এত উন্নতির পরও কেন এই জন অসন্তোষ ?

16

আসিফ তানভীর

একাত্তর পরবর্তী সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ী একটি সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব একটি ইতিহাসের সাক্ষী হলো। অনেকেই যাকে বলছেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা। সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে কি হয়নি তা সময়ই বলে দেবে। আমি এখানে বিগত সরকারের কিছু সাফল্য ব্যর্থতার নিরিখে উদ্ভুত পরিস্থিতিকে নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি। এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় বর্তমান সরকারের কী করণীয় হতে পারে সেই বিষয়ে কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
অর্থনৈতিক সূচকে বিস্ময়কর অগ্রগতি : নব্বইয়ে স্বৈরাচার এরশাদ পতনের পর একানব্বইয়ে বাংলাদেশ পুনরায় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। এরপর থেকে দু’হাজার তেইশ পর্যন্ত সময়কালকে ধরলে যে বত্রিশ বছর পাই, তাকে আমরা মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথম আঠারো বছর অর্থাৎ ১৯৯১ হতে ২০০৮, এবং পরবর্তী পনেরো বছর অর্থাৎ ২০০৯ থেকে ২০২৩। প্রথম ভাগটাতে আমরা দেখেছি ক্ষমতার কয়েক দফা পালাবদল। এবং দ্বিতীয় ভাগে দেখতে পাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগের একটানা শাসন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুঝতে পেরেছিলেন, বারবার ক্ষমতার হাতবদল বাংলাদেশের উন্নতির ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। তাই তিনি দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্ষমতাকে দীর্ঘমেয়াদী ও সুসংহত করার পরিকল্পনা করলেন। এই পরিকল্পনার সুফল আমরা হাতেনাতে পেলাম। বিগত পনেরো বছরে বাংলাদেশ যে অভাবিত সাফল্য পেয়েছে, তা সত্যিকার অর্থেই একটি সুফল পরিকল্পনার ফসল। একানব্বই পরবর্তী এই দু’টি ভাগের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরলে বিষয়টি আরও ভালোভাবে পরিষ্কার হয়। ১৯৯১ এ যখন বিএনপি সরকার দায়িত্ব নেয় তখন দেশের জিডিপি ছিলো ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (মা.ড.) এবং সেই অর্থবছরে প্রণীত বাজেটের আকার ছিলো সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এবং ২০০৬ সালে যখন দ্বিতীয় দফায় বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ে তখন বাংলাদেশের জিডিপি দাঁড়ায় ৭২ মিলিয়ন মা.ড. ও সেই বছর বাজেটের আকার দাঁড়ায় ৭০ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ প্রথম পনেরো বছরে জিডিপির আকার বৃদ্ধি হয় দুই গুণের চেয়ে কিছুটা বেশি এবং বাজেটের আকার বৃদ্ধি পায় সাড়ে চার গুণ। অপরদিকে ২০০৯ এ যখন আওয়ামীলীগ যখন ক্ষমতা নেয় তখন জিডিপি ছিলো ৯২ বিলিয়ন মা.ড. এবং ২০২৩ এ তা এসে দাঁড়ায় ৪৫০ বিলিয়ন মা.ড.। অর্থাৎ পরবর্তী পনেরো বছরে জিডিপি বৃদ্ধি পায় প্রায় পাঁচগুণ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেটের আকার ছিলো ৭ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ পরবর্তী অর্ধে বাজেটের আকার বাড়ে প্রায় দশ গুণ! মানুষের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার মান যদি মাথাপিছু জিডিপি ধরি, সেক্ষেত্রেও এদেশের উল্লম্ফনটা চোখে পড়ার মতোই। প্রথম পনেরো বছরে মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে দুই গুণেরও কম (১৯৯১ সালে ২৮৩ মা.ড., ২০০৬ সালে ৫০৩ মা.ড.) এবং দ্বিতীয় পনেরো বছরে মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে চার গুণ (২০০৯ সালে ৬৩০ মা.ড., ২০২৩ সালে ২৫৩০ মা.ড.)