মনিরুল ইসলাম মুন্না
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখায় ঘুষ বাণিজ্য, চেক না দেয়াসহ নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে চার সার্ভেয়ার এবং ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তার (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম পূর্বদেশকে বলেন, জেলা প্রশাসনের প্রত্যেকটি শাখায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমান কর্মস্থলে কর্মকাল তিন বছর অতিক্রম করেছে এমন ২৫ জন ইউনিয়ন ভ‚মি সহকারী কর্মকর্তা ও ৭৮ জন ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তাকে উন্মুক্ত লটারির মাধ্যমে পদায়ন করা হয়েছে। আর এলএ শাখা নিয়ে শুধু চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনে নয়, সারাদেশের প্রত্যেক জেলা প্রশাসনে অভিযোগ রয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার বিষয়ে বলতে গেলে, আমার ক্ষমতা অনুযায়ী জেলার মধ্যে বদলি করতে পারি। তবে বিভাগীয় কমিশনার স্যার যদি চান, উনি বিভাগের মধ্যে যেকোনো জায়গায় বদলি করতে পারেন। এরপরও আমি এলএ শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি করবো। ইতোমধ্যে সাতজন সার্ভেয়ারের মধ্যে তিনজনের বদলি করেছি। বাকিদেরও পর্যায়ক্রমে করা হবে। সম্প্রতি বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার দুর্নীতি নিয়ে একটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। অভিযোগটি প্রদান করেন মো. ইসমাইল হোসেন নামের এক ব্যক্তি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন পূর্বদেশকে বলেন, অভিযোগটি তদন্তে দেয়া হয়েছে। তদন্তে যদি সত্যতা পাওয়া যায়, তবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অভিযোগে বলা হয়, ‘চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভ‚মি অধিগ্রহণ শাখায় দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত সার্ভেয়ার আব্দুল মোমিন, রফিকুল ইসলাম, ইমাম হোসেন গাজী, মাহবুব হাসান দীপু এবং সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা) মো. আবু রায়হানের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে অফিসে আসা সেবাগ্রহীতারা অতিষ্ঠ। একই সাথে হাটহাজারী-অক্সিজেন সম্প্রসারণ প্রকল্প, বাকলিয়া-কালুরঘাট বেড়িব্াধ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল সড়ক সম্প্রসারণ, কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদ ও বিভিন্ন প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে চেক বিতরণের নামে সিন্ডিকেটগুলো কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
ভূমি অধিগ্রহণের (এলএ শাখায়) শাখায় এখনও টাকা উত্তোলনে দালাল এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শরণাপন্ন হতে হয়। অথচ ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ পেতে দালাল ধরবেন না, প্রতারিত হবেন না এই লেখাটি দেয়ালে লেখা থাকলেও বাস্তবে কোন কার্যকর নেই বললেই চলে। হরিলুট চলছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখায়। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জিম্মি করে লুটপাটের এ মহোৎসবে মেতে উঠেছেন কানুনগো, সার্ভেয়ার, সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এছাড়া লুটপাটের অংশীদার হিসেবে বহিরাগতদের নিয়ে এলএ শাখার কর্মকর্তারা তৈরি করেছেন সংঘবদ্ধ দালালচক্র। এলএ শাখা ঘিরে ভ‚ক্তভোগীদের অভিযোগ রয়েছে অহরহ, বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসব বিষয় জেনেও না জানার মতো রহস্যজনকভাবে নীরব ভ‚মিকা পালন করে আসছেন।
এলএ শাখার সকল প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়া এখন নিত্যদিনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘুষ না দিলে ফাইল নড়ে না এখানে, প্রতি টেবিলে টেবিলে আলোচনার ঝড় উঠে ঘুষ বাণিজ্য নিয়ে। অভিযোগ আছে, সার্ভেয়ারদের মাধ্যমেই ভূমি মালিকদের নাম ঠিকানা দালালদের দেওয়া হয়, এছাড়া স্বচ্ছতা আনতে লোক দেখানো এলএ শাখায় বসানো হয়েছে ছয়টি ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা। তারপরও ওখানে দালালদের তৎপরতা দেখা যায় চোখে পড়ার মতো।
বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ভূমির অবকাঠামোগত অবস্থান নির্ণয়ের জরিপ, জমি অধিগ্রহণের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের জমির মূল্য নির্ধারণ এবং চেক প্রদানের সময়ই মূলত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লুটপাটে জড়িয়ে পড়েন। অহেতুক হয়রানি করা হয় ক্ষতিগ্রস্তদের, এ থেকে পরিত্রাণ পেতেই অনেকেই তাদের উৎকোচ দিতে বাধ্য করা হয়। উৎকোচ না দিলে বিভিন্ন মামলায় ফাইল আটকে দেওয়া হয়। এলএ শাখার অধীনে এসব হরিলুটের জন্য কাজ করে শক্তিশালী কয়েকটি সিন্ডিকেট। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মোটা অংকের ভাগ দিয়ে এসব কাজ করেন দালাল ও সার্ভেয়াররা।’
