এনসিটি টার্মিনাল রাজস্ব আয়ের বড় উৎস, বিদেশিদের দেয়া যাবে না

4

মুহাম্মদ আজাদ

এনসিটি পরিচালনার ভার বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকার কোনোভাবেই নিতে পারে না। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের দেওয়া, জাতীয় স্বার্থের পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত এবং এই সিদ্ধান্ত কেবল জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত একটি রাজনৈতিক সরকারই নিতে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এর মাধ্যমে আমদানি-রফতানির ৯২ শতাংশ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। এনসিটি টার্মিনাল বর্তমানে বন্দরের সর্বোচ্চ রাজস্ব আয়ের উৎস। এই স্বয়ংসম্পূর্ণ টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হলে তা হবে জাতীয় অর্থনীতির ওপর সরাসরি আঘাত। প্রায় ২০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এনসিটি থেকে গত অর্থবছরে ১৩৬৭ কোটি টাকা আয় হয়েছে। বন্দরের মোট হ্যান্ডলিংয়ের ৫৫ শতাংশ হয় এই টার্মিনালে। এখানে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত আছেন, যাদের জীবিকার নিরাপত্তা এই টার্মিনালের সঙ্গে জড়িত। সাবেক সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এনসিটি টার্মিনাল বিদেশিদের কাছে হস্তান্তরের পেছনে সক্রিয় ছিলেন। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে, শেখ পরিবারের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে। পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানির কাছে তুলে দেওয়ার মতো চক্রান্তের পুনরাবৃত্তি এনসিটির ক্ষেত্রেও হচ্ছে। অথচ এনসিটি এখনো লাভজনক, প্রযুক্তিনির্ভর ও উন্নত একটি টার্মিনাল। নতুন কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই এটি পরিচালনা সম্ভব।
এনসিটি নিয়ে উত্তাল চট্টগ্রাম। এর প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বন্দরের ভেতরে-বাইরে চলছে নানা কর্মসূচি। বিক্ষোভের এই দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। এ নিয়ে উত্তপ্ত দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনও। অভিজ্ঞ মহল বলছে, বিদেশিদের হাতে এনসিটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা উচিত অন্তর্বর্তী সরকারের। যদি সরকার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে তবে এনসিটি ইস্যুতে নিশ্চিতভাবেই অস্থির হবে দেশের রাজনীতির মাঠ।
আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখেই গত ১৭ বছর ধরে এটি পরিচালনা করছে দেশের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০০৭ সালে যেখানে জাহাজের গড় অবস্থানকাল ছিল ১০ থেকে ১২ দিন, এখন সেটি ২ থেকে আড়াই দিন। ২০২২- ২৩ অর্থবছরে এনসিটি থেকে খরচ বাদে আয় হয়েছে ৫৭৪ কোটি টাকা। এরপরও বিদেশিদের হাতে এনসিটি তুলে দেওয়ার খবরে ক্ষোভে ফুঁসছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দেশের রাজনীতিবিদরাও। বিশ্বের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ‘গ্যান্ট্রি ক্রেন’ ব্যবহার করে জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর কাজ চলে এনসিটিতে। এখানে ১২টি গ্যান্ট্রি ক্রেনের প্রয়োজন হলেও রয়েছে ১৪টি। পাশাপাশি রয়েছে ৩৩টি রাবার টায়ার গ্যান্ট্রি ক্রেন, যেগুলোর কার্যক্ষমতা রয়েছে অন্তত ২০ বছর। টার্মিনালটির বার্ষিক সক্ষমতা অন্তত ১০ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং। যদিও গত বছর ১২ লাখ ৮১ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখেই দক্ষতার সঙ্গে গত ১৭ বছর ধরে এটি পরিচালনা করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান।
২০২৩ সালের মার্চে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার কমিটিতে এনসিটিকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয়। ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার হিসেবে নিয়োগ পায় ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে হালের অন্তর্র্বতী সরকারও। প্রক্রিয়া চলছে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম টার্মিনাল অপারেটর সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডকে পিপিপি ভিত্তিতে জিটুজি চুক্তিতে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার।
এনসিটি টার্মিনালটির শুরুর ডিজাইন অনুযায়ী ধারণক্ষমতা ছিল ১ দশমিক ১ মিলিয়ন টিইইউএস। কিন্তু বর্তমানে দক্ষ জনবল এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনার কারণে এটি ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন টিইইউএস হ্যান্ডেল করছে। ২০০৭ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে মোট ১ কোটি ২৩ লাখ ৯৭ হাজার ২০১ টিইইউএস কনটেইনার এবং ৮ হাজার ৭৯১টি জাহাজ হ্যান্ডেল করা হয়েছে। ২০০৭ সালে জাহাজের গড় অবস্থানকাল ১০ থেকে ১২ দিন থাকলেও এখন সেটি কমে হয়েছে মাত্র ২ থেকে আড়াই দিন! এতে কমে গেছে আমদানি ও রপ্তানির খরচ।
চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে চারটি কনটেইনার টার্মিনাল চালু রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় হাজার মিটার দীর্ঘ নিউমুরিং টার্মিনাল সবচেয়ে বড়। এটি একসঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ এবং একটি অভ্যন্তরীণ নৌযান হ্যান্ডেল করতে পারে। গতবছর বন্দরের মোট কনটেইনারের ৪৪ শতাংশ ওঠানো-নামানো হয়েছে এই টার্মিনাল দিয়ে। বাকি তিনটি টার্মিনালের মধ্যে নিউমুরিংয়ের পাশের চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনালে (সিসিটি) হয়েছে ১৯ শতাংশ এবং জেনারেল কার্গো বার্থে (জিসিবি) হয়েছে ৩৭ শতাংশ হ্যান্ডেলিং। এছাড়া সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালের হাতে দেওয়া পতেঙ্গা টার্মিনাল গত বছরের জুনে চালু হলেও এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি।
এদিকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে এনসিটি যাওয়ার সম্ভাবনার বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠেছেন শ্রমিক-কর্মচারী এবং বিভিন্ন সংগঠন। নিয়মিত বিরতিতে চলছে বিক্ষোভ, প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার হাতে আন্দোলন। আন্দোলনকারীদের দাবি, টার্মিনালটিতে রয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও আন্তর্জাতিক মানের সক্ষমতা, তাই এটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে দেওয়া অনুচিত। তারা আরও বলছেন, প্রতিযোগিতার বাজারে উন্নত সেবা নিশ্চিতের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন হলে, তা নতুন বে টার্মিনালে হোক। যেখানে এখনো কিছুই করা হয়নি। তবে এনসিটি যেন দেশীয় পরিচালনাতেই থাকে।
এদিকে এনসিটি টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে না দিতে গত ২০ মে বাংলাদেশ যুব অর্থনীতিবিদ ফোরামের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট করা হয়। ২৫ মে শুনানির কথা থাকলেও তা পিছিয়ে ২২ জুন পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে। শ্রমিক ও কর্মচারীরা বলছেন, এনসিটি দেশের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল, যেখানে হাজারো লোক কাজ করেন। এটি বিদেশিদের হাতে গেলে দেশের মানুষের চাকরি হারানোর শঙ্কা রয়েছে। এতে একদিকে যেমন দেশের আয় কমে যাবে, অপরদিকে দেশের টাকা বাইরে চলে যাবে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০০৭ সাল থেকে আংশিক এবং ২০১৫ সাল থেকে পুরোদমে এনসিটি কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করছে। একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান দরপত্রের মাধ্যমে পরিচালনার দায়িত্ব পায় এবং বন্দরের কর্মচারীরাও টার্মিনাল পরিচালনায় যুক্ত রয়েছেন। এখন পর্যন্ত এনসিটি পরিচালনা নিয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি এবং দেশের স্বার্থবিরোধী কিছুই হবে না বলেও জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের হিসাব মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনসিটি টার্মিনাল থেকে আয় হয়েছে ১ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান পেয়েছে প্রতি কনটেইনারে ৬৯৪ টাকা বা প্রায় সাড়ে ৬ ডলার। খরচ বাদে প্রকৃত আয় ৫৭৪ কোটি টাকা। এতে প্রতি কনটেইনারে বন্দরের প্রকৃত আয় দাঁড়ায় প্রায় ৪৭ ডলার। তবে টার্মিনালটি বিদেশিদের হাতে গেলে আয় নির্ভর করবে দর-কষাকষির ওপর। পতেঙ্গা টার্মিনাল থেকে বন্দর বর্তমানে পাচ্ছে কনটেইনারপ্রতি ১৮ ডলার, যেখানে বন্দরের শুধু জেটি নির্মাণে বিনিয়োগ রয়েছে। ফলে এনসিটি থেকে বর্তমান আয়ের চেয়ে কম আয়ের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
অন্যদিকে বন্দর বিশেষজ্ঞদের একটি অংশের মতে, ডিপি ওয়ার্ল্ডের রয়েছে বিশ্বমানের পরিচালন দক্ষতা। যদিও এনসিটিতে বড় ধরনের বিনিয়োগের সুযোগ নেই, তবও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটি ভূমিকা রাখতে পারে। সম্প্রতি বন্দর দিবস উপলক্ষে এক সভায় চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, এনসিটির বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বিদেশি অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হলে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বন্দরের সেবার মান বাড়বে, দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে দেশ। তিনি আশ্বস্ত করেন, বিদেশিদের হাতে টার্মিনাল গেলেও দেশীয় কর্মীরা চাকরি হারাবেন না, যেমনটি পতেঙ্গা টার্মিনালের ক্ষেত্রে হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের ২৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালের অলাভজনক দেশবিরোধী চুক্তি বাতিল করে জিটুজি এর পরিবর্তে উন্মুক্ত দরপত্র আহবানের মাধ্যমে বন্দরের দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থান অক্ষুন্ন রেখে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব উদ্যোগে পরিচালনা করতে হবে। এতে দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের পরিবেশ তৈরি হবে এবং বন্দর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। দেশের টাকা বিদেশে যাওয়া হতে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি পতেঙ্গা টার্মিনালের দেশ বিরোধী চুক্তি দেশের জনগণের কাছে উন্মোচন করতে হবে এবং একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি দ্বারা চুক্তিটি পর্যালোচনা করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক