এলো ফিরে মায়ের কোলে মায়ের দুলাল

1

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

আমার কোন কোন লেখায় আমি সরকারের সমালোচনা করি বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে আমি পক্ষেই লিখে থাকি। যে কাজের জন্য সরকার সমালোচনার সম্মুখীন হতে পারে, সেটাই আমি সরকারকে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। আমার মনে হচ্ছে সরকারকে অজনপ্রিয় করার জন্য কেউ সুকৌশলে ভুল পথে পরিচালনা করছে এবং ভ্রমাত্মক কাজ করতে সরকারকে ইন্ধন যোগাচ্ছে। আমি সরকারের ভালো চাই, মঙ্গল চাই, সরকার সফলকাম হোক, মনে প্রাণে তাই কামনা করি। আমি কেন সরকারের কল্যাণ কামনা করি তার গৃঢ় কারণ হলো, আমাদের চট্টগ্রামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমান সরকারের প্রধান। তিনি যথার্থই একজন ভালো মানুষ। তাঁর ট্র্যাক রেকর্ডে চোখ বুলালেই দেখা যাবে, তাঁর জীবনে কোনো দীনতা বা মলিনতা নেই। তিনি একটি ভরপুর সফল জীবনের সুনিপুণ নির্মাতা। তাঁর জীবনে সাফল্যই প্রধান, ব্যর্থতা প্রায় নেই বললেই চলে। ড. ইউনূসই প্রথম ব্যক্তি, যিনি চট্টগ্রাম থেকে দেশের সরকার প্রধান হলেন।
ড. ইউনূস আমার লেখা পড়েন কিনা জানি না, তাঁর কাছে আমার এসব ছাইপাশ লেখা আদৌ পৌঁছে কি না তাও জানি না। কিন্তু তা সত্তে¡ও তাঁকে সফল দেখার মনোকামনা আমি পরিত্যাগ করবো না।
শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট, দুর্নীতিবাজ এবং তিনি প্রশাসনে দলীয়করণ ও আত্মীয়করণ করেছিলেন, এমন অভিযোগে যখন তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, তখন জাতি ড. ইউনূসের ওপর বাজি ধরে। শেখ হাসিনার শাসনকালে মির্জা ফখরুল, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর রায়, বরকতউল্লাহ বুলু, জয়নাল আবেদীন ফারুক, রহুল কবির রিজভীসহ বিএনপি ও ছাত্রদল নেতৃবৃন্দকে বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে বারবার গ্রেফতার, সাজা দিয়ে হয়রানি এবং সভা-সমাবেশের ওপর পুলিশের বাধা, দলীয় সন্ত্রাসীদের আক্রমণের কারণে বিএনপি সুষ্ঠুভাবে রাজনীত করতে পারেনি; সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করে গণতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত করা হয়েছিলো, স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ ছিলো না, এক শ্রেণির সাংবাদিকের সরকারের সঙ্গে বেশি মাখামাখির কারণে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছিলো- এমনি নানা অভিযোগ এনে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে এবং তিনি দেশান্তরী হওয়ার পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। সেই সরকারেই বয়স এখন ৯ মাস চলে গেছে।
