দেশে সাম্প্রতিক সহিংসতায় হতাহত ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় থেকে যে অগ্রবর্তী দলটি পাঠানো হয়েছে, তারা এক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনারের মুখপাত্র রাবিনা শামদাসানি গতকাল শুক্রবার বিবৃতিতে দিয়ে এই তথ্য তুলে ধরেছেন।
গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। তখন আন্দোলনের মধ্যে সহিংসতায় কয়েকশ মানুষ নিহত ও কয়েক হাজার মানুষ আহত হন। পুলিশের বিরুদ্ধে অতিরিক্তি বলপ্রয়োগের অভিযোগ রয়েছে। গুলিবিদ্ধ অনেক শিশু, তরুণসহ বিভিন্ন বয়সি মানুষ এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। খবর বিডিনিউজ’র
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তদন্তের কাজে বাংলাদেশে পাঠানো অগ্রবর্তী দলটি গত সপ্তাহে (২২-২৯ অগাস্ট) ছাত্র নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, যাদের অনেকে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আটক বা আহত হয়েছিলেন। অন্তর্র্বর্তী সরকারের বেশিরভাগ উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্র্মতাদের সঙ্গেও বিশদ আলোচনা করেছে তারা।
অগ্রবর্তী দলের সদস্যরা আইনজীবী, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং সংখ্যালঘু ও আদিবাদী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে তথ্য দিয়েছেন মুখপাত্র রাবিনা।
“এসব বৈঠকে সাম্প্রতিক সহিংসতা ও উত্তাল পরিস্থিতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অব্যবহারের বিষয়ে কোন কোন পদ্ধতি অলম্বন করে তদন্তকাজ এগিয়ে নেওয়া যায়, সে বিষয়ে সবার সঙ্গে কথা বলেছে দলটি”, বলা হয়েছে বিবৃতিতে।
বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকার এই তদন্ত করতে অনুরোধ করেছে বলে তুলে ধরে রাবিনা বলেন, তদন্তের পরিসর রাখা হয়েছে দেড় মাস অর্থাৎ ১ জুলাই তেকে ১৫ অগাস্ট।
৫ অগাস্ট সরকার পতন হলেও পরের কয়েকদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সহিংসতা হয়, পুড়িয়ে দেওয়া অনেক ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান; বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরও হামলা হয়, তাদের ঘরবাড়িতে লুটপাট ও আগুন দেওয়ার খবর রয়েছে।
১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে খুন হওয়ার শোকাবহ দিনে ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শোক জানাতে যাওয়া অনেকে নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হন।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এবং ১৫ অগাস্টের ঘটনা- সব মিলে এসব বিষয়ে হতাহতের তদন্তে অগ্রবর্তী দল কাজ করেছে কি না, তা পরিষ্কার করেননি মুখপাত্র রাবিনা।
তবে বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ১ জুলাই থেকে ১৫ অগাস্ট পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর নিরপেক্ষ তদন্তে বাংলাদেশে একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পাঠাতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছেন জাতিসংঘ মানবাধিকার-বিষয়ক হাই কমিশনার ভলকার টুর্ক। সে মোতাবেক আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম পাঠানো হবে।
“এই টিম বিক্ষোভের সময় মানবাধিকার ও অন্যান্য অপব্যবহারের বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করবে এবং গোড়ার কারণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখবে। এসবের ভিত্তিতে দ্রæত বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য সুপারিশ করবে তারা। এই কাজে অন্তর্র্বতী সরকার, নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর কাছ থেকে পরিপূর্ণ সহযোগিতার প্রতিশ্রæতি পেয়েছে দলটি।”
রাবিনা শামদাসানি বলেছেন, গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়া ও গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠনের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন হাই কমিশনার। আইনপ্রয়োগ সংস্থার মাধ্যমে গুমের ঘটনাগুলোর অভিযোগ খতিয়ে দেখবে এই কমিশন।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘গুমের’ ঘটনা তদন্তে হাই কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে কমিশন গঠন করেছে সরকার।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ওই কমিটি গঠন করে গত মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সাপ্তাহিক সভায় ‘আন্তর্জাতিক কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পার্সনস ফ্রম ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ শিরোনামের এই সনদে সই করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
বিবৃতিতে রাবিনা শামদাসানি বলেন, বাংলাদেশ গুমের ঘটনার দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক ইতিহাস রয়েছে, যা বন্ধের বিষয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় এবং মানবাধিকার রক্ষায় জাতিসংঘের অন্যান্য ব্যবস্থাগুলোও দিনের পর দিন কাজ করেছে।
“আমরা এই কমিশনকে তাদের কাজে সহায়তা করতে প্রস্তুত। তাদের উচিত হবে গুমের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সঙ্গে নিবিড় আলাপ-আলোচনা করা। গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে প্রচলিত নীতি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনও অনুসরণ করা উচিত।”
রাবিন বলেন, “গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জবাবদিহি নিশ্চিত করা, ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার সমুন্নত করার এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় সবসময় অন্তর্র্বতী সরকার এবং বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকবে।”