দক্ষতা বাড়ানো, স্বার্থের দ্বন্দ্ব কমানো ও দেশের কর ভিত্তি বাড়াতেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দুই ভাগ করেছে বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর। এ নিয়ে অধ্যাদেশ জারির পরদিন গতকাল মঙ্গলবার এনবিআরের কর্মকর্তাদের একটি অংশের কর্মবিরতির ডাকের মধ্যে এক বিবৃতিতে এসব কথা জানায় প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর।
এমন পদক্ষেপ শুধু প্রশাসনিক পরিবর্তনের জন্য নয় তুলে ধরে বিবৃতিতে বলা হয়, “এই সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য হল কর নীতি প্রণয়ন এবং কর প্রশাসনের কাজকে আলাদা করা; দক্ষতা বাড়ান, স্বার্থের দ্বন্দ্ব হ্রাস ও দেশের করভিত্তি (কর-জিডিপি) প্রসারিত করা।”
গত সোমবার রাতে রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি আলাদা বিভাগ করে এনবিআর ভাগ করার অধ্যাদেশ জারি করা হয়। পরে মঙ্গলবার তা বাতিলের দাবিতে তিন দিনের কলম বিরতির ডাক দেয় ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’। এর আগে কর কর্মকর্তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে এ নিয়ে তাদের মতামত মানা হয়নি বলে অভিযোগ করে তা বাতিলের দাবি করা হয়। খবর বিডিনিউজ’র
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর এনবিআরকে দুই ভাগ করার ব্যাখ্যায় ‘প্রায় ৫০ বছরের পুরনো এনবিআর দীর্ঘদিন ধরেই রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে’ তুলে ধরে বলেছে, এশিয়ার সর্বনিম্ন কর-জিডিপির অনুপাত বাংলাদেশে বলা হয়। দেশের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষা পূরণে বর্তমান ৭ দশমিক ৪ শতাংশ কর-জিডিপি অনুপাতকে অন্তত ১০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।
এতে বলা হয়, “এনবিআরের কাঠামো পুনর্গঠন এই লক্ষ্যে (১০ শতাংশ কর-জিডিপি) পৌঁছাতে অত্যন্ত জরুরি। কর নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের দায়িত্ব একই প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা অনৈতিকতা ও অদক্ষতার জন্ম দেয়– এমনটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই মতৈক্য তৈরি হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন, রাজস্ব আদায়কেই অগ্রাধিকার দিয়ে এমন নীতি নেওয়া হয়েছে যা ন্যায়বিচার, প্রবৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাকে উপেক্ষা করেছে।
স্বার্থের দ্বন্দ্বের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর বলছে, “নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন একসঙ্গে হওয়ায় কর নীতিতে স্বচ্ছতা হারিয়ে গেছে এবং অনিয়ম বেড়েছে। কর আদায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের কোনো জবাবদিহির কাঠামো নেই এবং তারা প্রায়ই কর ফাঁকিদাতাদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে ব্যবস্থা নেয়। অনেক সময়, তারা কর ফাঁকি দিতে সহায়তা করেন ব্যক্তিগত লাভের জন্য। কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতার পরিমাপের জন্য কোনো নিরপেক্ষ পদ্ধতি নেই এবং তাদের পদোন্নতি কার্যকারিতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় না।”
এছাড়াও একই সংস্থার ওপর নীতি প্রণয়ন ও প্রশাসনিক দক্ষতা গড়ে তোলার দায়িত্ব থাকায় কোনো ক্ষেত্রেই যথাযথ মনোযোগ দেওয়া যায়নি। ফলে করজালের পরিধি সংকুচিত থেকে গেছে এবং রাজস্ব আহরণ সম্ভাবনার তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে বলা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, এনবিআর দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল প্রয়োগ, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের অভাব এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে জর্জরিত ছিল, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়েছে এবং আইনের শাসনকে দুর্বল করেছে। এছাড়া বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের প্রধান একইসঙ্গে এনবিআরের প্রধান হওয়ায় প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি হয়েছে এবং কার্যকর নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর বলেছে, রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন প্রণয়ন, করহার নির্ধারণ ও আন্তর্জাতিক কর চুক্তি পরিচালনার কাজ করবে। অপরদিকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ থাকবে কর আদায়, অডিট ও পরিপালনের দায়িত্বে। এতে যারা কর নির্ধারণ করছে তারা আর কর সংগ্রহ করছে না, ফলে কোনো ধরনের গোপন সমঝোতার সুযোগ থাকবে না।
প্রতিটি বিভাগ নিজ নিজ কাজে মনোযোগ দিতে পারলে পেশাগত দক্ষতা বাড়বে, স্বার্থের দ্বন্দ্ব কমবে এবং প্রতিষ্ঠানিক সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।
এই সংস্কারের ফলে করজাল বিস্তৃত হবে, পরোক্ষ কর নির্ভরতা কমবে এবং দক্ষ জনবল দিয়ে প্রত্যক্ষ কর আদায়ে জোর দেওয়া সম্ভব হবে বলেও তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
একটি নির্দিষ্ট নীতি ইউনিট সংবেদনশীল, তথ্যভিত্তিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কর নীতি প্রণয়ন করতে পারবে, যা শুধুমাত্র স্বল্পমেয়াদি রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নয় বরং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বিবেচনায় নেবে। স্বচ্ছ ও পূর্বানুমেয় কর নীতি এবং পেশাদার কর প্রশাসন বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করবে এবং বেসরকারি খাতের অভিযোগ কমাবে বলেও তুলে ধরা হয় বিবৃতিতে।
ব্যাখ্যায় বলা হয়, “সার্বিকভাবে এই পুনর্গঠন কেবল একটি প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়, বরং এটি একটি সময়োপযোগী এবং অপরিহার্য পদক্ষেপ, যা একটি ন্যায্য, দক্ষ এবং টেকসই কর ব্যবস্থা গঠনের ভিত্তি স্থাপন করবে। শক্তিশালী নীতিনির্ধারণ এবং দুর্নীতিমুক্ত কর প্রশাসনই বাংলাদেশকে তার জনগণের স্বপ্ন ও চাহিদা পূরণের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।”