নিজস্ব প্রতিবেদক
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান বলেছেন, নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ও চিটাগং কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেয়ার কথাটা বিভ্রান্তিকর। এ দুটি টার্মিনালের মালিকানা আমরা কাউকে দিয়ে দিচ্ছি না, মালিকানা আমাদেরই থাকছে, শুধুমাত্র টার্মিনালের অপারেটর নিয়োগ করছি। তা বন্দরের জন্য লাভজনক হবে কিনা এবং এর ফলে বাংলাদেশের বন্দর পরিচালনার দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে কিনা তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ট্রানজেকশন এডভাইজার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। গতকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বন্দরের শহীদ ফজলুর রহমান মুন্সি মিলনায়তনে ১৩৮তম বন্দর দিবস উপলক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
বন্দরের চেয়ারম্যান বলেন, বে-টার্মিনালের কন্টেইনার টার্মিনাল-১ এবং কন্টেইনার টার্মিনাল-২ নির্মাণের জন্য পিপিপি অংশীদার পিএসএ সিঙ্গাপুর এবং ডিপি ওয়ার্ল্ডের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। গত ২০ এপ্রিল বে-টার্মিনালের ডিপিপি একনেকে অনুমোদিত হয়েছে। এছাড়া, গতকাল বে-টার্মিনালের চ্যানেলে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণের লক্ষ্যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল প্রকল্প আগামী ২০২৯-২০৩০ সালের মধ্যে সমাপ্ত করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে আমরা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় টার্মিনাল অপারেটর এপিএম এর সাথে সরকারি-বেসরকারি অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। এ লক্ষ্যে নিয়োজিত ট্রানজেকশন এডভাইজার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আশা করা যায় আগামী ছয় মাসের মধ্যে কনসেশন চুক্তি করা সম্ভব হবে।
মাতারবাড়ীকে দেশীয় অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির গেম চেঞ্জার খ্যাত মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পটির প্যাকেজ-১ (২টি জেটি নির্মাণ) এর জন্য জাপানিজ প্রতিষ্ঠান পেন্টা ওশান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ও টোয়া কর্পোরেশনের সাথে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চুক্তি স্বাক্ষর গত ২২ এপ্রিল সম্পন্ন হয়েছে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর ২০২৯ সাল নাগাদ অপারেশনে আসবে বলে আশা করা যায়। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরকে রিজিওনাল ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসাবে রূপ দেয়ার লক্ষ্যে বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসাবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে।
মাতারবাড়ী প্রকল্প নিয়ে চেয়ারম্যান এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসাবে জাইকার সহযোগিতায় বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পটির ২য় সংশোধিত ডিপিপি গত বছরের ৭ অক্টোবর একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন প্যাকেজের আওতায় সিভিল, ড্রেজিং, কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি এবং জাহাজসমূহ ক্রয় কার্যক্রম প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি ক্রয় চুক্তি ইতোমধ্যে সম্পাদিত হয়েছে। সিভিল ও ড্রেজিং কার্যক্রমের চুক্তি অতি শিগগিরই সম্পাদিত হবে এবং নির্মাণ কার্যক্রম অতিদ্রæত শুরু করা হবে।
চেয়ারম্যান বলেন, স¤প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান ও সিঙ্গাপুরের প্রতিনিধি দল মাতারবাড়ি-মহেশখালী এলাকা পরিদর্শন করে মেরিটাইম অবকাঠামো, নিরাপত্তা, পরিবেশ সংরক্ষণ, শিপইয়ার্ড নির্মাণসহ নানা খাতে বিনিয়োগ সম্ভাবনা যাচাই করেছে। এছাড়া, ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন’-এ মাতারবাড়ি ঘিরে ‘ফ্রি ট্রেড জোন’ গড়ে তোলার প্রস্তাব আলোচনায় আসে, যেখানে ডিপি ওয়ার্ল্ডের কারিগরি সহায়তায় আবুধাবীর জেবেল আলী বন্দর মডেলে নতুন অঞ্চল গড়ার চিন্তা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) ৩৭ হাজার ১৯১.৩২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যা ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০.৬৩ শতাংশ বেশি। রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশ পণ্য বন্দরের মাধ্যমে পরিবহন হয়েছে। চলতি বছরের মার্চে রপ্তানি আয় গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ১১.৪৪ শতাংশ বেড়েছে।
এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, বর্তমানে বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থান সময় উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে। কন্টেইনার জাহাজ বহির্নোঙরে আসার এক থেকে দুদিনের মধ্যে জেটিতে ভিড়ছে। ক্ষেত্রবিশেষে অন-অ্যারাইভাল জেটিতে ভিড়ছে। বন্দরে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) কন্টেইনার পরিবহন ২০২৩-২০২৪-এর একই সময়ের তুলনায় ৫.০১ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে জেনারেল কার্গো পরিবহন হয়েছে ৯ কোটি ৭১ লাখ ১৩ হাজার ১৬১ মেট্রিক টন; যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫.৯৬ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে জাহাজ যাতায়াত করেছে তিন হাজার ৫৮টি।
মতবিনিময় সভায় জানানো হয়, বন্দরের সংরক্ষিত এলাকায় ডেলিভারি না যাওয়ায় শেড ও ইয়ার্ডে লোহার বাক্স, রাসায়নিক পণ্য এবং কন্টেইনার দীর্ঘদিন পড়েছিল। এই জাতীয় পণ্য বন্দরের জন্য ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠে এবং স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। এ পর্যন্ত ৩৬৭ বাক্স ৬১৭ টিইইউএস কন্টেইনার ধ্বংস করা হয় এবং ৩৫৭ বাক্স ৬৪০ টিইইউএস কন্টেইনার অপসারণ করা হয়। এ ছাড়া গত গত ২৪ ডিসেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বন্দর পরিদর্শন করেন। তার নির্দেশে তাৎক্ষণিকভাবে শেডের মাঠ থেকে নিলাম যোগ্য ৩০৪টি গাড়ি সরানো হয়। গাড়িগুলো বর্তমানে বন্দরের বহুতল কার শেডে রয়েছে। কাস্টমস কর্তৃক গাড়িসমূহ নিলামের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। ওই স্থানে ইয়ার্ড নির্মাণ করে কন্টেইনার ধারণক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
এসময় চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, কাউসার রশিদ, ক্যাপ্টেন আমিন আব্দুল্লাহ ও বন্দর সচিব ওমর ফারুকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।