উপদেষ্টা পরিষদের ৯ মাস মেয়াদ অতিবাহিত হওয়ার পর এখন কী বলা যায়, শেখ হাসিনার শাসনকালের বিপরীত দৃশ্য দেখা যাচ্ছে দেশে? সত্যের খাতিরে বলতে হয়, ‘না’। কিন্তু সত্য হলেও কথাটা লিখতে আমার হৃৎকম্প হয়ে গেছে। কারণ এটাকে সরকারের সমালোচনা ধরে যদি আমার নামেও মামলা টুকে দেওয়া হয় কিংবা ঘাড় ধরে গরাদের আড়ালে চালান দেয়া হয়। আমার স্ত্রী, যিনি আমার অকৃত্রিম শুভাকাক্সক্ষী এবং আমার অসুস্থ শরীরে লেখালেখির ধকল নেয়ার কারণে সব সময় উৎকণ্ঠিত চিত্তে আমার পাশে থেকে আমাকে এসব লেখায় বাধা প্রদান করেন এবং সতর্ক করে দেন আমি যেন সরকারের বিরুদ্ধে কিছু না লিখি। আমার যারা শুভাকাক্সক্ষী, তাঁরাও আমাকে বলেছেন, লেখালেখিটা আপাতত বন্ধ রাখার জন্য, উপদেশ দেন একদম চুপ করে যান, লো প্রোফাইল মেইনটেইন করুন। সেইজন্য আমার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে গেল।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে মামলা হচ্ছে, তাঁদেরকে গ্রেফতার করে জেল ভর্তি করা হচ্ছে, এ নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। তাঁরা নিরপরাধ হলে খালাস পাবেন, দোষ করলে শাস্তি পাবেন। আওয়ামী লীগ যেমন খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, ফখরুল, লুৎফুজ্জামান বাবর, গিয়াসউদ্দিন আল মামুনদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছিলো এবং কাউকে কাউকে সাজাও দিয়েছিলো, ঠিক একই কায়দায় বিএনপি সমর্থিত মামলা করেছে এবং করছে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ সেলিম, ওবায়দুল কাদের, হাছান মাহমুদ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, ডা. দীপু মণি, মাহবুবুল আলম হানিফ-দের বিরুদ্ধে মামলা করেছে করছে। এ সম্পর্কে কি বলব, আওয়ামী লীগের কার্যক্রমই তো নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, এমনকি আইনজীবীদের বিরুদ্ধেও মামলা হচ্ছে। সে সম্পর্কে আমার কিছু বলার আছে।
কোন কোন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ঋণখেলাপ, ব্যাংকে লুটপাট, বিদেশে অর্থ পাচার ইত্যাদি অভিযোগ রয়েছে; কিন্তু পিএইচপি’র চেয়ারম্যান জনাব সুফি মিজানুর রহমান, যাঁর জীবন খোলা বইয়ের মতো ধবধবে সাদা পাতা, যিনি সর্বগুণে গুণান্বিত একজন মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে কেন মামলা হলো ? ঋণ খেলাপী নন তিনি, ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে তিনি এতই নিয়মানুগ, সৎ ও বিশ্বস্ত যে ব্যাংকই তাঁর পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়ায় লোন দেয়ার জন্য। তিনি কোন ব্যাংকের টাকা হাতাননি, মানি লন্ডারিংয়েরও কোন অভিযোগ নেই তাঁর বিরুদ্ধে। তার পরেও এমন নিষ্কলঙ্ক মানুষটিকে আর কিছু না পেয়ে শেখ হাসিনার ডাকা একটি ব্যবসায়িক সম্মেলনে উপস্থিতির তথ্য হাজির করে তাঁকে ২০১ জনের সঙ্গে মামলায় জড়ানো হয়েছে। তিনি ইতিমধ্যে জামিন হয়ে গেছেন, কিন্তু তাঁর যে সম্মান ক্ষুণ্ণ করা হলো, তাঁর সুউচ্চ ভাবমূর্তি নষ্ট করে মাটিতে নামিয়ে আনা হলো, তা কি পুনরুদ্ধার করা যাবে বা আদৌ তা সম্ভব হবে কি না আমি জানি না ? তিনি কার কী অপরাধ করেছেন যে, তাঁকে এভাবে বেআব্রু করে অপদস্থ করা হলো ?