। জিডিপি বৃদ্ধিতে উচ্চহার বাংলাদেশকে তুলে এনেছিলো বিশ্বের দ্রæত বর্ধনশীল দেশগুলোর তালিকার প্রথম সারিতে। এই সময়েই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। এছাড়া দারিদ্র্য দূরীকরণের সুচকেও অগ্রগতি বিগত আওয়ামী সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জন।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন : গত সরকারের আমলে দেখেছি একের পর এক বিশাল আকারের বাজেট প্রণয়ন, যার বেশিরভাগটুকুই বরাদ্দ থাকতো উন্নয়ন বাজেটে এবং সামরিক খাতে। বিগত সরকারের সময়েই বাংলাদেশ এমন সব উচ্চাভিলাষী ও দুঃসাহসিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেখেছে, যা আগের সরকারগুলো চিন্তাও করতে পারেনি। পদ্মা সেতু নির্মাণ যার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। তাছাড়া ঢাকা মেট্রোরেল, ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মহেশখালী টার্মিনাল, বে টার্মিনালের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সহ আরও অনেক মেগা প্রজেক্টের সফল বাস্তবায়ন করেছে এই সরকার। দেশের প্রায় সকল মহাসড়ক চার লেইনে উন্নীত করা এবং ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর এই ভূখন্ডে প্রথমবারের মতো রেললাইন এক্সটেনশনের মাধ্যমে কক্সবাজার ও মংলাতে রেলসেবা চালু করেছে বিগত আওয়ামী সরকার।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য অর্জন : অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে তরতর করে এগিয়ে যাওয়া এবং অভূতপূর্ব অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়াও বেশকিছু সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে আওয়ামীলীগ সরকার। তাছাড়া ভারতের সাথে ছিটমহল সমস্যার সমাধান এবং মায়ানমারের সাথে সমুদ্র সীমানা নির্ধারণে বিজয় বিগত সরকারের বড় অর্জন। বিগত বছরগুলোতে সাক্ষরতার হার বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও উন্নতি হয়েছিলো। কমে এসেছিলো সাধারণ চুরি, ছিনতাইসহ এই জাতীয় অন্যান্য অপরাধসমূহ। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও বাংলাদেশ প্রশংসনীয় উন্নতির ছাপ রাখতে সক্ষম হয়। এছাড়াও জঙ্গি কর্মকাÐের প্রতি জিরো টলারেন্স দেখানো এবং জঙ্গিবাদ দমনে বিগত সরকারের সাফল্যও ছিলো চোখে পড়ার মতো।
কিছু সমালোচনা এবং কিছু মারাত্মক ভুল : মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই ভারত বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম দেশ। তাছাড়া পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যখন দেশে আসতে পারছিলো না, তখন ছয় বছর এই ভারতই তাঁকে আশ্রয় দেয়। তাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকার যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই ভারত তার বন্ধুত্বের হাত দ্বিগুণ প্রসারিত করেছে। ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা প্রদানসহ নানা ইস্যুতে হাসিনার সরকার বারবার সমালোচিত হয়েছে। ভারতের সাথে মিত্রতা বজায় রাখতে গিয়ে এবং অতিরিক্ত গোঁয়ার্তুমির কারণে বিনষ্ট হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক। তাছাড়া, বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে পদ্মা সেতুর ফান্ড নিয়ে তৈরি হওয়া দূরত্বটা এক পর্যায়ে ব্যক্তিগত রেষারেষির পর্যায়ে নিয়ে যান শেখ হাসিনা। ড. ইউনূস বৈশ্বিকভাবে সমাদৃত ব্যক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রেও প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি। তাঁর সাথে এমন রেষারেষি, পদে পদে তাঁকে অপদস্ত করা শেখ হাসিনার একটি বড় ভুল ছিলো, যে ভুলের মূল্য তাঁকে শেষ পর্যন্ত দিতে হয়েছে।
এত এত উন্নতির পরও কেন এই জন অসন্তোষ ?
মুদ্রার এপিঠ থাকলে তার ওপিঠ থাকবেই। সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন আসে, অর্থনৈতিক এবং অবকাঠামোগতভাবে এমন অভূতপূর্ব সাফল্যের পরও জনমনে এত অসন্তোষের জন্ম কেন হলো? এর উত্তর নিহিত রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণেই, যেখানে তিনি বলেছিলেন- বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়। শেখ হাসিনার অধীনে একদিকে যেমন উন্নয়নের পারদ চড়েছে, অপরদিকে ক্রমশ সংকুচিত হয়েছে নাগরিক অধিকার। অর্থনীতিতে ঃৎধফব ড়ভভ বলে একটি শব্দ আছে, যার অর্থ কোনও কিছু অর্জন করার বিনিময়ে কোনও কিছুকে ছাড় দেয়া। আওয়ামী সরকার ঃৎধফব ড়ভভ করেছে নাগরিক অধিকারকে। দেশের উন্নয়ন ঘটাতে গিয়ে বারবার ভূলুন্ঠিত করেছেন মানবাধিকারকে, যার চড়া মূল্য দিতে হয়েছে সরকারকে। বৈশ্বিক মানবাধিকার সূচকগুলোতে বাংলাদেশ ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছে এবং আমরা দেখেছি এর ফলস্বরূপ বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রও আমাদের ওপর স্যাংশন আরোপ করেছে। সাধারণ অপরাধ কমে গেলেও ক্ষমতা সুসংহত করতে গিয়ে বেড়েছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো কর্তৃক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা। এছাড়া সাধারণ চোর, ছিনতাইকারী সবাই দলে দলে ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে দেশজুড়ে চাঁদাবাজির প্রাতিষ্ঠানিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে কামিয়ে নিয়েছে বিপুল অর্থ। ফলে তাদের রাস্তাঘাটে আর চুরি, ডাকাতি আর ছিনতাই করার প্রয়োজনই পড়লো না। ছাত্রলীগও পরিণত হলো একটি সন্ত্রাসী সংগঠনে। ২০০৯ এ ক্ষমতায় আসার শুরুতেই রক্তাক্ত বিডিআর বিদ্রোহে মসনদ কেঁপে ওঠে শেখ হাসিনার। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণভাবে ঘটনা ধামাচাপা দিতে সক্ষমও হম। কিন্তু সেই বিদ্রোহের প্রকৃত সত্য জনমানুষ আজও জানতে পারেনি। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে হাসিনা সরকার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটালেও, তা ব্যবহার করার মতো দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা হলো না। ফলে প্রজন্ম বুঁদ হয়ে রইলো ফেসবুক স্ক্রলিং ও টিকটকে। অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে হরণ করা হলো মানুষের বাকস্বাধীনতা। হাসিনা চেয়েছিলেন, সকলের মতামতকে উপেক্ষা করে দেশের উন্নয়ন করতে। কিন্তু উপেক্ষা করতে করতে এক পর্যায়ে এসে বিরুদ্ধ মতকে এমনভাবে দমন করতে শুরু করলেন, তা গণমানুষের সহ্যসীমাকে ছাড়িয়ে গেলো।
অন্যদিকে দেশের ব্যাপক উন্নয়নযজ্ঞ করতে গিয়ে প্রয়োজন পড়লো বিপুল পরিমাণ অর্থ। জাতীয় বাজেটের মূল যোগান আসেই মূলত দুটি খাত থেকে- প্রথমত, অভ্যন্তরীণ উৎস তথা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (ঘইজ) আওতাভুক্ত কর এবং দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক ঋণ। এনবিআর কর্তৃক আদায়যোগ্য করের বোঝা যত বাড়তে লাগলো, কর আদায়কারী কর্মকর্তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব তত বেড়ে গেলো। এইসব কর্মকর্তাদের অতিলোভের কারনে দেশের পুরো কর ব্যবস্থাই হয়ে পড়লো দুর্নীতিগ্রস্ত। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে তা দাঁড়ায় ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকায়, যার মধ্যে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ লাখ কোটি টাকা। ব্যাংক ও শেয়ারবাজারেও অকল্পনীয় লুটপাটের মাধ্যমে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার পাচার হয়ে গেলো বিদেশে। তৈরি হলো ডলার সংকট। স¤প্রতি বণিক বার্তার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৭ লাখ কোটি টাকা! যা কিনা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের প্রায় আড়াই গুণ! ফলশ্রæতিতে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যের পতন ঠেকানো গেলো না কিছুতে। বেড়ে গেলো আমদানি খরচ। বাংলাদেশ আমদানি নির্ভর অর্থনীতির দেশ হওয়ায় ব্যালেন্স অফ পেমেন্টে সৃষ্টি হলো মারাত্মক ঘাটতি। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্র্ধ্বগতি লাগামছাড়া হলো এবং অর্থনীতি দেখলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি। ফলে মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধির সুফল জনগণ পেলো না। বরং আয় যত বেড়েছে, খরচ তাঁর চেয়ে বেশি বেড়েছে। মানুষের ব্যবহারযোগ্য আয় (ফরংঢ়ড়ংধনষব রহপড়সব) গেলো কমে। সরকারের সাথে প্রত্যক্ষ যোগসাজশ করে দু’টি ভিন্ন কোম্পানি দেশে ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লুটপাটে নেতৃত্ব দিয়েছে। সাথে অন্যান্য অসাধু ব্যবসায়ীরা তো ছিলোই। এর ওপর ছিলো দলীয় সুবিধাভোগীদের একের পর এক নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া। তারপর লুটপাট শেষে ওইসব ব্যাংকগুলোকে আবার ভালো ব্যাংকগুলোর সাথে একীভূত করার তোড়জোড় শুরু হলো।
দেশের প্রশাসন, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে খেলাধুলা, সংস্কৃতি অঙ্গন সর্বত্রই নির্লজ্জ দলীয়করণ ও দুর্নীতি মানুষ দেখেছে এই সরকারের সময়েই। দারিদ্র্য নিরসনে সফলতা পেলেও, সরকারের সুবিধাভোগী শ্রেণীগুলো বিপুল সম্পদ অর্জন করে অতিধনী হয়ে যায়। যে কারণে, দেশের মোট সম্পদ বাড়লেও হয়নি সম্পদের সুষম বন্টন। ফলে ধনী গরিবের বৈষম্য আরও বেড়েই গেছে। দেশে সাক্ষরতার হার বাড়লেও প্রকৃত শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিক তৈরি করেনি সরকার। যারা দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে, চলে গেছে। কিন্তু না যেতে পারার সংখ্যা বাড়তে লাগলো দিন দিন। দেশে শিক্ষিত বেকার বেড়ে গেলো অনেক। বেসরকারি খাতে পর্যাপ্ত জব মার্কেট তৈরি না হওয়ায় সবাই ঝুঁকতে লাগলো সরকারি চাকরিতে। কিন্তু সেখানেও কোটা বৈষম্য। এভাবে বৈষম্য, নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার হতে যখন মানুষের পিঠ ঠেকে গেলো দেয়ালে। আর তখনই তারা বারুদের মতো জ্বলে উঠে ঘুরে দাঁড়ালো।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি : উনিশশো পঁচাত্তর সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে জাতীয় দল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেন। যার ফলশ্রæতিতে ফেব্রæয়ারি মাসে গঠিত হয় বাকশাল এবং জুনে গঠিত হয় বাকশালের কমিটি। কিন্তু তার দুই মাস পরেই মৃত্যুবরণ করায় জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু বাকশাল কার্যকর করে যেতে পারেননি। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ কী সুনিপুণভাবেই না কার্যকর করলেন তাঁর উত্তরসূরি ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ খেতাব পাওয়া শেখ হাসিনা! বিগত বছরগুলোতে বিরোধী দলগুলোকে দমন পীড়নের মাধ্যমে তিনি কায়েম করলেন একদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থারই নামান্তর। এই একদলীয় শাসনব্যবস্থার চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখলাম চলতি বছরের জানুয়ারির নির্বাচনে প্রকৃত বিরোধী দলগুলোকে বাদ দিয়ে কিছু পোষ্য বিরোধী দল ও কিছু দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে নির্বাচন করে বিপুলভাবে জয়লাভ করে আবারও ক্ষমতায় আসে আওয়ামীলীগ।
