এক চুমুক পানি-একটি খেজুরে ইফতার আর দায়িত্বের গল্প

6

সোমবার (১০ মার্চ)। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকাল ৫টা ৫৫। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড তখনো ব্যস্ত। বেডে কাতরাচ্ছেন এক রোগী। পাশেই স্বজনদের উৎকণ্ঠিত অপেক্ষা। ওয়ার্ডের করিডোরে দৌড়ঝাঁপ লেগেই আছে। খানিক বাদে মাইকে আজানের ধ্বনি ভেসে এলো। উপস্থিত অনেকের হাত তখন দোয়ার জন্য উঠে গেলেও কর্তব্যরত চিকিৎসকদের হাতে স্যালাইনের সিরিঞ্জ বা প্রেসক্রিপশন লেখা কাগজ। এরই মাঝে দৌড়ে গিয়ে একটা খেজুর বা এক চুমুক পানি, এই হলো তাদের ইফতার।
অথচ বিকাল থেকে চমেক হাসপাতালের চারপাশে ইফতারের আমেজ শুরু হয়ে যায়। হাসপাতালের বাইরে রোজাদার পথচারিরা তাড়াহুড়া করে ইফতারের ব্যবস্থা করছেন। ক্যান্টিন ও আশপাশের দোকানগুলোতেও ব্যস্ততা। কিন্তু ভেতরে, জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ড, সব জায়গায় সময় যেন থমকে আছে। রোগীদের জন্য দৌড়ঝাঁপ করা চিকিৎসকদের হাতে নেই ইফতারের আয়োজন। ব্যস্ততার ফাঁকে এক চুমুক পানি আর এক খেজুরই যেন তাদের পরম পাওয়া। খবর সিভয়েস.কম এর।

রোগীর সেবাই প্রথম, ইফতার পরে : সন্ধ্যা ৬টা ৫ মিনিট। বুকে ব্যথা আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে নগরের পাঁচলাইশ এলাকা থেকে ভাইকে এনেছেন হুসাইন কিশোর। ছোলা-মুড়ি আর পেঁয়াজু মাখানো ইফতার কয়েক মুঠো মুখে না দিতেই রোগী দেখতে ছুটে গেলেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।
এ সময় জরুরি বিভাগে দায়িত্ব পালন করা ইন্টার্ন চিকিৎসক ফয়সাল বললেন, ‘রোগীর সেবাই আমাদের প্রথম দায়িত্ব। ইফতারের সময় হলে একটু পানি আর খেজুর মুখে দিয়ে আবার কাজে ফিরতে হয়। আমাদের এখানে বিলাসিতা করার সুযোগ নেই। হাতের কাজটা শেষ করেই পরে ইফতার করি। মাঝেমধ্যে এমন হয় যে ইফতার করতে বসে রোগীর ডাক এলো তখন ইফতার ছেড়েই যাই।
চিকিৎসকদের জন্য আলাদা কোনো ইফতার ব্যবস্থা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, আমরা নিজেরাই তা ব্যবস্থা করে নেই। যারা ডিউটিতে থাকি তারা কিছু টাকা দিয়ে আগে থেকেই রেডি করে রাখার চেষ্টা করি।
চমেকের ২ নম্বর ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডে কথা হয় পোস্ট গ্রাজুয়েশন ট্রেইনি চিকিৎসক জান্নাতুন নাঈমের সঙ্গে। তিনি বলেন, রোগীরা তো ইফতারের সময় দেখে আসে না। এক্সিডেন্ট, মারামারি, ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে আহত হইছে এমন কেস এখন বেশি আসে। রোগী এলে তখন আর ইফতার করছি কি করি নাই সেসব দেখার সুযোগ নাই। অনেক সময় এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার রোগী দেখতে ছুটতে হয়। এটাই আমাদের রোজার বাস্তবতা।

অপারেশন থিয়েটারে রোজা ভাঙার গল্প : চমেক হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ফিরোজ জানালেন, অপারেশন চলাকালীন কখনো কখনো তাদের ইফতারই করা হয় না। একবার এমন হয়েছে, সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার সময় অপারেশন শুরু করলাম, শেষ করতে করতে রাত ৮টা বেজে গেছে। তখনই প্রথম পানি খেয়েছি। এমন ঘটনা আমাদের জীবনের অংশ।
তিনি আরও বলেন, চিকিৎসক হিসেবে এই বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। রোগীর জীবন আগে, তারপর আমাদের ইফতার।
ইফতার আর সেহরিতে ন্যূনতম এলাউন্স থাকা প্রয়োজন মন্তব্য করে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মো. মুমিন উল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, গত বছর থেকে আমরা চিকিৎসক আর স্টাফরা ঈদের দিন খাবার পেয়েছি। এর আগে তো ঈদের সময়েও খাবার পেত না। আশপাশের সবগুলো হোটেল-দোকান বন্ধ থাকতো। একটা যে পাউরুটি-বন কিনে খাবো সেই সুযোগ থাকতো না। যদিও রোগীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু আমাদের জন্য নাই। সরকার চাইলে কিন্তু পারেন।
তিনি আরও বলেন, এখানে তো অনেক স্টাফ। হাসপাতাল তো সার্বক্ষণিক সেবার জন্য। সেহরি বা ইফতারে আমি আমার একজনের খাবার নিয়ে আসলাম কিন্তু আমার স্টাফরা তো সেটাও পারে না। রোগীর এতো চাপ থাকে, অনেক সময় দেখা যায় খাবারই খাওয়ার সুযোগ পাওয়া যায় না। কোনোরকমে পানি খেয়ে রোজা খোলা হয়েছে এমনো বহুদিন গেছে।

