এক আলেমের নির্মম হত্যাকান্ড ও আমাদের বিবেকের মৃত্যু

1

মুহাম্মদ জাবেদ হোছাইন

দেশের বাতাস আজ ভারী হয়ে এসেছে। বাতাসে যেন রক্ত আর কান্নার গন্ধ। মানবতা আজ ক্ষত-বিক্ষত। ন্যায়বিচার আজ নিথর। গাজীপুরের পুবাইলে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নির্মম মব জাস্টিস এবং পুলিশের হেফাজতে এক নিরীহ আলেমের মৃত্যু আমাদের সামনে এক ভয়াবহ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে- এ এক নতুন ধরনের স্বৈরাচার, যেখানে সত্য উচ্চারণই যেন অপরাধ, যেখানে মিথ্যা অপবাদরটিয়ে মানুষ হত্যা এখন ‘নতুন ন্যায়বিচার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে!
মাওলানা মুহাম্মদ রইসউদ্দিন একজন শান্তিপ্রিয় আলেম, যিনি দীর্ঘদিন ধরে এলাকার মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ২৬ এপ্রিল তিনি ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মুসলিমদের জন্য ঢাকায় অনুষ্ঠিত আহলে সুন্নাতের ‘ম্যাসগ্যাদারিং ফর ফ্রি প্যালেস্টাইন’ কর্মসূচিতে তাঁর এলাকার লোকজন নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন। এটি ছিল এক মানবিক দায়িত্ববোধের বহিঃপ্রকাশ, বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর প্রতি একাত্মতার সাক্ষ্য। কিন্তু পরদিন সকালে নাশতা করতে বসা অবস্থায় কিছু ব্যক্তি তাঁকে ডেকে নিয়ে যায় ‘কিছু কথা আছে’ বলে। তারপর শুরু হয় নির্মমতা আর ষড়যন্ত্রের কালো অধ্যায়।
স্থানীয় সূত্র মতে, অত্যন্ত সহজ-সরল ও প্রশংসনীয় গুণাবলির অধিকারী তরুণ এই আলেমের জনপ্রিয়তা এবং এলাকার জনগণের ভালোবাসা দীর্ঘদিন ধরে কিছু উগ্র গোষ্ঠীর ঈর্ষার কারণ ছিল। তাঁকে মসজিদ থেকে সরাতে নানা ষড়যন্ত্রের ফন্দি আঁটা হচ্ছিল বহুদিন ধরেই। সর্বশেষ ২৬ তারিখের সমাবেশে তাঁর নেতৃত্ব এবং গ্রহণযোগ্যতা নতুন করে ঈর্ষান্বিত করে এই কুচক্রী মহলকে। তাঁরা কোনো তদন্ত ছাড়াই তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ছড়িয়ে দেয়। তাঁর আকিদা বা মতাদর্শের সাথে ভিন্নমতকে কেন্দ্র করে তাঁকে ‘ভিন্ন মতের’ দোহাই দিয়ে শত্রুতা শুরু করা হয়। আর এই ভিন্নমতের মোড়কে চালানো হয় ভয়াবহ ‘মব জাস্টিস’-যেখানে আইন, মানবতা, সভ্যতাÑ সবকিছু পিষে ফেলা হয় পাশবিক উন্মাদনার পায়ের নিচে।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, কিভাবে তাঁকে নির্মমভাবে রাস্তায় ফেলে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। আর্তচিৎকার, প্রাণভিক্ষাÑ কিছুই যেন এসব পশুর মতো আচরণকারী লোকদের মন গলাতে পারেনি। এত অত্যাচারেও তাঁর মুখে উচ্চারিত হয়েছে কেবল ‘আল্লাহ’- এই একটি পবিত্র নাম। এরপর তাঁকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। প্রত্যাশা ছিল, পুলিশের কাছে পৌঁছালে হয়তো মানবিক আচরণ পাবে, চিকিৎসা পাবে, ন্যায়বিচার পাবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল আরও ভয়ংকর। থানা হেফাজতে তাঁকে অবর্ণনীয় অবহেলার মুখে পড়তে হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি। বারবার পানি চাইলে পর্যন্ত তা দেওয়া হয়নি। এমনকি ভিডিয়োচিত্রে দেখা যায়, মুখের সামনে আনা পানির বোতলটিও কেড়ে নেন নিষ্ঠুর এক পুলিশ সদস্য!
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, পুলিশ কর্মকর্তাদের অবহেলা এমন ভয়ংকর ছিল যে, তাঁরা যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই তাঁর কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছিল। স্বয়ং থানার ওসি বলে বসেন, ‘আমি থাকলে ওখানেই শেষ করে দিতাম!’ এ ধরনের মন্তব্য শুধুমাত্র নির্লজ্জ মানবতা-বিবর্জিত মানসিকতারই পরিচয় নয়; বরং রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের সরাসরি লঙ্ঘন, মানবাধিকারের চরম অবমাননা। পরিণতিতে আহত অবস্থায়ই পুলিশের অবহেলায় ধুঁকতে ধুঁকতে মৃত্যু হয় নিরিহ আলেম রইসউদ্দিনের।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ পুলিশরুলস, ১৯৪৩ অনুযায়ী, পুলিশ হেফাজতে আটক ব্যক্তির চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তা অবিলম্বে নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক (Police Rules, Part IV, Chapter I)। তদুপরি, ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড, ১৮৯৮-এর ৬১ ও ৬২ ধারা অনুযায়ী, থানায় আটক ব্যক্তিকে যথাযথভাবে হেফাজতে রাখা, তাঁর চিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং বিনা বিচারে ২৪ ঘণ্টার বেশি আটকে না রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এখানে স্পষ্টতইপুলিশের এই দায়িত্ব-কর্তব্য চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। তাদের এই দায়িত্বহীনতা ও নিষ্ঠুরতা সরাসরি আইনি অপরাধ এবং মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
