখছি। ছোটখাট যেসব সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে সেসব ক্ষেত্রে পুলিশ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি আমরা বৈধ অস্ত্রধারীদের গতিবিধির ওপরও নজর রাখছি।’
নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা অনুযায়ী, সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে এবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মনোনীও দুই প্রার্থীসহ সর্বমোট আটজন ৪১টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিলিয়ে সর্বমোট দুইশ’ ১৭ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দি¦তা করছেন। এর মধ্যে ওয়ার্ডভিত্তিক কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে এবারই প্রথমবারের মত দল সমর্থিত প্রার্থী দেয়া হয়েছে। তবে দলীয় সমর্থনবঞ্চিত অনেকে নানা নাটকীয়তার পরও স্বতন্ত্র পরিচয়ে নির্বাচনী যুদ্ধের ময়দানে টিকে রয়েছেন। এরা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে লোকমুখে প্রচার পাচ্ছেন। সেই হিসেবে ৪১ ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৩ টিতে বিদ্রোহী প্রার্থী আছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে। অন্তত পাঁচটি ওয়ার্ডে বিএনপিরও বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে। ফলে, নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে বাড়তি উত্তাপ রয়েছে এলাকায় এলাকায়।
জানা গেছে, আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরুর পর ১৫ নম্বর বাগমনিরাম ওয়ার্ড এবং ২৫ নম্বর রামপুর ওয়ার্ড, ২৮ নম্বর দক্ষিণ পাঠানটুলী ওয়ার্ডে মারামারি হয়েছে সরকারি দল সমর্থিত ও সমর্থনবঞ্চিত কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে। সর্বশেষ গতকাল শনিবার বিকাল পৌনে তিনটার দিকে ৩৮ নম্বর দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডের সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় নাগরিক কমিটির ব্যানারে স্বতন্ত্র কাউন্সিলর পদপ্রার্থী মোহাম্মদ হাসান মুরাদ ও তার সমর্থকদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় হাসান মুরাদ ও তার ছেলেসহ মোট ছয়জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে চারজনকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তারা হলেন, ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কাউন্সিলর প্রার্থী হাসান মুরাদ (৫৫), তার ছেলে সাদমান সামি (১৪), ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সালাউদ্দিন (৪৫) ও বন্দর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম।
এর আগের দিন গত ১৩ মার্চ বিকেল সোয়া চারটার দিকে নগরীর সদরঘাট বাংলাবাজার এলাকায় ২৮ নম্বর দক্ষিণ পাঠানটুলী ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর এবং নির্বাচনে স্বতন্ত্র পরিচয়ে পুনরায় প্রার্থী হওয়া আব্দুল কাদেরের সমর্থকদের ওপর হামলা চালানো হয়। হামলায় ২৮ নম্বর দক্ষিণ পাঠানটুলী ওয়ার্ড যুবলীগের সহসভাপতি বাবুল দাশ তনয় মাথায় গুরুতর আঘাত পান। এছাড়া, একই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা, নগর ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও ২৮ নম্বর দক্ষিণ পাঠানটুলী ওয়ার্ড শাখার সভাপতি আব্দুল গনি রিপনসহ পাঁচজন আহত হন। হামলার জন্য সরকারি দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুরের সমর্থকদের দায়িী করা হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজনের চট্টগ্রাম শাখার সম্পাদক এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রার্থীতাকে কেন্দ্র করে তৃণমূল পর্যায়ে বিরোধ বা সংঘাত বেড়ে যাওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। পূর্বদেশকে তিনি বলেন, এবার মেয়র পদের পাশাপাশি কাউন্সিলর পদেও দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। আবার একই দলের অনেকে ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। অনেক চেষ্টা করেও দলের লোক হিসেবে পরিচিতদের বাগে আনা যায়নি। অনেক ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলররা প্রার্থী রয়েছেন। ফলে, সংঘাত-সহিংসতা বাড়ার শঙ্কাই বেশি।