নিরাপত্তাকর্মী ও নার্সদের অবস্থাও একই : শুধু চিকিৎসকরাই নন, নার্স, হাসপাতালের নিরাপত্তাকর্মী, ওয়ার্ডবয়দের অবস্থাও প্রায় একই। পরিচ্ছন্নতাকর্মী টিকলু জানালেন, আমি তো অন্য ধর্মের। কিন্তু আমার রোজাদার সহকর্মীদের ডিউটির সময় কখনো ঠিকমতো বসেও ইফতার করা হয় না। একটা ছোট বোতলে পানি রাখি, দ্রুত খেয়ে নেয় তারা। অধিকাংশ সময় রোগীর প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে ইফতার ছাড়তে হয়।
রোজাদার সহকর্মীদের পাশে থাকার কথা জানিয়ে সিনিয়র স্টাফ নার্স জয়া শিকদার বলেন, ডিউটিতে আমরা যে কয়জন আছি তারমধ্যে অন্য ধর্মেরও আছে। যে রোজা রাখছে আমরা বাকিরা যারা অন্য ধর্মের আছি চেষ্টা করি আমরাই কাভার দিতে। তবে মাঝেমধ্যে ইফতারের সময় কিছুটা রোগীর চাপ কম থাকে। সামাল দেওয়া অসুবিধা হয় না। কিন্তু কখনো কখনো হঠাৎ রোগীর চাপ বেড়ে যায় তখন সবারই ছোটাছুটি করতে হয়।
আরেকজন নার্স রাশেদা খাতুন বলেন, আমাদের সঙ্গে অন্য ধর্মেরও আছে। ইফতারের সময়টাতে একটু সুযোগ বের করে রোজা খুলে নেই। কখনো পুরো ইফতার শেষ করা যায়, আবার কখনো যায় না। তবে এ কয়দিন রোগীর একটু চাপ কম আছে বলা যায়।
এদিকে, রোগীদের রোজা রাখার সুযোগ না থাকায় তাদের জন্য নিয়মানুযায়ী নিয়মিত খাবারের ব্যবস্থা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যদিও রোগীর সঙ্গে থাকা স্বজনরা নিজ উদ্যোগে ইফতার নিয়ে আনেন। তবে হাসপাতাল থেকে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। নিজ উদ্যোগে ইফতার ও সেহরির ব্যবস্থা করেন তারা।
এ বিষয়ে হাসপাতালের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বললেন, ডাক্তার-নার্সদের জন্য নির্দিষ্ট ইফতার ব্যবস্থা রাখা কঠিন। অসংখ্য স্টাফ আছে। চাইলেও সম্ভব না। তাছাড়া প্রশাসনের বড় কর্মকর্তা বা অফিসারদের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করা হয় না। তবে দায়িত্বে যারা থাকেন তারা কেউ চাইলে নিজেদের মতো করে একসঙ্গে ইফতার করে নেন।

ইফতার নয়, দায়িত্বটাই আসল তৃপ্তি : এই আত্মত্যাগের গল্প শুধু চমেক হাসপাতালের নয়, বরং দেশের প্রতিটি হাসপাতালের চিকিৎসকদের জীবনের প্রতিচিত্র। রোগীর সেবাই তাঁদের ইবাদত, আর ব্যস্ততার মাঝেও এক চুমুক পানি বা এক খেজুর—তাতেই ইফতারের পরম সুখ খুঁজে নেন তাঁরা। আর চমেক হাসপাতালের ডাক্তারদের কাছে ইফতার মানেই বিলাসিতা নয়, বরং রোগীর সেবার মাঝে ক্ষণিকের বিরতি।
এ নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বললেন, আমরা জানি, আমাদের কাজটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যস্ততার মাঝেও এক চুমুক পানি আর এক খেজুরই যথেষ্ট। জানি একজন রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে। এটাই আমাদের কাজ।
জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালে পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দিন খান সিভয়েস২৪-কে বলেন, রোগীদের রোজা রাখার নিয়ম নাই। তাদের জন্য নিয়মানুযায়ী নিয়মিত যে ম্যানু আছে সেটাই দেওয়া হয়। আর ডাক্তার নার্সসহ অন্য যারা আছেন তারা নিজ উদ্যোগে ইফতার আয়োজন করে থাকেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের ডিউটি রোস্টার অনুযায়ীই তিন শিফটে ডিউটি চলে। এ সময়টাতে আমরা ইফতারও করছি, নামাজও পড়ছি আবার ডিউটিও করছি। সব সমানতালে চলছে।