চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ‘মব জাস্টিসের’ নামে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার ঘটনা থামছেই না। এ সপ্তাহে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় পৃথক দুটি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। গত রবিবারে সাতকানিয়ায় একটি গ্রামে ডাকাতির কথা মাইকে ঘোষণার পর আগন্তুক দুজনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। এর আগে শরিয়তপুরে ডাকাতির অভিযোগে ৫জনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীতেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। উত্তরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই ব্যক্তিকে পিটিয়ে পায়ে দঁড়ি বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। উত্তরার হাউজ বিল্ডিংয়ের বিএনএস সেন্টারের সামনে ফুটওভার ব্রিজের ওপরে এ ঘটনা ঘটে। গত মঙ্গলবার ঢাকার গুলশানের ডিপ্লোম্যাটিক জোনের মতো অতিগুরুত্বপূর্ণ ও নিরাপদ এলাকায় বাসার সাবেক কেয়ারটেকারের নেতৃত্বে মব তৈরি করে এক ব্যবসায়ীর বাসায় লুটপাট করা হয়। এক পর্যায়ে জড়িতরা পুলিশ, র্যাব ও সেনা সদস্যদের সামনেই চলে যায়। শুধু তাই নয়, ঢাকার মোহাম্মদপুরসহ বেশ কয়েকটি আবাসিকে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের নাম ভাঙ্গিয়ে প্রকাশ্যে বাসা বাড়িতে টাকার খুঁজে অভিযান চালাচ্ছেন, যেখানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্লিপ্ত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। এর আগে আমরা গাজিপুর ও চট্টগ্রামে প্রবর্তক মোড়ের একটি বাড়ি দিনে দুপুরে ডাকাতির খবর শুনেছি। সরকার বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগে যেমনটি ছিল এখনই তেমনটি। বড় ধরনের কোন অপরাধ সংঘটিত হয়নি।
দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিতভাবে মব তৈরি করে একের পর এক লুটপাট, হত্যা, নির্যাতন, মারধর, লাঞ্ছনা, অপমান, অপদস্থ ও হামলা করার ঘটনা ঘটছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায়। যদিও গুলশানের ঘটনায় সাবেক কেয়ারটেকার শাকিল আহমেদসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মব জাস্টিসের নামে বেআইনি নির্যাতন, গণপিটুনি ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা রোধে ৩০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রিটও করা হয়েছে। রিটে মব জাস্টিস তথা উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে বিচার বা হত্যা বা নির্যাতন রোধে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা চাওয়া হয়। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তথাকথিত মব জাস্টিসের নামে হামলা ও হত্যার হার অনেক বেড়ে যায়। তারই ধারাবাহিকতায় এখন আবার শুরু হয়েছে গণপিটুনিতে হত্যা ও লুটপাট। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মব তৈরির মাধ্যমে লুটপাট, নির্যাতন, মারধর, লাঞ্ছনা, হামলার ঘটনা অসংখ্য। একের পর এক ঘটনায় দেশে নতুন আতঙ্ক ও উদ্বেগ তৈরি করেছে মব জাস্টিস। অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কঠোর হুঁশিয়ারিও আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার রোধ করতে পারছে না। এভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া ব্যক্তিদের কঠোর বিচার হওয়া দরকার। হঠাৎ করেই মব সৃষ্টি হয়। তাই নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সুযোগসন্ধানী এবং অপরাধীরা নানা গুজব রটিয়ে মব সৃষ্টি করছে। যারা মব সৃষ্টি ও গণপিটুনির ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মনে করছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতে সুযোগসন্ধানিরা দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করতে মব তৈরির মাধ্যমে নানা অপরাধ করছে। মবের সাথে জড়িতরা সারাদেশের পাশাপাশি দেশের সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকা ডিপ্লোম্যাটিক জোনেও হামলা-লুটপাট করছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও এদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে বলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মনে করেন। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার ঘটনায় ৫ আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি নিহত হয়েছে। মারধর, নির্যাতন, লাঞ্ছনার ঘটনার সঠিক সংখ্যা নেই। দেশের কোথাও না কোথাও এমন ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। ২৮ ফেব্রæয়ারি ‘মব তৈরির’ করে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা আউটার রিং রোডে চেকপোস্টে দায়িত্বরত এসআই ইউসুফ আলীর ওপর হামলা করা হয়। হামলাকারীরা তার মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ এবং ওয়াকিটকি ছিনিয়ে নেয়। খবর পেয়ে সৈকত এলাকায় টহলরত পতেঙ্গা থানা পুলিশের একটি দল ও আশপাশের লোকজন গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। মব তৈরি করে পুলিশের ওপর হামলা চালানোর ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ১২ জনকে আটক করা হয়েছে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় মঙ্গলবার সতর্কতা জারি করে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার আহবান জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘মবের প্রতিটি ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর।’ আমরা মনে করি, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে একটি স্বৈরাচারি সরকারের পতন ঘটে। এরপর সাধারণ মানুষ আশা করেছিল দেশের মানুষ সামগ্রিকভাবে শান্তি ও নিরাপদে বসবাস করবে। এ আশাবাদ আরো বিস্তৃত হয়, যখন নোবেলজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়। কিন্তু আট মাসেও দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়া এবং মব জাস্টিসের মত ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। এ জাতীয় ঘটনা কোন সভ্য জাতির জন্য কল্যাণকর নয়। একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে কোনভাবে মব সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টি কাম্য হতে পারি না। এটিকে এখনই থামাতে হবে। সরকার কথায় নয়, বাস্তবে মব জাস্টিসসহ যাবতীয় অপরাধ দমনে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে-এমনটি প্রত্যাশা দেশবাসীর।