এবার সমৃদ্ধ দেশ গড়ার শপথ নিন

1

কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি স্বাধীন হয়, বিজয়ের পতাকা উড়ে ১৯৭১ সালে। লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বিসর্জনের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করি। বিজয়ের এই দিনে মুক্তির উল্লাসে মেতেছিল এ দেশের কোটি কোটি জনতা। আসলে স্বাধীনতা এমনই। আমরা অল্প সময়ে যেভাবে সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল একটি ঘটনা।
এবার ২০২৪ এর জুলাইয়ে দেশের ইতিহাসে যুক্ত হয়েছে নতুন পালক। তীব্র ছাত্র-গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট, সোমবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর নতুন অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। শুরুটা সরকারি চাকুরিতে কোটা সংষ্কারের আন্দোলন হলেও পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ বহু ছাত্র মারা গেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রূপ নেয় তীব্র গণ আন্দোলনে। দেশজুড়ে বিপুল সংখ্যক ছাত্র, শিশু, নারী ও সাধারন মানুষ নিহত হলে ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠে। দেশেবিদেশে নিন্দার ঝড় উঠে। দেশের এই ক্রান্তিকালে আবারো এগিয়ে আসে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। ছাত্র আন্দোলনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ, আমাদের চট্টগ্রামের কৃতিসন্তান, আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে এই সরকারের প্রধান হিসেবে মনোনীত করা হয়। গত আগস্টের ৮ তারিখ বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গবভনে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। দেশের এমন পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এবারের বিজয় দিবস নতুন মাত্রা পেয়েছে। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় মানুষ একতাবদ্ধ হয়েছে। কারো খবরদারি আর নাক গলানোর সুযোগ মনে হয় আর নেই।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের পর নিজের ভাষায় কথা বলা, মুক্তভাবে চলাফেরা, চাকরি-বাকরিতে নিজেদের লোক নিয়োগ, পারস্পরিক আবেগ-অনূভূতি প্রকাশ, পারস্পরিক সৌহার্দ প্রকাশ, ভোটাধিকার প্রয়োগ, স্বাধীন মত প্রকাশসহ সবক্ষেত্রে স্বাধীনতার সুফল পরিলক্ষিত হয়। যদিও নানা সময় মানুষের অধিকারকে হরণ করার চেষ্টাও হয়। এরপরও এই যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি কষ্ট করে তা ধরে রাখতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। স্বাধীনতার যে লক্ষ্য ছিল তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বর্তমান অবস্থানে এসেছে প্রিয় স্বদেশ। স্বাধীনতার যে স্বপ্ন ছিল তা কতটুকু অর্জিত হয়েছে সে তুলনা করলে আরো বহুদূর পথ পেরোতে হবে। স্বাধীনতার পর থেকে সময়ে সময়ে নানা সংকটে পতিত হয়েছিল আমাদের এই মাতৃভূমি। কিন্তু সব সংকট মোকাবেলা করে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে এখনো তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে টিকে আছে। ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান এদেশের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করোছে।
বিগত বছরগুলোতে উন্নতি যতটুকু হবার কথা ছিল তা কিন্তু হয়নি। এর জন্য দায়ী আমাদের মাঝে বিদ্যমান পারস্পরিক অবিশ্বাস ও প্রতিহিংসা। পৃথিবীর অনেক দেশ যেমন মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, ভিয়েতনাম আমাদের চেয়ে তেমন উন্নত ছিল না। ক্ষেত্র বিশেষে আমাদের চেয়েও খারাপ অবস্থানে ছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ঐ সব দেশ আজ বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পেরেছে। এসব সম্ভব হয়েছে সেসব দেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকার কারণে। রাজনৈতিক বিভক্তি থাকলেও ঐ দেশগুলো উন্নয়নের প্রশ্নে আপোষ করেনি কখনোই। পায়ে ঠেলেছে বিভক্তি আর মতপার্থক্যকে। আমরাও আমাদের দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলতে পারি। এজন্য প্রয়োজন সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা যা এবারের গণঅভ্যুত্থানের কারণে সেই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যে যাই বলুক আমাদের একথা স্বীকার করতেই হবে যে, প্রতিহিংসার বৃত্ত থেকে আমরা বের হতে পারিনি। পারিনি দোষারোপের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে। সন্ত্রাস, খুন, গুম, ছিনতাই, রাহাজানি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনিয়মসহ নানা কুকীর্তির কারণে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অপরাধীদের প্রতিরোধ এবং বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা রোধ ও দ্রুত রায় কার্যকরের উদ্যোগ নিতে হবে।
উন্নয়নের পাশাপাশি দারিদ্র বিমোচনের জন্য নিতে হবে মহা পরিকল্পনা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে খবর নিলে বহু দরিদ্র মানুষের খোঁজ পাওয়া যাবে। হয়তো যাদের পাশে কেউ নেই। দুঃখ, কষ্টে জীবন চলছে। মানুষের দরিদ্রাবস্থা দূর করতে না পারলে লক্ষ্য পূরণ হবেনা। আগে দরিদ্র মানুষের জীবন মানের উন্নতি ঘটাতে হবে। বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের সব স্তরে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি দূর করতে হবে। সব ধরনের নিয়োগ, ভর্তির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নৈতিক চরিত্র গঠন উপযোগী ও আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক তথা বাস্তবভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার ও মৌলিক অধিকার পাওয়া সুনিশ্চিত করতে হবে। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে হবে। সব ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যেন দুর্নীতি জেঁকে বসে থাকতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। আর্থিক অস্বচ্ছতা ও অপচয় দেশের সমৃদ্ধি এবং উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশের কোন বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে আমাদের সকলকে সচেতন থাকতে হবে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে কাজ করতে হবে সবাইকে। রাজনীতিতে সহাবস্থান নিশ্চিত করে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। সাধারণ মানুষের সুখ, শান্তি নিশ্চিত করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনসমূহ এসব বিষয়ে সুপারিশ করবে বলে বিশ্বাস করি। দেশের চিকিৎসাব্যবস্থাকে আধুনিক ও বিশ্বমানে নিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। চিকিৎসার জন্য ভারত বা অন্যদেশের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। পোষাক শিল্প ও আইসিটি খাতের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়নের জন্য আমরা এক হতে পারি না। একে অন্যেরটা সহ্য করতে পারি না। দলাদলি আর রাজনৈতিক সংকট আমাদের দেশটাকে কুঁড়েকুঁড়ে খেয়েছে। আর নয় পারষ্পরিক দ্ব›দ্ব এবার নতুন বাংলাদেশ গড়ার শপথ নিতে হবে।
দেশটা সুন্দর হোক, সমৃদ্ধশালী হোক এটাই আমাদের চাওয়া। সব ভেদাভেদ ভুলে গড়তে হবে সমৃদ্ধ একটি দেশ বাংলাদেশ। আসুন, সকলে মিলে এবারের বিজয়ের মাসে নতুনভাবে সেই সমৃদ্ধ দেশ গড়ার শপথ নিই।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট