পূর্বদেশ ডেস্ক
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে সরকার গৃহীত কার্যক্রমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের টেকসই উন্নয়নের ‘থ্রি-জিরো’ তত্ত্ব যুক্ত করার চিন্তা করছে সরকার। সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে এই তত্তে¡র কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা সহজ হবে বলে মনে করছেন সরকারের নীতি-নির্ধারকরা। ‘থ্রি-জিরো তত্ত্ব’ আর্থিক স্বাধীনতা, কর্মঠ জনশক্তি তৈরি এবং পরিবেশ উন্নয়নে বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কার্যকর একটি মডেল। এটি একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সেগুলো হচ্ছে- জিরো দারিদ্র্য, জিরো বেকারত্ব ও জিরো নেট কার্বন নিঃসরণ। আর তা অর্জনে প্রয়োজন তারুণ্য, প্রযুক্তি, সুশাসন ও সামাজিক ব্যবসা। খবর বাসসের।
গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বজুড়ে আলাদা সম্মান পেয়েছেন তার এই থ্রি-জিরো তত্তে¡র জন্য।
এসডিজির লক্ষ্যসমূহের মূল পরিকল্পনায় রয়েছে- সকলের জন্য কল্যাণকর পৃথিবী এবং টেকসই ভবিষ্যৎ নিমার্ণ।
থ্রি জিরো তত্তে¡র বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মূখ্য সমন্বয়ক ও সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ বলেন, আমরা এজডিজির সঙ্গে থ্রি জিরো তত্ত্ব যুক্ত করার চেষ্টা করছি। এসডিজির ওপর সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে আমাদের একটি কর্মশালা চলছে, সেখানে এই তত্ত্বের বিষয়ে আলোচনা করছি। আমরা চাই টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে সকল পর্যায়ে থ্রি জিরো তত্তে¡র ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি হোক।
তিনি উল্লেখ করেন, এসডিজির লক্ষ্য পূরণের কার্যক্রমের মধ্যে থ্রি জিরো তত্ত¡ রাখা হয়েছে, তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস কারোর ওপর এই তত্তে¡র প্রয়োগ চাপিয়ে দিতে চান না। আমাদের উদ্দেশ্য হলো- যার ভালো লাগবে তিনি এটি গ্রহণ করবেন এবং কাজে লাগাবেন। এ কারণে এসডিজির বাইরে সরকারের কোনো বড় পর্যায়ে থ্রি জিরো তত্ত্ব নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
থ্রি-জিরো তত্ত্বের মূল ভিত্তি হলো- দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা। এই তত্তে¡র ব্যাপারে অধ্যাপক ইউনূসের ভাষ্য, বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিজেই দারিদ্র্য সৃষ্টি করে এবং এই ব্যবস্থার অধীনে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব নয়। মানুষ এককভাবে দারিদ্রতা তৈরি করে না, আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতরেই তৈরি হয় দারিদ্র্য।
তাঁর মতে, ভালো চাকরি না খোঁজে উদ্যোক্তা তৈরিতে জোর দিতে হবে। তিনি বিভিন্ন সময় তার বক্তব্যে বলেছেন, আমরা জন্মেছি সমস্যা সমাধানের জন্য, কারো অধীনে চাকরি করার জন্য নয়। তাই তরুণ প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হতে হবে। কারো অধীনে নয়, বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে হবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই।
সম্প্রতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে বাসযোগ্য নিরাপদ পৃথিবী ও নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে ‘থ্রি জিরো’ তত্ত্বকে বৃহৎ পরিসরে তুলে ধরেছেন অধ্যাপক ইউনূস।
