এক অদম্য ছাত্রের অভীষ্ট লক্ষ্য এবং মা-বাবার প্রত্যাশা

1

মিঞা জামশেদ উদ্দীন

‘জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভালো।’ এটি জন্ম নিয়ে বহুল আলোচিত প্রবাদবাক্য। এ প্রবাদবাক্য জানেনা এমন লোকের মেলাবার। জন্ম নিয়ে এতো বৃত্তান্ত বলার কারণ হলো, এ অধমের জন্মদিন পালনের আকাক্সক্ষা বা বাসনার ইতিবৃত্ত- এটি যেন গরিবের ঘোড়া রোগ হওয়ার সামিল। যার ঢাল নেই তলোয়ার নেই, তারই আবার কিসের জন্মদিবস; এমনিতে জন্ম দিবসের যা না ফিরিস্তি আছে। কেউ কেউ জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়। সেইসব বিতর্কিত জন্মদিবস পালন করার চাইতে নিরব থাকা শ্রেয় নয় কি?
এমনিতে মাঝে মাঝে নিজের নাম পর্যন্ত ভুলে যাই। এমন চিন্তা-ভাবনা মোটেই কাক্সিক্ষত না; কিন্তু যত সমস্যা হলো সামাজিক প্লাটফর্মের। দীপ্তি ঘুমের ঘোরে দিন অতিবাহিত, অর্থাৎ দিনের সাড়ে দশটা চেতন হওয়ার অভ্যসে পরিণত হয়েছে। অনেকটা বাপের কাঁধে বন্দুক রেখে গলধঃকরণ। অবশ্য বাবা না ফেরার দেশে চলে গেছেন ১৯৯৯ সালের ৪টা মার্চ রাত ১.১৫ টায়। বাবা কবিয়াল সেকান্দর মিয়া-এর কথা মনে আসলে শুধু দীর্ঘশ্বাস আসে। আল্লাহ্ আমার বাবার মতো সকলের বাবাকে বেহ্শেত নসিব করুন।
অবশ্য এখন গা-গা থাকা। বলতে হয় জন্মটাই অসার; কিন্তু অবস্থা বেঁধে এমনই অনুমেয়। হ্যাঁ, প্রভাতে সূর্য দেখে বুঝাযায় দিনটা কেমন যাবে; কথা আছে, জীবনে যারে দাওনি মালা মরনে কেন দিতে এলে ফুল। যাক, এ অভাগার জন্মদিনটাও ঘটা হয়ে প্রবাহের ক্ষণকালে। জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৬৯ খ্রী। ওইদিন নাহয় কমকরে হাজারো লোকের জন্মদিন। বিশিষ্ট ছড়াকার ও সাংবাদিক রাসেদ রউফ, কবি, শিক্ষক ও প্রকাশক শামসুদ্দিন শিশির, কবি, সাংবাদিক ও লিটলম্যাগ সম্পাদক এজাজ ইউসুফি, প্রকাশ আফসার উদ্দিন, কবি, প্রকাশক ও প্রফেসর রুহুল রুহুল প্রমুখের। যা কিনা স্কুলে মাস্টার মশাইয়ের বদৌলতে। অর্থাৎ নবম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশান করতে গিয়ে আরোপিত-এ জন্ম তারিখ কপালে জুটে যাওয়া। তবে আমাদের বেলায় একটু ভিন্ন আছে। বিশাল পরিবার। ১৪ জন ভাইবোন। তাহলে কি করেই দিনক্ষণ স্মরণে বা টুকে রাখে গুরুজনেরা। তখনও শিক্ষার হার ছিল যতসামান্য। বলতে হয়, ঊনিশ শতকের শেষার্ধে পর্যন্ত মুসলিম পরিবারগুলো শিক্ষাদিক্ষায় অনেকটা পিছিয়ে ছিল। বিংশশতাব্দীতে এসে একটু নড়েচড়ে ওঠে। এখন ঘরে ঘরে শিক্ষিত মা-বোন। এবং জন্মের দিনক্ষণও লিপিবদ্ধ করার মতো যথেষ্ট অবস্থা আছে। সঙ্গে ঘটা করে এবং নানাভাবে পালন করা হয় জন্ম দিবসও। কেউ কেউ বর্ণিল-বনাঢ্যতা ছেড়ে যায় আয়োজনে। সর্বশেষ জীবিত সাত ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম এবং চৌদ্দজনের মধ্যে এগারোতম।