অভিযোগের বিষয়ে সার্ভেয়ারদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো সাড়া দেননি। তবে অভিযুক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) মো. আবু রায়হান পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি কোনো অপকর্মের সাথে জড়িত নই। আমার বিরুদ্ধে যা বলা হচ্ছে, তা ষড়যন্ত্র। এল এ শাখা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে। আর আমি শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলবো না যে, এখানে দুর্নীতি হয় না। আমি যোগদান করেছি আড়াই মাস আগে। এখানে সার্ভেয়ারদের মধ্যে গ্রুপিং রয়েছে। তারা একজন অপরজনের বিরুদ্ধে নানা জায়গায় অভিযোগ দিচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে, সবগুলোই ভিত্তিহীন। বিশেষভাবে কোনো কেইস অভিযোগে উল্লেখ করে না। তা নাহলে আমরাও বুঝতে পারি না, কোথায় বা কোন মামলার চেক আটকে আছে। তাছাড়া আমাদেরকে স্পেসিফিক না বললে তো বুঝতে পারবো না। কিছুদিন আগে তিন জনের চেক আটকে রেখেছিলাম। হয়তো তারাই এসব অভিযোগ দিচ্ছেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উল্লেখিত চারজন সার্ভেয়ারের স্ত্রী, সন্তান, পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের নামে-বেনামে তাদের নিজ গ্রামে এবং চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ। অভিযুক্ত সার্ভেয়ারদের ইতোপূর্বে একাধিকবার বিভিন্ন অফিসে বদলি করা হলেও জেলা প্রশাসক পরিবর্তন হওয়া মাত্র তদবিরের মাধ্যমে তারা পুনরায় এলএ শাখায় চলে আসেন। দীর্ঘদিন যাবত চট্টগ্রাম ভ‚মি অধিগ্রহণ শাখায় চাকরি করার সুবাদে অফিসে একচ্ছত্র আধিপত্য ও কু-প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে অফিসের অন্যান্য কর্মচারীদেরও নানাভাবে জিম্মি করে রেখেছেন প্রভাবশালী ওই চারজন সার্ভেয়ার।
বেশ কয়েকজন আইনজীবীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, সার্ভেয়ারদের সহযোগিতায় দালালচক্রের সদস্যরা অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে অধিগ্রহণকৃত জমির দাগের পার্শ্ববর্তী তৃতীয় পক্ষের কোনো লোকজনকে দিয়ে সিভিল মামলা অথবা আপত্তি দাখিলের মাধ্যমে নিজেদের সৃষ্ট জটিলতার অজুহাত দিয়ে মোটা অংকের কমিশন দাবি করেন। পরে তাদের সৃষ্ট জটিলতা এলএওকে (ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা) ম্যানেজ করে সুরাহার নামে আবেদনকারীর নিকট থেকে নগদ, আবার কখনও ব্যাংক চেকের মাধ্যমে কমিশনের টাকা আদায় করেন। কাক্সিক্ষত কমিশনের ঘুষের টাকা না পেলে, তারা আবেদনকারীর ফাইলে চেক প্রাপ্তির রিপোর্ট প্রস্তুত না করে মাসের পর মাস হয়রানি করেন। এলএ মামলার আবেদনকারীকে ওই সার্ভেয়াররা তাদের মনোনিত দালালদের মাধ্যমে অফিসে যোগাযোগ করতে বলেন। এলএ মামলার চেক প্রত্যাশী ও আবেদনকারীগণ দীর্ঘদিন যাবত ওই সার্ভেয়ারদের হাতে জিম্মি। তাছাড়া এলএ শাখার চিহ্নিত দালালদের সঙ্গে অফিস চলাকালীন সময়ে এবং অফিসের বাহিরে বিভিন্ন অভিজাত হোটেল-রেস্তোরাঁয় রাতে সার্ভেয়ারদের গভীর সখ্যতা দেখা যায়।
বিগত দিনের এলএ চেক সংক্রান্ত নানা অপকর্মের কারণে তাদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা আদালতে বিচার প্রার্থীও হয়েছেন। চট্টগ্রামের সিএমএম আদালতে কয়েকজন সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধে একাধিক ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন থাকলেও অদৃশ্য খুঁটির জোরে তারা এখনও সপদে বহাল তবিয়তে। কোনো প্রকার বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না অভিযুক্ত সার্ভেয়ারদের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এস এম দিদার উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, ‘সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প করতে গিয়ে যদি সাধারণ জনগণের ভ‚মি অধিগ্রহণ করা হয় অথবা কোনো স্থাপনা থাকায় ক্ষতিগ্রস্তের শিকার হয় তাহলে রাষ্ট্র বিধি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। রাষ্ট্রের মালিক জণগণ হওয়া সত্বেও যদি এরকম কোনো হেনস্তার শিকার হতে হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট বিধি অনুযায়ী যাদের বিরুদ্ধে সুর্নিদিষ্ট অভিযোগ থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক ব্যবস্থা নেওয়া রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে।’