সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী
‘সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ’ ইসলামের একটি অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব। একটি মৌলিক স্তম্ভ এবং অনন্য বৈশিষ্ট্য। সংস্কার ও সংশোধনের বিশাল মাধ্যম। তার মাধ্যমে সত্যের জয় হয় এবং মিথ্যা ও বাতিল পরাভূত হয়। বিস্তার ঘটে শান্তি ও সমৃদ্ধির। বিস্তৃতি লাভ করে কল্যাণ ও ঈমান। যিনি আন্তরিকতা ও সততার সাথে এ দায়িত্ব পালন করেন তার জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার ও মর্যাদাপূর্ণ পারিতোষিক।
ইসলামের এই স্তম্ভটির প্রতি আমরা অবহেলা করছি। আমাদের সমাজে নির্বিচারে অন্যায়, জুলুম ও পাপকার্য সংঘটিত হচ্ছে কিন্তু আমরা নিরব। এখন আর আমাদের অনৈতিক কাজে কোন প্রতিক্রিয়া হয় না; বরং আমরা কেউ কেউ অন্যায় কাজের সহযোগিতা করছি বিভিন্নভাবে। অথচ অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করাও এক ধরনের জেহাদ।
মহান রাব্বুল আলামীন সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধের দায়িত্ব পালনকারীদের সফলকাম বলে আখ্যায়িত করে তাদের প্রশংসা এবং তাদের পরিণাম ও শেষ ফল সম্পর্কে বলেন, “আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে। আর তারাই সফল কাম। (আলে ইমরান : ১০৪)
আল্লাহ তা‘আলা উম্মতে মুহাম্মদিকে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলে সম্বোধন করেছেন পবিত্র কুরআনে। কারণ এই উম্মত সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ করে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, “তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। আর আহলে-কিতাবরা যদি ঈমান আনতো, তাহলে তা তাদের জন্য মঙ্গলকর হতো। তাদের মধ্যে কিছু তো রয়েছে ঈমানদার আর অধিকাংশই হলো পাপাচারী। (আলে ইমরান: ১১০)
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, সেই সত্ত¡ার কসম, যার হাতে আমার জীবন, তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ করবে আর মন্দকাজ থেকে বারণ করবে। যদি না কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের উপর শাস্তি পাঠাবেন। অত:পর তোমরা তাকে ডাকবে কিন্তু তোমাদের ডাকে সাড়া দেয়া হবে না। ( মিশকাত-৫১৪০)
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হন নি; বরং তাদের হেদায়াতের জন্য প্রেরণ করেছেন কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য নবী ও রাসূলকে। যাঁরা স্ব-স্ব জাতিকে সৎ ও কল্যাণকর কাজের প্রতি উৎসাহ যুগিয়েছেন এবং অসৎ ও অকল্যাণকর কাজ হতে নিষেধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, “নিশ্চয় আমি প্রত্যেক জাতির নিকট রাসুল প্রেরণ করেছি এ মর্মে যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং অপশক্তিকে পরিত্যাগ ও প্রতিহত করবে।”[নহল-৩৬]।
আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও একই উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়েছে। তাঁকে হেদায়াতের মশাল হিসেবে যে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন প্রদান করা হয়েছে তার এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো, মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আহবান করা, গোমরাহী থেকে হেদায়াতের দিকে এবং কুফরী হতে ঈমানের দিকে আহবান জানানো। আল্লাহ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে এরশাদ করেন, “আলিফ-লাম-রা, এ হচ্ছে কিতাব, আমি তোমার প্রতি তা নাযিল করেছি, যাতে আপনি মানুষকে তাদের রবের অনুমতিক্রমে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে ধাবিত করতে পারেন, এমন পথে যা প্রবল পরাক্রমশালী, প্রশংসিত রবের পথ।’’[ইবরাহীম-০১]
পৃথিবীতে মানুষ ধোঁকাপ্রবণ। দুনিয়ার চাকচিক্য ও মোহে পড়ে অনন্ত অসীম দয়ালু আল্লাহর কথা ভুলে যেতে পারে। সে জন্যে প্রত্যেক সৎকর্মপরায়ণের উচিৎ পরস্পর পরস্পরকে সদুপদেশ দেয়া, সৎকাজে উদ্বুদ্ধ করা এবং অসৎকাজে নিষেধ করা। মহান আল্লাহ ধমক দিয়ে বলেন, “হে মানুষ, কিসে তোমাকে তোমার মহান রব সম্পর্কে ধোঁকা দিয়েছে?”[ইনফিতার-৬]
পৃথিবীতে মানুষ নানা ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। আর তা থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উপায় হলো পারস্পরিক সৎ ও কল্যাণকর কাজে সহযোগিতা করা এবং অসৎ ও গুনাহের কাজে নিষেধ করা। এ মর্মে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, “তোমরা পুণ্য ও তাকওয়ার কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা কর এবং গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করো না।”[আল মায়েদা-০২]
আল্লাহ তা‘আলা আরো এরশাদ করেন, “সময়ের কসম, নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ততায় নিপতিত। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।” [অসর-১-৩]
সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য:
প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন এ গুণের পথিকৃত। তিনি নবুওয়ত প্রকাশের পূর্বে অন্যায়-অবিচার রুখতে হিলফুল ফুযুল গঠন করেন। মৌলিক মানবীয় সৎ গুণাবলী তাঁর চরিত্রে ফুটে উঠায় ছোটবেলা থেকেই তিনি ‘আল-আমিন’, ‘আস্ সাদিক’ উপাধিতে ভুষিত ছিলেন। তাঁর গুণাবলীর বর্ণনা দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, “তিনি সৎকাজের আদেশ করেন এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ করেন, মানবজাতির জন্য সকল উত্তম ও পবিত্র জিনিসগুলো বৈধ করেন এবং খারাপ বিষয়গুলো হারাম করেন।’’[আ’রাফ-১৫৭]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এরশাদ করেন, “আমি পবিত্র চরিত্রাবলীর পূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরিত হয়েছি।’’ [মুয়াত্তা ৫/২৫১]
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করা মুমিনের গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত :
সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজে বাধা দান মুমিনের অন্যতম দায়িত্ব। মুমিন নিজে কেবল সৎকাজ করবে না; বরং সকলকে সে কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস চালাতে হবে। কেননা, তারা পরস্পরের বন্ধু। অতএব একবন্ধু অপর বন্ধুর জন্য কল্যাণ ব্যতীত অন্য কিছু কামনা করতে পারে না। এ দিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, “মুমিন নারী ও পুরুষ তারা পরস্পরের বন্ধু। তারা একে অপরকে যাবতীয় ভাল কাজের নির্দেশ দেয়, অন্যায় ও পাপ কাজ হতে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে, যাকাত পরিশোধ করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে। তারা এমন লোক যাদের প্রতি অচিরেই আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে।’’ [তাওবাহ-৭১]
পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে মুমিনের অন্যতম চরিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে মুমিনের অন্যতম গুণ হিসেবে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের বিষয়টি বিশেষভাবে অবতারণা করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, “তারা তাওবাকারী, ইবাদাতকারী, আল্লাহর প্রশংসাকারী, রোযা পালনকারী, রুকূকারী, সিজ্দাকারী, সৎকাজের আদেশদাতা, অসৎকাজের নিষেধকারী এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা হেফাযতকারী। (হে আমার প্রিয় নবী) আপনি এসব মুমিনদের সুসংবাদ দিন।” [সূরা আত তাওবা:১১২।]
জাতিকে সৎকাজে আদেশ দান এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ করা ফরয-ই- কিফাইয়াহ :
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ হতে নিষেধ করা নির্দিষ্ট করে প্রত্যেকের উপর বর্তাবে না; বরং পবিত্র কুরআনের প্রমাণ অনুসারে সেটা ফরয-ই-কিফাইয়াহ। জিহাদও ঠিক অনুরূপভাবে ফরয-ই-কিফায়াহ। অতএব সেটার দায়িত্বশীল যখন সেটা সম্পাদনে ব্রতী হবে না, তখন সকল সামর্থ্যবান ব্যক্তিগণ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ঐ দায়িত্ব পালন না করার দোষে সমভাবে দোষী হবেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন: “তোমাদের মধ্য হতে এমন একটি জাতি হওয়া উচিত, যারা সকল ভাল তথা উত্তম বিষয়ের দিকে আহবান করবে, সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ করবে, আসলে তারাই হচ্ছে সফলকাম স¤প্রদায়।” (সূরা-আলে ইমরান:১০৪)
সুতরাং এটা স্পষ্টভাবেই বুঝা গেল যে, প্রতিটি মানুষের উপরই তার শক্তি-সামর্থ্যানুযায়ী ঐ দায়িত্ব বর্তাবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “তোমাদের মধ্যে যে কেউ একটি অসৎকাজ (হতে) দেখবে, সে যেন তাকে তার হাত দ্বারা প্রতিহত করে। তবে যদি সে ঐরূপ করতে অক্ষম হয়, তাহলে কথা দ্বারা যেন তাকে প্রতিহত করে, যদি এরপরও করতে অক্ষম হয়, তাহলে যেন অন্তর দিয়ে তাকে ঘৃণা করে। আর সেটা হবে সবচাইতে দুর্বল ঈমান।’’(মুসলিম, হা-৫০)
সৎকাজে আদেশ দান না করা এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ না করার পরিণতি ভয়াবহ :
যথাযত কর্তৃপক্ষ যদি দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ইসলামী দন্ডবিধি বাস্তবায়ন না করে, তাহলে সে সমাজের অবস্থা কেমন হবে, সে বিষয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন, “আল্লাহর দন্ডসমূহ বাস্তবায়নে অলসতাকারী এবং অপরাধী ব্যক্তির দৃষ্টান্ত ঐ লোকদের মত, যারা একটি জাহাজে আরোহণের জন্য লটারী করল। তাতে কেউ উপরে ও কেউ নীচতলায় বসল। নীচতলার যাত্রীরা উপরতলায় পানি নিতে আসে। তাতে তারা কষ্ট বোধ করে। তখন নীচতলার একজন কুড়াল দিয়ে পাটাতন কাটতে শুরু করল। উপরতলার লোকেরা এসে কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, উপরে পানি আনতে গেলে তোমরা কষ্ট বোধ কর। অথচ পানি আমাদের লাগবেই। এ সময় যদি উপরতলার লোকেরা তার হাত ধরে, তাহলে সেও বাঁচল এবং তারাও বাঁচল। আর যদি তাকে এভাবে ছেড়ে দেয়, তাহলে তারাও তাকে ধ্বংস করল এবং নিজেরাও ধ্বংস হল’। [মিশকাত হা/৫১৩৮]
তিনি আরও এরশাদ করেন, যখন লোকেরা কোন অন্যায় কাজ হতে দেখে তা পরিবর্তন করার চেষ্টা করে না, সত্বর আল্লাহ তা‘আলা তাদের সকলের উপর ব্যাপকভাবে শাস্তি নাযিল করবেনা [মিশকাত, হা-৫১৪২]
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়,
খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