বলাই বাহুল্য, এই মৃত্যু আমাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের নগ্ন প্রকাশ। এই মৃত্যু আমাদের রাষ্ট্রীয়অব্যবস্থাপনার জ্বলন্ত দলিল। এই মৃত্যু প্রমাণ করে, মতাদর্শগত ভিন্নতার নামে আজ কীভাবে মানুষকে পশুর মতো হত্যা করা হচ্ছে। এই মৃত্যু একটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার করুণ চিত্র- যেখানে পুলিশ জনগণের নিরাপত্তার প্রতীক না হয়ে মৃত্যুদূত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি নিছক এক ব্যক্তির মৃত্যু নয়; এটি পুরো মানবতার মৃত্যু, এটি আমাদের বিবেকের মৃত্যু।
আজ যে মাওলানা রইসউদ্দিনের নির্মম হত্যাকান্ড ঘটেছে, কাল হয়তো আপনার, আমার বা আমাদের কারও পরিচিত মানুষের পালা আসতে পারে। যদি আমরা এখনই না জাগি, এখনই না প্রতিবাদ করি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যত আরো অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। গণপিটুনির এই নতুন সংস্কৃতি, যেখানে বিচারব্যবস্থা বাতিল করে একদল উগ্র লোক নিজেই বিচারক ও নির্বাহী হয়ে উঠেছে, তা নিঃসন্দেহে একটি ভয়ংকর স্বৈরাচারের জন্ম দিচ্ছে। এমনকি পুলিশিনির্লিপ্ততা এবং দায়িত্বহীনমন্তব্য প্রমাণ করে, আইনের রক্ষকরা এখন অনেক সময় আইন ভাঙার অনুচর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আজ যারা চুপ করে থাকবো, কাল এই ন্যায়ের হত্যাকান্ডে আমরাও ভিকটিম হবো। ইতিহাস সাক্ষী, অন্যায় সহ্য করা অন্যায়কে বৈধতা দেয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যে আলেম-উলামা, সাধারণ মুসলমান, মানবাধিকারকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল হয়েছে ন্যায়বিচারের দাবিতে। এই আন্দোলন আরও বিস্তৃত হোক, আরও শক্তিশালী হোক। কারণ এটি কেবল একজন আলেমের জন্য নয়, এটি আমাদের সকলের জন্য প্রয়োজন।
মতভেদ থাকা স্বাভাবিক। মতভেদের কারণে শত্রুতা নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে সমাধান ইসলামের শিক্ষা। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর বান্দা হয়ে ভাই ভাই হয়ে যাও।’ তিনি কখনো ভিন্নমতপোষণকারীদের উপর অত্যাচার করেননি; বরং তাদের সাথে সহনশীল ও উদার আচরণ করেছেন।
আমরা এই নির্মম হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার চাই। আমরা চাই- যারা মিথ্যা অপবাদ ছড়িয়েছে, যারা নির্মম নির্যাতন করেছে, যারা থানা হেফাজতে চিকিৎসা না দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে- তাদের সবাইকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হোক। আমরা চাই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে এই ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। আমরা চাই থানা কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলার জন্য যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক এবং সর্বোপরি আমরা চাই, দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক, মানবিকতা ফিরিয়ে আনা হোক, মতাদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্তে¡ও সবাই যাতে সম্মানজনক সহাবস্থানের সুযোগ পায়।
আজ আমাদের সেই নৈতিক আদর্শে ফিরে যেতে হবে। আজ আমাদের আবার মানবতা ও ন্যায়বিচারের প্রতি দাঁড়াতে হবে। আজ মাওলানা রইসউদ্দিনের আত্মত্যাগ আমাদেরকে শেখাচ্ছে- বিবেকের জাগরণ ছাড়া কোনো জাতি টিকে থাকতে পারে না। আসুন, আমরা সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। আসুন, একজন শহিদ আলেমের রুহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করি এবং তাঁর মৃত্যু যেন আমাদের মধ্যে মানবতার নবজাগরণ ঘটায়। মহান আল্লাহ শহিদ মাওলানা রইসউদ্দিনকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন। আমিন।
লেখক : আইনজীবী, কবি ও কলামিস্ট