মনিরুল ইসলাম মুন্না
নগরীর প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে পরীক্ষামূলক যানবাহন চলাচল করলেও এক মাসের মধ্যেই এটি সম্পূর্ণরূপে চালু করা হবে। একইসাথে সীমিত পরিসরে আদায় করা হবে টোলও। এতে ফিরে আসবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের শৃঙ্খলা। গতকাল সোমবার পূর্বদেশকে এ তথ্য জানান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম।
তিনি পূর্বদেশকে বলেন, আমরা এক মাসের মধ্যে এক্সপ্রেসওয়ের কার্যক্রম চালু করে দিবো। আশা করি ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে চালু করতে পারবো। আমরা প্রাথমিকভাবে সীমিত আকারে টোল কালেকশন করবো আর টোল কালেকশন হবে নামার সময়। যাতে মূল সড়কে যানজট তৈরি না হয়। পতেঙ্গার দিকে নামার সময় এবং টাইগারপাসে নামার সময় টোল বুথ বসানো থাকবে।
এদিকে গত ৮ নভেম্বর মধ্যরাতে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় নিহত হন দুই মোটরসাইকেল আরোহী মো. মোক্তার (২৮) ও মো. রুবেল হোসেন (৩৬)। তারা পেশায় ট্রাকচালক হলেও শখের বসে মোটরসাইকেল প্রতিযোগিতায় মেতেছেন। বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানোর কারনে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ দুর্ঘটনার সময় তাদের মোটরসাইকেলের গতি ছিল ১০০ কিলোমিটারের বেশি।
শুধু মোটরসাইকেল চালানোর প্রতিযোগিতা নয়, কেউ কেউ প্রাইভেটকার প্রতিযোগিতায় মেতেছেন। এতে ঘটছে দুর্ঘটনা। এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৬০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হলেও, তা মানছেন না চালকরা। সেই সঙ্গে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ছিনতাইকারীর আনাগোনা। সবমিলিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়ার আগেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ২৮ আগস্ট থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। প্রায় ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়েতে নেই প্রশাসনের নিরাপত্তাবলয়। ফলে রাত নামলেই এক্সপ্রেসওয়ে চলে যায় অপরাধীদের দখলে। যানবাহন চলাচলে মানা হচ্ছে না গতিসীমা। এ অবস্থায় যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে স্পিড ক্যামেরা লাগানোর কথা ভাবছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। নির্ধারিত ৬০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে যানবাহন চালালে তখন জরিমানা করা হবে।
টোলের বিষয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগের প্রস্তাব অনুযায়ী এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলাচল করলে কার ১০০ টাকা, জিপ ১০০ টাকা, মাইক্রোবাস ১০০ টাকা, মিনিবাস ২০০ টাকা, বাস ৩০০ টাকা, ট্রাক (চার চাকা) ২০০ টাকা করে টোল দিতে হবে। তবে উড়াল সড়কে চলবে না মোটরসাইকেল, ট্রাক (৬ চাকা) এবং কাভার্ড ভ্যান। প্রায় ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে, ৫৪ ফুট প্রশস্ত এবং চার লেনের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ১৫টি র্যাম্পের মধ্যে আপাতত ৯টি র্যাম্প নির্মাণ করবে সিডিএ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৭ সালে একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার সময় নির্ধারণ করা হয়। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণ কাজের উদ্বোধন হলেও ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০২২ সালে নকশা সংশোধন করে আরও এক হাজার ৪৮ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরপরও কাজ শেষ না হওয়ায় সর্বশেষ প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। এই সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ পুরো শেষ করা যাবে কি না তা নিয়ে এখনও সন্দেহ আছে।
