এলো খুশির ঈদ

13

আবু তালেব বেলাল

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।/ তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ/ দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ…’
কালের পরিক্রমায় আবারও ফিরে এলো মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদ উল ফিতর। এক মাসব্যাপী কঠোর সিয়াম-সাধনা শেষে এক মহাআনন্দের বার্তা নিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমান পবিত্র ঈদ উল ফিতরকে উদযাপন করবে। আজ ২৯ রমজান। বাংলাদেশের পশ্চিমাকাশে আজ শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেলে কাল ঈদ উদযাপন হবে, অন্যথায় ৩০ রোজা শেষে বৃহস্পতিবার পবিত্র ঈদ উল ফিতর উদযাপন করা হবে। তবে দেশের কোন কোন এলাকায় সৌদি আরবের হিসেবে রোজা ও ঈদ উদযাপন করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তত্ত¡াবধানে চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে দেশের সিংহভাগ মুসলমান রোজা ও ঈদ পালন করে থাকেন। যেভাবেই হোক, ঈদের আমেজ শুরু হয়ে গেছে। চারদিকে আনন্দের বান ডেকেছে। পবিত্র ঈদের পর ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ, নববর্ষ উদ্যাপন করবে বাঙালি।
ঈদ উল ফিতর উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ বাণী দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাণীতে দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘ঈদ শান্তি, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের অনুপম শিক্ষা দেয়। হিংসা ও হানাহানি ভুলে মানুষ সাম্য, মৈত্রী ও স¤প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ঈদ ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের জীবনে আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। বিশ্বের সকল মানুষের সুখ-শান্তি, কল্যাণ ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি হোক-আজকের দিনে আমি মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে এই প্রার্থনা করি। আগামী দিনগুলো সত্য ও সুন্দর হোক। হাসি-খুশি ও ঈদের অনাবিল আনন্দে প্রতিটি মানুষের জীবন পূর্ণতায় ভরে উঠুক। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, সংযম, সৌহার্দ্য ও স¤প্রীতির মেলবন্ধন পরিব্যাপ্তি লাভ করুক এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা’।
ঈদ এবং ঈদের আগে পরে মিলে শুক্রবার ও শনিবার সাপ্তাহিক বন্ধসহ ৫ দিন সরকারি ছুটি রয়েছে। এসময় পত্রিকা অফিস বন্ধ থাকবে ৬দিন। দীর্ঘ এ ছুটি উৎসবপ্রিয় বাঙালি জাতির জন্য বড় প্রাপ্তি। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহরগুলোর দুই কোটির অধিক মানুষ জন্মভিটেয় ফিরছে। পরমাত্মীয়দের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগির মাধ্যমে রয়েছে আলাদা অনুভূতি ও আবেগ। প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের কারণে ঈদযাত্রায় এবার অন্যন্য সময়ের মত বিড়ম্বনার খবর তেমনটি পাওয়া না গেলেও শুরুতে রেলযাত্রায় বিড়ম্বনা সেই আগের মতই। যদিও আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে বিড়ম্বনা একটু কম, কিন্তু লোকাল ট্রেনে যাত্রীর ভিড় এতবেশি যে, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ট্রেন চালাতে হচ্ছে। এরপরও কোনরকম দূর্ঘটনা ছাড়া মানুষ নড়ির বুকে ঈদ করুক, আর উৎসব শেষে কোনোরকম বিড়ম্বনা ছাড়াই নগরে ফিরুক এমনটি প্রত্যাশা সকলের।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ঘোষণা অনুযায়ী দেশে প্রধান ঈদ জামাত হবে বায়তুল মোকররম জাতীয় মসজিদে। বেসরকারিভাবে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও সোলাকিয়ায় বৃহত্তর ঈদ জামাত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় প্রধান ঈদের জামাত হবে নগরীর দামপাড়াস্থ জমিয়তুল ফালাহ্ জামে মসজিদে।
সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, এবারও মসজিদের সন্মূখস্থ উন্মুুক্ত মাঠে বা ঈদগাহে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রথম জামাত হবে সকাল ৮ টায় এবং দ্বিতীয় জামাত হবে সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে।
অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ঈদ জামাত কমিটির উদ্যোগে এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে যথারীতি ঈদের নামাজের আয়োজন করেছে। দ্বিতীয় বৃহত্তর জামাত হবে নগরীর আন্দকিল্লা শাহী জামে মসজিদে। ঈদ উল ফিতর উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ সকল ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এ উপলক্ষে ব্যাপক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ঈদের সার্বজনীনতার মধ্যে যে নির্মল খুশীর আবেদন রয়েছে। দেশবাসী ঠিক আগের মতই ঈদের আনন্দে মাতবে। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর প্রতিটি জাতির জীবনেই উৎসব রয়েছে। কিন্তু মুসলমানদের আনন্দ উৎসব পৃথিবীর অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠি-ধর্মের উৎসবের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। ইসলাম প্রবর্তিত আনন্দ-উৎসব ইহকালীন ও পরকালীন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মুসলমানদের ঈদ নিছক উৎসবই নয় বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতও বটে। এটিই ইসলামের সৌন্দর্য। মুসলমানদের ঈদের ইহকালীন তাৎপর্য হলো, রমজান শেষে সাদাকাতুল ফিতর দিয়ে অসহায়-গরীবদের আর্থিক সহায়তার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। অস্বচ্ছল পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে বা কর্মহীনদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে দুু’টি ঈদ যথেষ্ট ভ‚মিকা রাখে। এছাড়া রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে বিত্তবানরা যাকাতও দিয়ে থাকেন এ মাসে। যদিও যাকাতের জন্য ঈদ বা রোজা শর্ত নয়, এরপরও ঈদকে সামনে রেখে রমজানে রোজায় যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সমাজের বড় একটি দরিদ্র অংশকে আর্থিক সক্ষমতার সুযোগ করে দেয়া এবং ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমান বাজারমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদির কারণে মানুষের আর্থিক যে অসংগতি তাতে ফিতরা ও যাকাতের আদায়ের বিষয়টির প্রাসঙ্গিকতা আরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
ঈদের পরকালীন গুরুত্ব হলো, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রমজান মাসকে বিভিন্ন ধরনের নিয়ামতে ভরপুর করেছেন। এ মাসেই মহাগ্রন্থ আল কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। দিনে রোজা রাখার এবং রাত্রিকালীন ইবাদতের মধ্যে অনেক ফজিলতের কথা বিধৃত হয়েছে। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাধ্যমে পুরো রমজান মাসটিকে আবৃত্ত করা হয়েছে। লাইলাতুল কদর নামক হাজার রাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ একটি মহিমান্বিত রাত দান করা হয়েছে এ মাসে। পাপ মোচনের এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক সুবর্ণ সুযোগ এসে যায় রমজান মাসে। এ সমস্ত নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ আনন্দ উৎসবের ব্যবস্থাটাই হলো ঈদ। রোজাদারদের জন্য রমজানের দুটি নিয়মতের কথা মহান আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন, একটি ইফতারের সময় আরেকটি মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর রোজা ভাঙ্গার পরপর ঈদের নামাজ। যা পরকালীন মুক্তির অন্যতম নিয়ামক।
কাজেই ঈদ নিছক আনন্দ উৎসব নয়, এটি একটি তাৎপর্যমন্ডিত ইবাদত এবং সে কারণেই ঈদের রাতে এবং ঈদের দিনের অনেক পূণ্যের কথা বর্ণিত হয়েছে হাদিসে। হাদিসে এ রাতকে শ্রেষ্ঠ পঞ্চরজনীর অন্যতম বলা হয়েছে। সুতরাং নিয়মবদ্ধ সাধনার পর মুক্ত সাধনায় ধাবিত হবার ক্ষণটিই ঈদ। এ ঈদকে পুলক আনন্দে উদযাপন করব সবাই মিলে। যেখানে ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের ভোদাভেদ থাকবে না। ঈদ মোবারক।