তিনি সম্মেলনে নিজের ভাষণে এই তত্ত্ব উপস্থাপন করে বলেছেন, এটি এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেবে। গড়ে তুলবে এক নতুন পৃথিবী, যা সবার জন্য বাসযোগ্য হবে।
তিনি এও বলেছেন, এই তত্ত্ব প্রয়োগ করে জীবনশৈলী পাল্টানো সম্ভব। পরিবেশের নিরাপত্তার জন্যই দরকার এই নতুন জীবনধারা বা ‘লাইফস্টাইল’। সেই যাপন চাপিয়ে দেওয়া হবে না। তা পছন্দ করতে হবে। যুব সম্প্রদায় তা আনন্দের সঙ্গে ভালোবেসে গ্রহণ করবে। এভাবে যুবাসমাজের প্রত্যেকে নিজেদের ‘থ্রি জিরো পারসন’ হিসেবে গড়ে তুলবে।
‘থ্রি জিরো পারসন’ কেমন, তার ব্যাখ্যায় শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সেই ব্যক্তি কার্বন নিঃসরণ করবে না। অর্থাৎ সে হবে ‘জিরো কার্বন’। সে সম্পদের একক মজুতদার হবে না। তার সম্পদ হবে সামাজিক ব্যবসাভিত্তিক। অর্থাৎ সে হবে ‘জিরো দরিদ্র’ এবং এভাবেই তারা প্রত্যেকে উদ্যোগী হয়ে পূরণ করবে ‘জিরো বেকারত্বের’ তৃতীয় শর্ত। অর্থাৎ মুহাম্মদ ইউনূসের মতে, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বণ নিঃসরণ শূন্যে নামাতে পারলে দুশ্চিন্তামুক্ত ও বাসযোগ্য এক নতুন পৃথিবী গড়ে উঠবে।
থ্রি জিরো পারসন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে থ্রি জিরো ক্লাব বিশেষ ভূমিকা পালন করে বলে উল্লেখ করেন কর্মজীবনে অধ্যাপক ইউনূসের দীর্ঘদিনের সহকর্মী লামিয়া মোরশেদ। তিনি মনে করেন এই ক্লাবের সদস্যরা থ্রি জিরো তত্ত্ব সম্পর্কে সচেতন হন এবং একসময় নিজেরা থ্রি জিরো পারসন হিসেবে গড়ে ওঠেন।
ইউনূস সেন্টারের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা লামিয়া মোরশেদ বলেন, সারা পৃথিবীজুড়ে বর্তমানে প্রায় ৪ হাজার ৬০০টি থ্রি জিরো ক্লাব রয়েছে, যার প্রতিটি অধ্যাপক ইউনূসের নতুন সভ্যতার স্বপ্নে অনুপ্রাণিত। এসব ক্লাবের বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গড়ে উঠেছে।
বিশ্বের অসংখ্য বিভিন্ন নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে থ্রি জিরো ক্লাব গড়ে উঠলেও বাংলাদেশে এই ক্লাব সমানভাবে গড়ে উঠেনি। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী বা অন্য কোনো ব্যক্তির পক্ষে এই থ্রি জিরো ক্লাব তৈরির আগ্রহ দেখানোটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো। অধ্যাপক ইউনূসের থ্রি জিরো তত্তে¡র বিষয়ে সচেতনতা তৈরির কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করতে হয়েছে।
এ বিষয়ে লামিয়া মোরশেদ বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় বাংলাদেশে থ্রি জিরো ক্লাব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলো, এখন সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ায় দিন দিন এর পরিসর বাড়ছে। এখন অনেকে এগিয়ে আসছেন। বেশ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। ইদানিং থ্রি জিরো তত্ত্ব নিয়ে কর্মশালা অনেক বেড়ে গেছে। এটা কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ নয়, এটা যে যার অবস্থান থেকে নিজ উদ্যোগে করছেন। শুধু নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে তারা জানিয়ে দেন যে আমরা এটা করছি।’
তিনি জানান, থ্রি জিরো ক্লাব ইচ্ছে করলেই কেউ রেজিস্ট্রেশন করতে পারবে না এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় দেখা হয়। তারা যে কাজগুলো করছে সেগুলো গুরুত্ব সহকারে করছে কি-না এবং সেটি টেকসই কি-না, এসব দেখার পরেই রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়।