দুর্ঘটনারোধে গাড়ির গতি কমানোর বিকল্প নেই জানিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘গত ২৮ আগস্ট থেকে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে পরীক্ষামূলক যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। গাড়িগুলো লালখান বাজার হয়ে পতেঙ্গা প্রান্তে ওঠানামা করতে পারছে। র্যাম্প নির্মাণের কাজ চলমান আছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহন চলাচলের গতি নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ কিলোমিটার। তবে অনেকে তা মানছেন না। গত শুক্রবার দুর্ঘটনাকবলিত মোটরসাইকেলের গতি ছিল ১০০-১২০ কিলোমিটারের মধ্যে। বেপরোয়া গতির কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনা এড়াতে চালকদের সচেতন হতে হবে।’
এক্সপ্রেসওয়েতে সব লাইট বসানো সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘নতুন করে টোলের হার নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পর টোল আদায়ে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হবে। এরপর যানবাহন থেকে টোল আদায় করা হবে। বর্তমানে চলাচলকারী যানবাহন থেকে কোনও টোল আদায় করা হচ্ছে না।’
পতেঙ্গা এলাকার বাসিন্দা মো. মুছা বলেন, ‘এমন কিছু ছিনতাইকারী আছে, যারা এক্সপ্রেসওয়েতে ফাঁদ পেতে থাকে। গভীর রাতে কোনো গাড়ি চলাচল করলেই কৌশলে তাদের অবরূদ্ধ করে সবকিছু হাতিয়ে নেয়। আবার রাত নামলেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে তরুণদের মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এজন্য শুরুতেই ঘটছে দুর্ঘটনা। শুধু যে গাড়ি চালানোর প্রতিযোগিতা চলছে তা কিন্তু নয়, নানা কৌশলে সক্রিয় হয়ে উঠেছে অপরাধী চক্র।
এর আগে গত ২৬ অক্টোবর বিকালে এক্সপ্রেসওয়ের দেওয়ানহাট-আগ্রাবাদ অংশে দুর্বৃত্তের টানানো সুতার ফাঁদে পড়ে গুরুতর আহত হন সুজন তঞ্চঙ্গা নামের এক যুবক। সুজন বলেন, ‘আমরা দুজন এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে মোটরসাইকেলে পতেঙ্গায় যাচ্ছিলাম। চলন্ত অবস্থায় দেওয়ানহাট-আগ্রাবাদের মধ্যবর্তী অংশে আমার গলায় কিছু একটা আটকে যায়। একপ্রকার দম বন্ধ হয়ে আমার বাইকটি নিয়ে সড়কে পড়ে যাই। এতে আমার হাত-পাসহ পুরো শরীরে আঘাত পাই। নিচে পড়ে যাওয়ার পর ১৬-১৭ বছরের দুই কিশোর আমাদের দিকে আসছিল। তবে বিপরীত দিক থেকে আরও কয়েকটি গাড়ি আসার কারণে পেছনের দিকে চলে যায় তারা।’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশানর (গণমাধ্যম) কামী মো. তারেক আজিজ পূর্বদেশকে বলেন, ‘অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও গোয়েন্দারা সর্বদা তৎপর রয়েছে। ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। ইতঃপূর্বে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। প্রতিটি ফ্লাইওভার ও নবনির্মিত এক্সপ্রেসওয়েতে পুলিশ নিয়মিত রোস্টারিং করে টহল দিচ্ছে। বিশেষ করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চারটি থানা যৌথভাবে ভাগে ভাগে টহল দিচ্ছে। সন্দেহজনক চালকদের বা বাইকারদের নিয়মিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এছাড়া কোনো ভুক্তভোগী যদি অভিযোগ দায়ের করে, সাথে সাথে মামলা নেয়া হবে। এমনকি ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হবে।’
অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম পূর্বদেশকে আরও বলেন, আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশকে চিঠি দিয়েছি। তারা অপরাধের বিষয়টি দেখভাল করবেন। তাছাড়া ১৫টি র্যাম্পের মধ্যে প্রাথমিকভাবে ৯টি র্যাম্পের কাজ করা হবে। তার মধ্যে জিইসি র্যাম্পটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাকি র্যাম্পগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। তবে ৬টি র্যাম্পের কাজ আপাতত করা হবে না। পরবর্তীতে প্রয়োজন দেখা দিলে তখন নির্মাণ করা হবে।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নগরের লালখানবাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৫৪ ফুট প্রস্থের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালুর কথা ছিল ২০২০ সালের জুনে। পরে তা পরিবর্তন করে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে আরও এক বছর সময় বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই গত বছরের ১৪ নভেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এত বছরেও নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় এর সুফল পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।