ইতিহাসের কী আশ্চর্য পুনরাবৃত্তি! জানুয়ারিতে একদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা করে সেই বছরের আগস্টেই পতন ঘটলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের। আর তার প্রায় পঞ্চাশ বছর পর, আরেক জানুয়ারিতে একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জোরপূর্বক ক্ষমতা ধরে রাখার সেই বছরের আগস্টেই পতন ঘটলো বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারের। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা বিপুলভাবে কমে যাওয়ার পিছনে উনার নিজের দায়টাই সবচেয়ে বেশি। নিজের আশপাশ থেকে তাজউদ্দীন আহমেদের মতো বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ লোকজনদের সরিয়ে চারপাশ ভরিয়ে তুলেছিলেন চাটুকার ও সুবিধাবাদী লোকজন দিয়ে। ফলত তিনি হয়ে পড়েছিলেন বন্ধু ও সুপরামর্শকহীন। হাসিনার পতনের ক্ষেত্রেও দায়টা পুরোপুরি তাঁর ওপরেই বর্তায়। প্রবীণ ও বিচক্ষণ রাজনীতিকদের সরিয়ে দিয়ে তিনি চাটুকার মন্ত্রীসভা, সুবিধাবাদী আমলা, পোষ্য পেশাজীবী ও বিরোধী দল, লোভী ও নীতিহীন ব্যবসায়ী এবং নব্য আওয়ামীলীগারদের দিয়ে চারপাশ ভরিয়েছিলেন। তাই শেষকালের রাজনৈতিক বুদ্ধির খেলায় সুপরামর্শকের অভাবে তিনি একের পর এক চাল হেরে গেছেন। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে না পারলে ইতিহাস এভাবেই ফিরে ফিরে আসে।
নিছকই কি একটি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ?
নিছকই একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকেই কি সরকার পতনের আন্দোলন শুরু? নাকি এর পেছনে রয়েছে গভীর কোনও বৈদেশিক ষড়যন্ত্র? স্বাভাবিকভাবেই বেশকিছু ষড়যন্ত্র তত্ত¡ ডালপালা মেলেছে। আর এই ডালপালা আরও হাওয়া পেয়েছে গত নির্বাচনের আগে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার কিছু তথ্যে। ২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া যারাখোভা এক বিবৃতি দিলেন, যদি নির্বাচনে আবারও আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে, তবে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী সরকারকে উৎখাত করার জন্য বাংলাদেশে ‘আরব বসন্তের’ মতো পরিস্থিতি তৈরি করবে যেন আপামর জনগণ রাস্তায় নেমে এসে সরকারের পতন ঘটায়। বাংলাদেশে বৈষম্য কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং সাধারণ ছাত্ররা কোটা বৈষম্য নিয়ে কতটা খেপে আছে তা যুক্তরাষ্ট্রের কিংবা শক্তিধর অন্যান্য বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর গোয়েন্দাদের অজানা থাকার কথা নয়। সুতরাং এই বৈষম্যকে পুঁজি করে আরব বসন্তের মতো একটি বাংলা বসন্ত তৈরি করা ছিলো সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র। তাছাড়া, শেখ হাসিনা সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা ও স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবও গোয়েন্দাদের অজানা থাকবে না। যদি এমন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আন্দোলন ঘটানো হয়েও থাকে, তারা জানতো যে হাসিনা এই আন্দোলন ঘিরে জনমতের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে সেটাকে দমনের জন্য চূড়ান্ত পন্থা অবলম্বন করবে। এবং এর মধ্যে যদি এক দুইটা লাশ ফেলে দেওয়া যায়, তবে জনতা জেগে উঠবে আগুনের মতো। শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন কি তার নিজস্ব গতিতেই এমন রূপ পেয়েছিলো নাকি বিদেশি শক্তির সাহায্যে তা ঘটানো হয়েছে তা সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোই ভালো বলতে পারবে। আমরা শুধু এটুকুই বলতে পারি, এত মানবাধিকার লঙ্ঘন, অত্যাচার, নিপীড়ন, সীমাহীন দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণে আওয়ামী সরকারের পতন অনিবার্য ছিলো। আজ না হয় কাল এই সরকারের পতন হতোই। ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব এক আন্দোলনের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত অনিবার্য পতনকেই বরণ করে নিলো শেখ হাসিনা এবং তার আওয়ামী সরকার।
নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা : ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা আকাশ সমান। সে অনুপাতে তাদের চ্যালেঞ্জও অনেক বেশি। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে একনায়কের পতন ঘটিয়ে সফল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার হার মাত্র ৬%, যেখানে অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথে যাত্রার সাফল্য ৫৭%। অর্থাৎ বর্তমান সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ মাত্র ৬ শতাংশ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়া। এছাড়া অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধানের যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক কারও অবিদিত নয়। সুতরাং আমরা বিশ্বাস করি, তিনি তাঁর এই সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের সাথে মিত্রতা বজায় রেখেই তার পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন করবেন এবং সমস্ত ষড়যন্ত্র তত্ত¡কে ভ্রান্ত প্রমাণ করবেন। অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান কাজই হলো যত দ্রæত সম্ভব দেশে নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি করে সুষ্ঠু একটি নির্বাচন দেওয়া। তবে এই মুহুর্তে জনগণ দ্রæত নির্বাচন দিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলকে আবার ক্ষমতায় বসাতে চায় না। বর্তমানে সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে :
১। যত দ্রæত সম্ভব চলমান লুটতরাজ ও সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপচেষ্টা বন্ধ করে দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিকে নিয়ে আসা।
২। এই সময়ে নানা জায়গায় নানান বিদ্রোহের সূত্রপাত হতে পারে। সেসবকে চিহ্নিত করে দ্রæত সমাধানের ব্যবস্থা নেওয়া।
৩। বিগত সরকার অনেকগুলো উন্নয়ন প্রকল্প নির্মানাধীন রেখে গেছে। বর্তমান সরকারের কাজ হবে নতুন কোনও উন্নয়ন প্রকল্প হাতে না নিয়ে, নির্মানাধীন প্রকল্পগুলো চলমান রাখা।
৪। আওয়ামী সরকারের রেখে যাওয়া ঋণের বোঝা কমানোর জন্য সচেষ্ট থাকা। প্রয়োজনে ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ (খড়ধহ ৎবংপযবফঁষব) অথবা ঋণ পুনর্গঠনের (খড়ধহ ৎবংঃৎঁপঃঁৎব) মাধ্যমে বিকল্প ফান্ডের ব্যবস্থা করা।
৫। ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য না বাড়িয়ে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি করা এবং আগামী কয়েক মাস নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বাদে অন্যান্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা।
৬। বিদেশে পাচারকৃত ডলারের যতটুকু সম্ভব ফেরত আনার ব্যবস্থা নেওয়া৷
৭। ব্যাংকিং খাত ও শেয়ার বাজারে স্বচ্ছতা আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।
৮। বাজেটে উন্নয়ন ও সামরিক খাতে বরাদ্দ কমিয়ে, শিক্ষা ও গবেষনা খাতে বাজেট বাড়ানো।
৯। স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি দূরীকরণে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ।
১০। সব বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, কিন্তু কাউকে বাড়তি সুবিধা দিতে গিয়ে দেশের সার্বভৌমত্বকে ঝুঁকিতে না ফেলা।
১১। দেশে জঙ্গিবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। জঙ্গিবাদ দমনে সর্বোচ্চ কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে।
১২। ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং একই সাথে ছাত্রাবস্থায় নেতৃত্ব তৈরির জন্য অরাজনৈতিক বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১৩। দেশে শুধু সাক্ষরতা নয়, বরং প্রকৃত শিক্ষিত, সচেতন ও দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার জন্য সঠিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন।
ড. ইউনূস সকলের শ্রদ্ধাভাজন। তিনি সবসময় ছাত্রশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং তরুণদের নিয়ে কাজ করতে চান। ছাত্র তরুণদের সাথে নিয়ে নতুন একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় তিনি সফল হবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।

লেখক : ফেলো মেম্বার, দি ইন্সটিটিউট অফ চার্টার্ড একাউন্টান্টস বাংলাদেশ