জসিম উদ্দিন মনছুরি
রাজনৈতিক দলগুলির বিভাজন সংস্কারে ঘোর অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। দফায় দফায় রাজনৈতিক দলগুলির সাথে সংস্কার কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের দেখা মিলেনি এখনো। সংস্কারের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পাঁচটি কমিশন গঠন করলেও কমিশনের তেমন একটা অগ্রগতি এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। কিছু কিছু বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছানো সম্ভব হলেও অধিকাংশ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলির অনৈক্যের কারণে সংস্কার দৃশ্যমান হচ্ছে না। স্বাধীনতার পর থেকে যে দলই ক্ষমতায় এসেছে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে জনগণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারাই ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত ছিল। সরকারি দলের একচ্ছত্র আধিপত্য ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে গণতন্ত্র সফলতার মুখ দেখেনি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এই পর্যন্ত ১২টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোন নির্বাচনই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে গণতন্ত্রকে বারবার হরণ করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তিনশোটি সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসন ভাগিয়ে নেয়। গণতন্ত্র ও সাম্য ও মানবতার কথা বলে দেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার স্বাদ জনগণ এখনো উপভোগ করতে পারেনি। বিগত সাড়ে ১৬ বছর আওয়ামী দুঃশাসনে জনগণ প্রায় অতিষ্ট। হত্যা, গুম,অপহরণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ঘুষ ও দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য পরিণত হয় দেশ। ভোটের নামে জনগণকে প্রতারিত করে আওয়ামী লীগ দিনের ভোট রাতে সম্পন্ন করে নজির স্থাপন করেছে। বলা হয়ে থাকে ভারতের মদদে শেখ হাসিনা প্রায় ১৭ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলো। স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহসী হয়নি। হরণ করা হয় বাকস্বাধীনতা ও ভোটাধিকার । ৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার উত্তাল আন্দোলনে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে দেশের জনগণ আশার আলো দেখতে পায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অস্থিতিশীল দেশকে স্থিতিশীল করার লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছেন। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে পুনর্গঠন করা হয়েছে নির্বাচন কমিশন। সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বিচার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। এরই মধ্যে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার জুলাই গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল পুনর্গঠন করেছেন। ইতোমধ্যে গণহত্যাকারী স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বেশ কয়েকজনের নামে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়েছে। সংস্কারের লক্ষ্যে গঠন করা হয় পাঁচটি সংস্কার কমিশন। সংস্কার কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রিয়াজের নেতৃত্বে চলমান সংকট নিরসনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলির সাথে দফায় দফায় বৈঠক চলমান রয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় রাজনৈতিক দলগুলির অনৈক্যের কারণে সংস্কার প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদের মতে সংস্কার কমিশনে খাওয়া-দাওয়া বেশ হচ্ছে কিন্তু সংস্কার প্রক্রিয়া তেমন একটা অগ্রসর হচ্ছে না। মূলত বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির অনৈক্যের কারণে অধিকাংশ সংস্কার প্রক্রিয়া বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়নের লক্ষ্যে সংস্কার কমিশন বিভিন্ন প্রস্তাব আনলেও জামায়াত ইসলামী ও এন সিপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি ঐক্যমতে পৌঁছালেও বিএনপির অনৈক্যের কারণে সংস্কার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ করে গেলেও নির্বাচনের তারিখ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে অনৈক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। সর্বশেষ বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজন করার উদ্যোগী হয় সরকার। তবে শর্ত দেয়া হয় যদি এর মধ্যে গণহত্যার বিচার এবং সংস্কার প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হয় তাহলে কেবল নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব। বিএনপি এই বিষয়টাকে স্বাগত জানালেও তাদের কারণে বরাবরই সংস্কার প্রক্রিয়া পিছিয়ে পড়ছে। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, ক্ষমতার ভারসাম্য আনায়ন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। সংসদ সদস্যদের এখতিয়ার নিয়েও বিএনপির মধ্যেও রয়েছে ঘোরতর আপত্তি। কিছু কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক ঐক্য সাধিত হয়েছে যেগুলো মৌলিক বিষয় নয়। এমতবস্থায় সংস্কারবিহীন নির্বাচন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালিত হলে যুগের পর যুগ স্বৈরাচারী তন্ত্র পরিচালিত হবে। রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও কারচুপির নির্বাচনের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালকে গ্রেফতারের পর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তোলা হলে তিনি অকপটে স্বীকার করেন দ্বাদশ নির্বাচন ছিল একটি ডামি নির্বাচন। তিনি এও বলেন ক্ষমতার লোভ স্বয়ং শেখ মুজিব পর্যন্ত সামলাতে পারেননি। যার ভিত্তিতে তড়িগড়ি করে নির্বাচন দেয়া হয় ১৯৭৩ সালে। নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তিনশোটি আসনের মধ্যে ২৯৩ টি আসনে জয়লাভ করে। মূলত সে নির্বাচনকেও কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রহসনের নির্বাচন বলে অভিহিত করেন। তিনি আরো বলেন সংস্কারবিহীন এক হাজার বছর নির্বাচন হলেও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করা আদৌ সম্ভব হবে না। তার বক্তব্য থেকে স্পষ্টত প্রতিয়মান হয় আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলো। তাছাড়া তার কথার মাধ্যমে সংস্কারের আবশ্যকতা অপরিহার্য। ইতোমধ্যে বিগত তিনটি নির্বাচনের অনিয়ম তদন্তে কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় সংস্কার প্রক্রিয়া যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে জাতীয় নির্বাচন যথাসময়ে আয়োজন করা যথাসময়ে সম্ভব নাও হতে পারে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সরকারের প্রভাব ও আধিপত্য নিরসনের লক্ষ্যে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের দাবি করেছেন। কেননা সরকারি দল স্থানীয় নির্বাচনে প্রভাব খাটিয়ে নির্বাচন দিয়ে মেম্বার, চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান ও মেয়রের পদ ভাগিয়ে নেয়। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যারা সরকারে এসেছে তারা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার জন্য আইন সংশোধন করে নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত¡াবধায়ক সরকারকে সংবিধান থেকে আইনের মাধ্যমে রহিত করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলো। কাজী হাবিবুল আউয়ালের স্বীকারোক্তির মাধ্যমে আওয়ামীলীগের ডামি নির্বাচনের কথা আবার প্রকাশ্যে আসলো। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন না থাকায় এবং সংস্কার প্রক্রিয়া ছাড়া নির্বাচন সম্পন্ন করার কারণে বারবার জনগণ প্রতারিত হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান এজেন্ডা ছিলো গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতা জনগণকে ফিরিয়ে দেয়া। সংস্কার কমিশনে এভাবে যদি দিনের পর দিন অনৈক্য চলমান থাকে তাহলে সংস্কার আদৌ হবে কিনা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন জনগণ আর মেনে নেবে না। জনগণ চায় ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা। ঘুষ, দুর্নীতিরোধে শক্তিশালী কমিশন। জনগণের প্রত্যাশা রাজনৈতিক দলগুলি প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে শিগগির ঐক্যমত্যে পৌঁছাবে। তা না হলে গণঅভ্যুত্থানের সফলতা বিফলে যাবে। আশা করি রাজনৈতিক দলগুলি ঐক্যমত্য কমিশনে নিজেরা ঐক্যমত পোষণ করবে। তাহলে দেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা। আশা করি রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে জনগণের স্বার্থে ঐক্যমতে পৌঁছাবে। জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিজেদের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচন করে সরকার গঠন করবে। যে সরকার হবে জনগণের সরকার। জন-আকাঙ্ক্ষার সরকার। আশা করি এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে রাজনৈতিক দলগুলি দ্রæত ঐক্যমতে পৌঁছে সংস্কার প্রক্রিয়া সফল করবে এবং যথাসময়ে কাক্সিক্ষত ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য সংস্কার কমিশনকে সহযোগিতা করা রাজনৈতিক দলগুলির অতীব প্রয়োজন। জন-আকাক্সক্ষার কথা মাথায় রেখে রাজনৈতিক দলগুলি যেন সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করে।
লেখক : প্রাবন্ধিক