যেকথা না বললে নয়, রাত ১২টা ১মিনিট থেকে বন্ধু- বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীরা উইশ করতে থাকে জন্মদিনের। অনেকে ফোন করে অভিনন্দন ও ভালোবাসা জানালেন। আবার কেউ কেউ একপায়ে খাড়া- আপনি কোথায়, আসুন এবং আপনার জন্মদিবস পালন করা হবে! আমি বাবু সোজাসাপটা উত্তর দিই, ওইসবে আমি নেই কেককাটা, বেলুন উড়ানো, মোম প্রজ্বলিত করা- হ্যাঁ, বড়জোর চেরাগির মোমিনের দোকানের গরম গরম শিঙ্গাড়া, ডালপুরি, আলুর চপ খাওয়া যেতে পারে। যথাসময়ে সন্ধ্যায় মোমিন সওদাগরের দোকানে যাঁরা উপস্থিত হলেন। তবে ঘটা করে না হলেও তিন দফা বিল পরিশোধ করতে হয়। প্রায় হাজার টাকা ধাক্কা লাগে। তবুও আমার মত অক্ষত জনের জন্মদিন পালন করা হবে! আমি কেন, যেকেউ ফুলকিত হবে। কেউ কেউ একগুচ্ছ রজনীগন্ধা-গোলাপ দিয়ে ভালোভাসায় সিক্ত করেন। অগ্রজ কবি ও প্রফেসর হোসাইন কবির, প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কবি প্রদীপ খাস্তগীর, তরুণ শিল্পপতি জিয়াউর রহমান, বিনোদন সাংবাদিক ও গীতিকার আশিক বন্ধু, সাংবাদিক ও সংগঠক খ ম জিয়া, সংগঠক আসিফ ইকবাল, কবি নির্লয় দে, সাংস্কৃতিক সংগঠক তুষার দে, আবৃত্তি শিল্পী মো. হামিদ, সাংবাদিক রোজিসহ অনেকে উপস্থিত থেকে কৃতার্থ করেছেন। সঙ্গে সংগঠক ও কবি শাহরিয়ার পারভেজ তার ফেইজে ছবিসম্বলিত উইশ করা এবং ৫৫ তম জন্মদিনে অনলাইন চ্যানেল ‘চট্টল ভয়েস’ বিশেষ সাক্ষাৎ প্রচারসহ সাক্ষাৎ গ্রহণে আবৃত্তি শিল্পী ও সাংবাদিক খ ম জিয়াকে অভিবাদন।
তবে শরীরটা কেমন ভালো যাচ্ছে না। এমনিতে চোটের ক্ষত বহন করে চলেছি। এরমধ্যে সাটার (দরজা) ওঠাতে গিয়ে ডানপাশের কোমড় বরাবর টান লেগে যায়। একটু একটু ব্যর্থাও অনুভব করছিল। প্রথম কয়েকটিন এভাবে চলে গেল। এরমধ্যে একরাতে সিএনজি অটোরিকশা করে বাড়ি ফেরা কালে ঠান্ডা পেয়ে বসে। গায়ে যথাযথভাবে কোড, চুয়েটার ও মাফলার ছিল। তারপরও প্রচন্ডভাবে ঠান্ডা পেয়ে বসে। একেবারে কনকনে ঠান্ডা। বিশেষ করে শীতের এ মৌসুমে কোনভাবেই অটো- সিএনজির পেছন সিটে বসা একদম ঠিক না। যদি বসা হয় পদ্মা টেনে বসা উচিত। সিএনজির কনকনে বাতাসে নিউমোনিয়া আক্রান্ত হওয়ার সমুহ সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য মহা বিপদ সংকেত! একেভারে নাক-মুখ ডেকে না বসলে, কোন জারিজুরিতেও কাজ হবে না, নিশ্চত রাতের মধ্যেই হাসপাতালে যেতে হবে। এর মধ্যে এজমা জনিত রোগে যারা আক্রান্ত, তাদের জন্য মোটেই সহনীয় নয়। তাই শীতকালে, বিশেষ করে রাতে সিএনজি এড়িয়ে চলা উচিত।
