সুলতানুল আরেফিন
যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, সমাজ গড়ার কারিগর কারা? উত্তরে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ‘পুরকৌশলীরা’। একটি জাতির স্বপ্ন গড়ার ভিত যেখানে গাঁথা হয়, সেখানে পুরকৌশলের ¯পর্শ অনিবার্য। ইট, বালু, সিমেন্টের সীমারেখায় যে নিখুঁত ভারসাম্য, যে জ্যামিতিক ছন্দ, তা আসলে এক নিঃশব্দ শিল্প যার নাম ‘সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং’। পুরকৌশল মানে শুধু সেতু বানানো নয়, শুধু রাস্তা নির্মাণ নয়, এ এক পূর্ণাঙ্গ নান্দনিক বিজ্ঞান। এটি এমন এক পেশা, যেখানে প্রযুক্তির সাথে হৃদয়ের সংযোগ ঘটে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, বাড়ি থেকে হাসপাতাল, খেলার মাঠ থেকে গ্লাস টাওয়ার সবকিছুর ভীত গড়ে তোলেন পুরকৌশলীরা। বাংলাদেশের ইতিহাসে পুরকৌশলের অবদান যেমন গৌরবের, তেমনই প্রেরণার। পদ্মা সেতু আজ শুধু একটি প্রকল্প নয়, এটি একটি আত্মবিশ্বাসের নাম।
নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মাল্টিপারপাস সেতু হিসেবে এটি বাংলাদেশের পুরকৌশলের সক্ষমতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আরো আছে যমুনা সেতু, যা পূর্ব-পশ্চিম বাংলাদেশের যোগাযোগের সেতুবন্ধন। কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে টানেল, যা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নদীর নিচের টানেল হিসেবে বাংলাদেশের গর্ব। বিশ্বদৃশ্যেও পুরকৌশলের বিস্ময়কর নিদর্শন অগণন। ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, ব্রাজিলের ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার, ভারতের স্ট্যাচু অব ইউনিটি, মিশরের পিরামিড, চীনের গ্রেট ওয়াল, সংযুক্ত আরব আমিরাতের বুর্জ খলিফা, আমেরিকার গোল্ডেন গেট ব্রিজ, হুভার ড্যাম, জাপানের শিনকানসেন ট্রেন সিস্টেম সবই পুরকৌশলের বিস্ময়কর রূপ। এইসব স্থাপনার পেছনে রয়েছে হাজারো সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের মেধা, শ্রম, পরিকল্পনা ও নিখুঁত বাস্তবায়ন। পুরকৌশল পেশা যেন এক নীরব বিপ্লব। দিনের পর দিন রোদে-ঘামে শ্রমিকের পাশে দাঁড়িয়ে, মাটি-কাদায় পা ডুবিয়ে যারা একটা ভবিষ্যৎ নির্মাণ করেন তাদের হাতে গড়ে ওঠে আগামী দিনের দেশ। প্রতিটা ব্রিজ, প্রতিটা রাস্তা, প্রতিটা ড্রেনেজ সিস্টেম পুরকৌশলীর চিন্তার ফলাফল। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে যেমন অবকাঠামো প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন এই পেশার দক্ষ ও আন্তরিক মানুষ। এই পেশার সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে এর দায়িত্ববোধে। একটি ভুল হিসাব মানে দুর্ঘটনা। একটি উপেক্ষিত দিক মানে বিপর্যয়। তাই প্রতিটি পরিকল্পনার মধ্যে থাকে তীক্ষè পর্যবেক্ষণ, বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ, এবং মানুষের কল্যাণের নিরব সাধনা। আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে পুরকৌশল হওয়া উচিত এক গর্বিত স্বপ্ন। কারণ এটি শুধু একটি চাকরি নয়, এটি দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ। জনগণের জন্য নিরাপদ বাসস্থান, চলাচলের পথ, বিশুদ্ধ পানি এবং টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার ব্রত। এই পেশায় না আছে ক্যামেরার ঝলকানি, না আছে মিডিয়ার লাইমলাইট। আছে শুধু নির্মাণের শব্দ, ইটের ধুলো আর বাস্তবতার ঘাম। তবু এই ঘামই তো একদিন হয়ে ওঠে মানুষ গড়ার বুনিয়াদ। এই নিঃশব্দ কারিগরির নামই পুরকৌশল। এ এক ঐতিহ্যে রাঙা, গর্বে ভাসা, নিষ্ঠায় গড়া পেশা।
লেখক : ছাত্র- ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং,
চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট