এম এ হোসাইন
নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল, এমন অভিযোগ করে আসছিলেন ‘পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম’। প্রকল্পের শুরু থেকে নানা বিষয়ে বিরোধীতা করে আসছে সংগঠনটি। এবার এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের জিইসি র্যাম্প ‘নির্মাণ বন্ধের’ দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। যদিও প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এই র্যাম্পের বিশেষ গুরুত্ব দেখছে। যার কারণে ইতিমধ্যে এই র্যাম্পের কাজ অনেক এগিয়ে নিয়েছে। শেষ সময়ে এসে জিইসি র্যাম্প বন্ধের দাবি নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
চট্টগ্রামের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য ১৬ কিলোমিটার। উড়াল সড়কটি বিমানবন্দর এলাকা থেকে শুরু হয়ে ইপিজেড-বন্দর-বারেকবিল্ডিং-চৌমুহনী হয়ে দেওয়ানহাট রেলসেতুর পশ্চিম পাশ দিয়ে পাহাড় ঘেঁষে টাইগার পাস মোড়ের পর মূল সড়কের ওপর দিয়ে লালখান বাজার মোড় পেরিয়ে ওয়াসার মোড়ে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে গিয়ে মিলবে।
ইতোমধ্যে এক্সপ্রেসওয়ের মূল কাঠামোর কাজ শেষ হয়েছে। কয়েকটি র্যাম্প নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে। কাজ চলমান থাকা জিইসি র্যাম্প নির্মাণ নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। যদিও সিডিএ আগে থেকেই এ বিতর্কের অনুমান করেছে।
দুই সপ্তাহ আগে র্যাম্প সম্পর্কে সিডিএ চেয়ারম্যান নুরুল করিম বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ১৫টি র্যাম্প ছিল। কিছু বাদ দিয়েছি, চাইলে করা যাবে সে ব্যবস্থা আছে। জিইসি র্যাম্প করতেই হবে। এই র্যাম্প না হওয়ার ব্যাপারে একটি গ্রুপ আছে। তারা নানাভাবে চায়, জিইসি র্যাম্প বন্ধ করতে। এই র্যাম্প খুবই জরুরি। জ্যাম না হয় এমন প্ল্যান করেই র্যাম্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
শুরু থেকেই নানা বাধার মুখে পড়তে হয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প। নানা কারণে প্রকল্পে সময় দীর্ঘায়িত হয়েছে। প্রকল্পের কাজ শুরুর পর চট্টগ্রাম বন্দরের আপত্তি, জমি অধিগ্রহণের জন্য অপেক্ষা, ট্রাফিক বিভাগের অনুমতি না পাওয়া, লালখান বাজার অংশের নকশা নিয়ে আপত্তি, করোনাকালীন কাজে ধীরগতি, বিকল্প সড়ক চালু করতে দেরি এবং সবশেষ বন্দর সংলগ্ন এলাকায় নকশা পরিবর্তনসহ নানা কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হয়।
এ অবস্থার মধ্যে জিইসি র্যাম্প নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। জিইসি র্যাম্প তৈরি হলে নগরে যানজট বাাড়বে এমনটা মনে করছেন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম। গতকাল শনিবার সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে জিইসি র্যাম্প নির্মাণ বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
সংগঠনের সহ সভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, বিগত সরকারের আমলে চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, যার মধ্যে অন্যতম লালখানবাজার-পতেঙ্গা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। শুরু থেকেই বিতর্কিত এই প্রকল্পটি বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্টজনদের মতামত এবং জনস্বার্থ উপেক্ষা করে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থে বাস্তবায়ন করা হয়। পরিবর্তিত সময়ে এই এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প স্থাপন নিয়েও বিতর্ক কম হয়নি। সবশেষে বিতর্কিত বেশ কয়েকটি র্যাম্প প্রকল্প থেকে সাময়িক বাদ দেওয়া হলেও বাওয়া স্কুল ও জিইসি জংশনের মাঝে হোটেল পেনিনসুলার সামনে থেকে প্রস্তাবিত র্যাম্পটি বাদ দেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, ‘অপরিকল্পিত ও ব্যক্তিস্বার্থে’ গৃহীত এই র্যাম্পের বিরুদ্ধে সচেতন নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিরা প্রতিবাদ করার পরও এর নির্মাণকাজ বন্ধ করা হয়নি। বরং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রæতগতিতে নির্মাণ করা হচ্ছে। আমরা জানতে চাই, কেন তা বন্ধ করা হচ্ছে না? কার স্বার্থে? ব্যক্তিস্বার্থে নয়, জনস্বার্থে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে কার্যকর করতে জিইসি র্যাম্প নির্মাণ বন্ধ করতে হবে।
সুভাষ চন্দ্র বলেন, বাওয়া স্কুল ও জিইসি জংশনের মাঝে যে র্যাম্প নির্মাণের কাজ চলছে জনস্বার্থে তা বন্ধ করা অপরিহার্য। কারণ, এই জায়গা এমনিতেই অত্যন্ত যানজট প্রবণ এলাকা। প্রতিদিন এখানে সকাল থেকেই রাত ৯-১০টা পর্যন্ত যানজট লেগে থাকে। এখানে নতুন র্যাম্প করলে মূল সড়কের প্রশস্ততা কমে গিয়ে জিইসি জংশনের যানজট বেড়ে যাবে। পাশাপাশি এম এম আলী সড়ক জংশন, ওয়াসা এবং লালখান বাজার মোড়ে যানজটের তীব্রতা বেড়ে যাবে।
যে সকল জায়গায় র্যাম্প বানানো হচ্ছে, সেখানে নিচের মূল সড়কের প্রশস্ততা কমে যাওয়ায় ভবিষ্যতে অগ্রাধিকার ভিত্তিক গণপরিবহন সিস্টেম বা র্যাপিড বাস ট্রানজিট চালু করা কঠিন হবে এবং বন্দরের ভারী যানবাহন চলচলেও প্রচÐ বাধা সৃষ্টি করবে বলে মত দেন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সচেতন ফোরামের সদস্যরা।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ফোরামের সভাপতি প্রফেসর মুহাম্মদ সিকান্দার খান, প্রকৌশলী এবিএমএ বাসেত, স্থপতি আহমেদ জিন্নুর চৌধুরী, প্রফেসর ড. মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন, প্রফেসর ড. শফিক হায়দার চৌধুরী, প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম ও পরিবেশবিদ তসলিমা মুনা।
উল্লেখ্য, নগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ উড়াল সড়ক নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে একনেকে অনুমোদন হওয়ার সময় ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি তিন বছরের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। পরে ২০২২ সালে নকশা ‘সংশোধন’ করে আরও এক হাজার ৪৮ কোটি টাকা (আগের ব্যয়ের চেয়ে ৩২ শতাংশ) ব্যয় বাড়িয়ে মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এক্সপ্রেসওয়েটি প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে করার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল গত সরকারের আমলে। আগষ্ট পরবর্তী সময়ে নতুন করে নাম পরিবর্তনের দাবিও উঠেছে।