এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে

1

দীর্ঘ দুই বছর প্রায় দেশের পণ্যবাজারে যে মূল্যস্ফীতি চলছিল তার লাগাম টানতে বিগত সরকার শেষ সময় পর্যন্ত চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান সরকার ৮মাসের মাথায় এসে কিছুটা দীর্ঘসময় ধরে চলতে থাকা উচ্চ মূল্যস্ফীতি অবশেষে নিম্নমুখী ধারায় ফিরেছে। সেইসাথে ভোক্তা সাধারণের ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে খরচও কমে আসছে। বর্তমানে শাক-সবজিসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের মূল্য বাজারের যে নিম্নমুখীতা এটি বাস্তবিকপক্ষে মূল্যস্ফীতির হ্রাসের প্রভাব, তবে ব্যয় কমলেও যেহেতু আয় বাড়েনি বরং আয় কমার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, তাই বাজারে এর প্রত্যাশিত প্রভাব নাও পড়তে পারে। গতকাল শুক্রবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত সংবাদে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)এর সূত্রে বলা হয়, গত ফেব্রুয়ারিতে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমেছে দশমিক ৬২ শতাংশ। অর্থাৎ মানুষের জীবনধারণের ব্যয় কিছুটা কমেছে। তবে একই সময়ে মানুষের আয়ও কমে গেছে। অর্থাৎ মানুষের ব্যয় কমার সঙ্গে সঙ্গে কমেছে আয়ও। ফলে মূল্যস্ফীতি কমলেও স্বস্তি ফিরছে না জনজীবনে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত মাসিক ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) তথ্য বিশ্লেষণে এমন চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার এ তথ্য প্রকাশ করেছে বিবিএস। সিপিআই সূচক অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে গড় মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ, যা জানুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। একই সঙ্গে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ হওয়ার অর্থ হলো, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে যদি বিভিন্ন ধরনের পণ্য ও সেবা কিনে সংসারের খরচ চালাতে ১০০ টাকা খরচ হয়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে একই পণ্য ও সেবা কিনে সংসার চালাতে খরচ লাগছে ১০৯ টাকা ৩২ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকায় খরচ বেড়েছে ৯ টাকা ৩২ পয়সা। এদিকে, ১০ মাস পর খাদ্য মূল্যস্ফীতি নেমেছে ১০ শতাংশের নিচে। বিবিএসের সর্বশেষ হিসাবে, গত ফেব্রুয়ারিতে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ হয়েছে, যা জানুয়ারিতে ছিল ১০ দশমিক ৭২ শতাংশ। অর্থাৎ মাসের ব্যবধানে খাদ্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমেছে প্রায় দেড় শতাংশ। এর আগে গত বছরের মার্চ মাসের পর খাদ্যের মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের ঘরে নামেনি। সীমিত আয়ের মানুষ এত দীর্ঘসময় ধরে ভোগান্তিতে পড়েননি। গত মার্চে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
বিবিএসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শীতের শাকসবজির দাম বেশ কম। চালের বাজারেও বেশি পরিবর্তন নেই। এসব কারণে ফেব্রুয়ারিতে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। মূলত খাদ্য পণ্যের দাম কমায় গড় মূল্যস্ফীতি কমেছে। তবে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি হার ছিল ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। গত জানুয়ারিতে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি একধরনের করের মতো। তাদের মতে, যাদের প্রতি মাসে আয়ের পুরোটাই সংসার চালাতে খরচ হয়ে যায়; কিন্তু হঠাৎ জিনিসপত্রের দাম বাড়লে এবং সে অনুযায়ী আয় না বাড়লে তাদের ধারদেনা করে সংসার চালাতে হবে কিংবা খাবার, কাপড়চোপড়, যাতায়াতসহ বিভিন্ন খাতে কাটছাঁট করতে হবে। মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধি বা আয় বৃদ্ধি কম হলে মানুষের কষ্ট বাড়ে। প্রকৃত আয় কমে যায়। এদিকে, দীর্ঘসময় ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমায় মানুষের ব্যয় কমেছে। এতে মূল্যস্ফীতির কারণে ভোগান্তিতে থাকা মানুষের জীবনে স্বস্তি ফেরার কথা। কিন্তু একই সময়ে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় আপাতত জনজীবনে সেই স্বস্তি ফিরছে না। কারণ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের কষ্টের সময়ে হঠাৎ দেশে গড় মজুরি বৃদ্ধির হার কমেছে। এমনিতে গত কয়েক বছর ধরে মানুষের আয়ের থেকে ব্যয় অনেক বেশি। অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতি কমার প্রবণতাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে মজুরি প্রবৃদ্ধি কমার প্রবণতা সীমিত আয়ের মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে বলে মনে করেন তারা। তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী এই ধারা অব্যাহত রাখতে আরও কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে বন্ধ শিল্প কারখানাগুলো পুনঃচালুর ব্যবস্থা করতে হবে, এতে বেকার হওয়া শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হলে আয়ের হিসেবে যোগ হবে। কর্মী ছাঁটাই বন্ধ করতে হবে, যেহেতু দেশে বিপুল সংখ্যক যুবক বেকার, এ মুহূর্তে যতবেশি কর্মসংস্থান করা যায়, ততই রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গল। এতে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পাশাপাশি মজুরি বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। না হলে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনধারণ অসহনীয় হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, সামনে বৈশাখ জৈষ্ঠ্য মাসের আগমন ঘটবে খড়া আর বৃষ্টিতে ফসলি জমির উৎপাদন কমে আসে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে অবস্থা আরো খারাপের দিকে যায়। তাই সরকারকে এখন থেকে প্রবৃদ্ধিও হার বাড়ানোর পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির ক্রমহ্রাসের এ ধারা অব্যাহত যেন থাকে সেই দিকে গভীর মনোযোগ দিতে হবে।