লামিয়া মোরশেদ মনে করেন নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের থ্রি জিরো তত্ত্বকে প্রকৃতপক্ষে কার্যকর করার ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, মাইক্রোক্রেডিট ও মাইক্রো ফাইন্যান্সের পর ড. ইউনূসের নবীন প্রোগ্রাম হলো সামাজিক ব্যবসা।এই ধারণার মূল বিষয় হলো একজন তার নিজের চাকরির ব্যবস্থা করবে পাশাপাশি অন্যদের চাকরির সুযোগ করে দিবে। অর্থাৎ আমি একটি ঋণ নিয়ে একটি কাজ শুরু করলাম যেখানে আরও তিন-পাঁচজন লোক কাজ করবে তাদের কর্মসংস্থান হবে। এই ব্যবসা থেকে যে মুনাফা আসবে তা জণকল্যাণে ব্যয় হবে।
এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আরও বলেন, অধ্যাপক ইউনূসের সামাজিক ব্যবসার মূল থিম হচ্ছে-এখান থেকে আমি কোনো লাভ করব না তবে আমার মূল টাকা ফেরত আসতে হবে। যাতে করে ওই অর্থ আবার অন্য আরেকটি সামাজিক কার্যক্রমে ব্যবহার করা যায। মুহাম্মদ ইউনূস আগে থেকেই বলতেন মাইক্রোক্রেডিটের সঙ্গে সামাজিক কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। সামাজিক কার্যক্রম মনকে অনেক তৃপ্তি দেয়, কারণ এতে মানুষ অনেক উপকৃত হয়।
তিনি জানান, বিশ্বের ৩৯টি দেশের ১১০টা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার রয়েছে। যেখানে মাইক্রোক্রেডিটের বিজনেস গুলো শিখানো হয়। তাদের আগ্রহে থ্রি জিরো ক্লাব তৈরি হচ্ছে। এ ক্লাবের মূল লক্ষ্য হলো শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন নিঃসরণ অর্জন করা।
লামিয়া মোরশেদ জানান, আগামী জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিতব্য যুব সম্মেলনে (ইয়ুথ ফেস্টিভ্যাল) থ্রি জিরো বিষয়টা রাখা হবে। খেলাধুলা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিনোদনের অংশ হিসেবে কাজ করে, এটাকে কিভাবে সামাজিক কার্যক্রমের অংশ বানানো যায়, সেটা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। একটা টুর্নামেন্টে অনেক মানুষ অংশগ্রহণ করে, সেখানে যদি আমরা একটি থিম দেয় যে আমরা জিরো ওয়েস্ট এর দিকে এগিয়ে যাবো, আমরা প্লাস্টিক ব্যবহার করব না, আমরা রাস্তায় ময়লা ফেলবো না। এই বিষয়ে যদি আমরা সচেতনতা তৈরি করতে পারি তাহলে সমাজে অনেক বড় পরিবর্তন আসবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের থ্রি জিরো তত্ত্ব পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন কমনওয়েলথ সচিবালয়ের আন্তর্জাতিক ট্রেড বিভাগের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং গবেষণা সংস্থা র্যাপিড এর চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক।
তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়নের সব সূচকে অভীষ্ট অর্জনের ক্ষেত্রে ‘থ্রি জিরো থিউরি’ অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস। তিনি মনে করেন থ্রি জিরো তত্ত্বের ধারণা বাংলাদেশে তরুণদের ক্ষমতায়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে কৃষিসহ অন্যান্য খাতে একটি নতুন বিপ্লব ঘটানোর সম্ভাবনা রাখে। আমাদের দেশে উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না, অথচ উদ্যোক্তা বিকাশ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন কোনভাবে সম্ভব নয়।’
ড. রাজ্জাক বলেন, থ্রি জিরো তত্ত¡ কাজে লাগানো গেলে দেশে সর্বস্তরে উদ্যোক্তা গড়ে উঠবে এবং অর্থনীতির কাক্সিক্ষত উন্নয়ন অর্জন করা যাবে।