চট্টগ্রামের আরো একজন বড় ব্যবসায়ী এবং চিটাগাং চেম্বারের সভাপতি, যিনি পরে এফবিসিসিআই সভাপতি পদেও নির্বাচিত হন, তিনিও সম্ভবত সরকারের ওয়ান্টেড লিস্টে আছেন, সেজন্য সরকার পরিবর্তনের পর থেকে তাঁকেও দেখা যাচ্ছে না। তাঁর অপরাধ সম্ভবত এই যে তাঁর এফবিসিসিআই’র সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পিছনে শেখ হাসিনার প্রচ্ছন্ন আশির্বাদ এবং পূর্বে যে ব্যবসায়িক সম্মেলনের কথা বলা হলো, সেখানে তিনিও উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তব্য রেখেছেন। এছাড়া মাহবুবুল আলমের আর কোন দোষ নেই, তিনিও একজন পরিচ্ছন্ন, উজ্জ্বল ভাবমূর্তি সম্পন্ন মানুষ। শুধু তাই নয়, তিনি একজন মার্জিত স্বভাবের উন্নত রুচির ভালো মানুষ।
পতিত স্বৈরাচারের দোসর, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা, কর্মীদের গ্রেফতার, হুলিয়া, তল্লাশির যে হয়রানিমূলক কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে, সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না, তাদের সাফাইও গাইতে চাই না। ক্ষমতায় থাকাকালে তারা যা করেছেন, এখন তার ফল ভোগ করছেন। সাংবাদিক শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমানকে হয়রানি করা হয়েছে, এখন আওয়ামীপন্থী বলে পরিচিত সাংবাদিকদেরও একই কায়দায় হয়রানি করা হচ্ছে। মিডিয়ার মুখে কুলুপ, এত কিছুু ঘটছে প্রতিদিন কিন্তু মিডিয়ায় তার কোন প্রতিফলন নেই, কারণ সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে মিডিয়া কিছু লিখছে না, তা প্রচার করছে না। আওয়ামী লীগ আমলে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, নিউ এজ প্রয়োজনীয় সময়ে সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করতে তাদের সাহসের অভাব হয়নি। এখন কি প্রিন্ট মিডিয়া কি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াভুক্ত নিউজ পেপার এবং টিভি চ্যানেলগুলো ভয়ে, আতংকে এমন কুঁকড়ে আছে যে, সরকারের জন্য নেতিবাচক বিবেচিত হতে পারে এমন কোন সংবাদ, প্রতিবেদন প্রকাশ, প্রচার করতে তারা সাহস পায় না। শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমানদের আওয়ামী লীগ শাসনামলে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, এখন তাদের সমর্থনপুষ্ট সরকারের আমলে সহযোগী সাংবাদিকরা যেন অনুরূপ পরিস্থিতির শিকার না হয়, সেটা তাদেরই খেয়াল রাখা দরকার। আওয়ামী লীগ ছিলো খারাপ, মনে করা হয় হেন কোন অন্যায় নেই যা আওয়ামী লীগ করেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ করলে খারাপ, অন্যেরা করলে ভালো-এটা তো ঠিক কথা হতে পারে না। যে কাজ আওয়ামী লীগের জন্য খারাপ, আপনার জন্যও তা খারাপ। আওয়ামী লীগ খারাপ করেছে, সেজন্য মানুষ আওয়ামী লীগের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দলটিকে শাস্তি দিয়েছে। আপনারা কেন ভালো কাজ করবেন না? তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন ? সরকার খারাপ করছে তেমন কিছু বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। আমি তা বলছিও না। তবে বিজিত শক্তিকে নিপীড়নের পরিবর্তে পোষ মানানোর পথ অবলম্বন করা যেতে পারে কি না, সেটা ভেবে দেখতে ক্ষতি নেই। জিয়া, এরশাদের পথ অনুসরণ করে বিরুদ্ধ শক্তিকে বশীভূত করার চেষ্টা করা যেতে পারে। এটা আমার বুঝ, আমার বুঝা ভুলও হতে পারে। আমার কথা সঠিক তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। কাজেই আমি যা বললাম তা যদি মনঃপুত না হয়, যে পথে চলছে সরকার সে পথেই চলবে, কার কি বলার আছে।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক