ঐতিহাসিক স্থাপনা পরিত্যক্ত মনোহর আলী জমিদার বাড়ি

1

মুহাম্মদ আয়াজ, কর্ণফুলী

দক্ষিণ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউপিতে অবস্থিত ৩’শ বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য ঘেরা জমিদার বাড়ি যা স্থানীয়দের কাছে মিয়া বাড়ি বা দেয়াং পাহাড়ের জমিদার বাড়ি নামে বেশ পরিচিত। সেই শতবর্র্ষী তৎকালীন জমিদার মনোহর আলী খানের এই বাড়িটি এখন অবহেলা ও অযতেœ জঙ্গল ঘেরা ঝোপঝাড়ে পরিণত হয়েছে। জমিদার বাড়িটা দেখলে এখন যে কেউ বলবে এটা ভূতুড়ে বাড়ি ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে মোগল আমলের সেই লালচে ইটের যে প্রাসাদটি, এই বাড়ির রয়েছে শতবর্ষী ইতিহাস ও ঐতিহ্য। কিন্তু আদতে সে ইতিহাসের কতটা জনশ্রুতি, কতটা সত্য, তা নিয়েও রয়েছে জনমনে নানা প্রশ্ন। এই বাড়ির গল্প বলতে গেলে সুবেদার শায়েস্তা খানের নামটা উঠে আসে। বলা হয়ে থাকে, শায়েস্তা খান তার জমিদারির ২৫ শতাংশ দেওয়ান মনোহর আলী খানকে দান করেছিলেন। সেখান থেকেই তাদের জমিদারি শুরু। একসময় তাদের জমিদারি চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে নোয়াখালী হাতিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
চট্টগ্রামের অধিকাংশ ছোট জমিদার ছিলেন এ পরিবারের তালুকি জমিদার। বছরের বিশেষ দিনে এই ছোট জমিদারেরা মনোহর আলী খানের কাছে খাজনা নিয়ে আসতেন। আর সে সময় এখানে বসত ভারতবর্ষের সেরা শিল্পী, বাদকদের আসর। ভোলা যায় না, এমন এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত।
জনশ্রæতি রয়েছে, এই পরগনার নাম ছিল দেয়াঙ। সেটা ছিল রাজা শ্যাম রায়ের। এখন এটি কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের মিয়ারহাট এলাকার অংশ। দেয়াঙ পরগনার পাশেই ছিল প্রাচীন বন্দর। এ এলাকা মোগল বাহিনীর বংশ ছিল না। জমিদার শায়েস্তা খান তাই এখানে এসেছিলেন শত্রæদের শায়েস্তা করতে।
চট্টগ্রাম বিজয়ের সময় শায়েস্তা খানের সেনাপতি ছিলেন তারই ছেলে বুজুর্গ উমেদ খান। আর এই উমেদ খানের সহযোগি সেনাধ্যক্ষ ছিলেন রাজা শ্যাম রায়। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে দেওয়ান মনোহর আলী নাম নিয়েছিলেন।
জমিদার মনোহর আলী খানের বংশধর সাজ্জাদ আলী খান মিটু সপরিবারে থাকেন চট্টগ্রাম শহরে। তিনি জানান, ১৬৬৫ সাল থেকে এ পরিবারের জমিদারি শুরু হয়। দীর্ঘ কয়েক শ বছর জমিদারি চলার পর জমিদারিপ্রথা বিলুপ্ত হলে কমতে থাকে জমিদার বংশীয়দের শৌর্যবীর্য। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে পুরনো জমিদার বাড়ি।
জমিদার মনোহর আলী খানের অধস্তন সপ্তম পুরুষ ছিলেন ফাজিল খান। তিনি ফাজিল খাঁর হাটের প্রতিষ্ঠাতা। নবম পুরুষ ছিলেন ইলিয়াছ খান। মূল সড়কের পাশে ৩০০ বছর পুরনো যে মসজিদ রয়েছে, সেটির প্রতিষ্ঠাতা এই ইলিয়াছ খান।
নবাব শায়েস্তা খানের আমল থেকে এ পর্যন্ত ১৯তম বংশধর জমিদারি কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সর্বশেষ জমিদার আসাদ আলী খানের পুত্র জমিদার আনোয়ার আলী খান ও সালামত আলী খানের বংশধরের সাত পরিবার বর্তমানে এলাকায় বসবাস করছে।
দেয়াঙ পাহাড়ের মাটি দিয়ে বিশেষভাবে ইটগুলো তৈরি করা হয়েছিল। এর সঙ্গে চুন-সুরকির মিশেলে স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়। জমিদারের বংশধরেরা ষাটের দশক থেকে ভবনটিতে বসবাস করা বন্ধ করে দেন।
স্থানীয়রা জানান, জমিদার বাড়িটি প্রায় ৩’শ বছরের পুরোনো বিভিন্ন ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আছে। এই জমিদার বাড়িতে এখনো প্রাচীনতম অনেক নিদর্শন রয়েছে যা অযত্ন ও অবহেলায় প্রায় বিলীনের পথে, সরকার যদি সে ইতিহাস সংরক্ষণ করতে পারলেই পর্যটকেরা এখানে এসে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ একটি পরিবেশ পাবে এবং প্রাচীনকালের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে যেতে পারবে। এটি এখন চট্টগ্রাম শহর থেকে সহজে আসা যায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেল দিয়ে মাত্র ১০ মিনিটের পথ বড়উঠানের মিয়ারহাট থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় জমিদারবাড়ি যাওয়া যাবে। এ ছাড়া বাসে করে দেশের যেকোনো স্থান থেকে শাহ্ আমানত সেতু নেমে লোকাল বাস বা অটোরিকশায় করেও যাওয়া যায় প্রাচীনতম এই জমিদার বাড়িতে।