ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের ‘অপরাধের তথ্য প্রমাণ’ মিলেছে

2

পূর্বদেশ ডেস্ক

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের জড়িত থাকার প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার কথা বলেছে তদন্ত সংস্থা।
চিফ প্রসিকিউটর অ্যাড. এম. তাজুল ইসলাম গতকাল রবিবার এ মামলার শুনানিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ তথ্য তুলে ধরেন। তিনি এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আরো তিন মাস সময় চাইলে বিচারপতি মো. গোলাম মূর্তজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করে। খবর বিডিনিউজের
শুনানিতে তাজুল ইসলাম বলেন, এই মামলায় ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে ১৮ জন আটক রয়েছেন। বাকিরা পলাতক। তদন্ত সংস্থা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, জখমী ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের এবং স্থানীয় জনসাধারণের বক্তব্য রেকর্ড করেছেন। পাশাপাশি ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনগণের মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্ট ও ভিডিও ক্লিপ, হাসপাতালের চিকিৎসা সংক্রান্ত নথি পর্যালোচনা করেছেন’।
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, আওয়ামী ও ১৪ দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের ক্যাডার ও হেলমেট বাহিনী দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ও বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার উপর হামলা ও গুলি করে তাদের নিহত ও আহত করেছেন। আন্দোলন চলাকালে এই আসামিরা আদেশ-নির্দেশ এবং উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। এছাড়া এদের সহযোগীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট ও টকশোতে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে প্ররোচিত করেছেন। সেগুলোও পর্যালোচনা করেছে তদন্ত সংস্থা।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘এসব তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে তদন্ত সংস্থা আসামি ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন’।
প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তিন মাস সময় চাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে দেড় হাজার মানুষ নিহত এবং ২৫ হাজার আহত হয়েছেন। এসব ঘটনার সাক্ষী রয়েছে হাজারের উপর। তাদের বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে। এক হাজারের অধিক রয়েছে ভিডিও ক্লিপ। এজন্য তদন্ত রিপোর্ট দাখিলে তিন মাস সময় চাই’।
শুনানি শেষে আদালত সময় মঞ্জুর করে ২০ জুলাই প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য করে দেয়। এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা ১৮ জনকে এদিন ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
তারা হলেন সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, ফারুক খান, দীপু মনি, আব্দুর রাজ্জাক, শাজাহান খান, গোলাম দস্তগীর গাজী, আমির হোসেন আমু, কামরুল ইসলাম, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, সাবেক উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী, সালমান এফ রহমান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক এমপি সোলায়মান সেলিম, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাংগীর আলম।
গত ১৭ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।

হাতকড়া বিতর্ক
আনিসুল হকসহ ১৮ জনকে এদিন প্রিজনভ্যান থেকে হাতকড়া পরিয়ে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নেওয়া হয়। পরে বেলা ১২ টার দিকে তোলা হয় ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায়। এরমধ্যে শাজাহান খানসহ কয়েকজনকে হাতকড়া পরানো অবস্থায় কাঠগড়ায় নেওয়া হয়। এ নিয়ে ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফারুক খানের আইনজীবী ব্যারিস্টার মুস্তাফিজুর রহমান খান বলেন, ‘ইতোপূর্বে এই আসামিদের হ্যান্ডকাফ ছাড়াই ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হতো। কিন্তু কিছুদিন ধরে তাদেরকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ট্রাইব্যুনালে আনা হচ্ছে। বিশেষ করে আজকে কাঠগাড়য় আনার পরও হ্যান্ডকাফ পড়ানো কয়েক জনের’।
এ পর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের বক্তব্য জানতে চান ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান। দু’জন পুলিশ সদস্য বলেন, পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা রয়েছে আসামিদের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, হেলমেট ও হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিতে হবে। এসআই নুরুন্নবী বলেন, প্রিজন ভ্যান থেকে হেলমেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হ্যান্ডকাফ পরানো নিয়ে আসামি শাজাহান খান, হাসানুল হক ইনু তাদের ‘হুমকি’ দিয়েছেন। শাজাহান খান আমাদের বলেছেন, ‘তোদেরকে দেখে নেব’। ইনু বলেছেন, ‘তোদের চৌদ্দগুষ্টি খেয়ে ফেলব’। এমনকি হাজতখানায় তারা এ বিষয়ে বৈঠকও করেছেন।
এ সময় কাঠগড়া থেকে শাজাহান খান, ইনু, কামরুল ইসলামসহ অন্যরা বলতে থাকেন- এগুলো ‘মিথ্যা’ কথা। এ ধরনের কোনো হুমকি দেওয়া হয়নি।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম তখন বলেন, ‘নিরাপত্তার জন্য হুমকি হলে যে কোনো আসামিকে হ্যান্ডকাফ, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরিয়ে হাজতখানায় আনার নিয়ম রয়েছে। তবে পুলিশ সদস্যরা আসামিদের আজকের আচরণ নিয়ে যেটা আমাদেরকে বলেছেন, তা বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা। একজন আসামি জিয়াউল আহসান হেলমেট ফ্লোরে ছুড়ে মেরেছেন। এগুলো আইন বহিভর্‚ত আচরণ। কাঠগড়ায় কয়েকজন আসামিকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আনা হয়েছে। এটা অনিচ্ছাকৃত কারণে। কারণ কার্যতালিকার দুই নম্বর মামলার শুনানি না করেই তিন নম্বর মামলার আসামিদের দ্রæত নিয়ে আসার কারণে এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে। ফলে পুলিশ সদস্যরা হ্যান্ডকাফ খোলার সময় পাননি। যার কারণে কয়েকজনের হাতে হ্যান্ডকাফ ছিল’।
শাজাহান খান এ সময় বলেন, ‘প্রিজন ভ্যান থেকে বের করার আগে হেলমেট ও জ্যাকেট পরানো হয়েছে। যখন দু’হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পরাবে তখন আমি আপত্তি করেছি। বলেছি, এভাবে হ্যান্ডকাফ পরালে আমি কীভাবে গাড়ি থেকে নামব। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। পরিবারের আরো ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। এই দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার ন্যূনতম মর্যাদাটুকু চাই’। সাবেক নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান এ সময় প্রশ্ন করেন- ‘আওয়ামী লীগ কি নিষিদ্ধ দল?’
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান তখন বলেন, ‘রাজনৈতিক কথা না বলে যে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেটাতে থাকুন। আপনারা অতীতে কে কোন পজিশন হোল্ড করেছেন সেটা আমরা জানি। জেল কোড অনুযায়ী কারাকর্তৃপক্ষ আসামিদের নিরাপত্তার বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। আর পুলিশ সদস্যদেরকে বলছি, আপনারা বাড়াবাড়ি করবেন না। যদি কোনো আসামি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, তখন ব্যবস্থা নেবেন আইন অনুযায়ী’।