দ্বিতীয় দিন মেজোবোনের বাড়িতে যাওয়া। সঙ্গে বড়বোনও রয়েছেন। মুলত এক সাথে যাওয়া। যাওয়ার কথাছিল টেক্সিক্যাপে করে। কিন্তু টেক্সিক্যাপের সংকটে যেতে হয়েছে বাসে করে। তবে বাসে করে যাওয়াটা সমস্যা কিছু না। বারৈয়ারহাট থেকে করেরহাট-শুভপুর পর্যন্ত যেতে হবে অটো চালিত সিএনজি করে। পথে বাসে দেখি শীতের চুয়েটার মাফলার আনা হয়নি। আসতে বড়বোনের বাসায় রেখে আসি। কিন্তু গায়ে যথাযথভাবে কোট রয়েছে। দিনের দুটার দিকেও সিএনজি চড়ে যেতে গিয়ে একটু একটু ঠান্ডা পেয়ে বসে। এটি রাতে মালুম হয়নি। শোয়ার-সময় নাক থেকে বিনা খবরে পানি ঝরতে থাকে। দ্বিতীয় দিন এটি আরো বেশি মালুম হলো ফেরার কালে। আমরা পেছনের সিটে তিন যাত্রী বসি। সেই যথাযথভাবে অটো চালিত সিএনজি। অবশ্য অটো-সিএনজি ছাড়া বিকল্প নেই। আমরা পেছনের সিটে যে-ই তিন যাত্রী বসেছি, তারমধ্যে একজন বয়োঃবৃদ্ধ নারী। হতদরিদ্র হবে, পোশাকে আশাকে তা বুঝা যাচ্ছে। দ্বিতীয় জন তরুণ। যা বলতে যাচ্ছি, কতটুকু যাওয়ার পর পেছনের আমরা তিন যাত্রী সমানে খুক খুক কাশতে থাকি। তরুণ যাত্রীর কাশির হার কম হলেও বৃদ্ধ-মহিলাটি দম ফেলতে পাচ্ছে না রীতিমতো। আমিও কোনভাবেই চেপে যেতে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু অটোর সামনের দুই যাত্রীর কোন মালুমই হয়নি বা সেরকম আলামত দেখা গেল না। এটি ছিল বিষয়টির উপর অনুসন্ধান চালানো বা গবেষণার প্রাথমিক পর্ব বলা যেতে পারে। এর শেষও আরো কয়েক পর্ব আছে। তৃতীয় দিন এ ঠান্ডা প্রকোপে পা পর্যন্ত বাড়াতে পাচ্ছি না। পুরো একপাশ ধরে আছে। রীতিমতো হাসপাতালেও যেতে হয়েছে। ডাক্তার জানালেন, রেস্ট করতে হবে। কিন্তু দায় হলো, আমরা তৃতীয় বিশ্বের লোক, চাল নেই চুলো নেই, ধরারও দড়ি নেই। তাহলে বিশ্রামে যাওয়া হবে কোত্থেকে। মুল যে-ই বিষয়টি। সেটি হলো ভাগিনা সৌরভ কম্পিউটার সাইন্সে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনে কানাডা গমন। সে রাত ১২টার দিকে বাড়ি থেকে ঢাকা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হবে ভাগিনা। তারপর দিন ১২ জানুয়ারি দুপুর ১২টায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে থেকে তাদের প্লেন ছেড়ে যাবে। সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে চলছে। সেই এক দীর্ঘ পরিক্রমা। তার মা অর্থাৎ আমার মেজোবোনের অক্লান্ত পরিশ্রম। অসহনীয় পরিবেশ ও দুঃখ-কষ্টকে সহে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো। মেজোবোনের স্বামী একজন স্কুল শিক্ষক। ছেলেদের লেখাপড়ার ব্যয় ও সংসারের ভরণপোষণের ভারবহন করা। সে-কি কলুর বলদের মতো খাটুনি। তাতেও ক্রান্তি হিসেবে নেয়নি। যাক, শেষ হাসি দেখার বাসনা পুরোন হলো। অবশ্য তাতো কখনো একা সম্ভব হয় না; অর্ধাঙ্গিনীর যদি সহযোগিতার হাত না বাড়ায়। আমাকেও মাঝে মাঝে কালের সাক্ষী হয়ে থাকতে হয়। বলি, একসময় না একসময়ে অধরা হাতের মুঠোয় আসবেই।
ভাগিনা তানভীর হাসান সৌরভ ২০২৩ সালে ঢাকাস্থ আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সাইন্সে (অনার্স) ব্যাচলর ডিগ্রি অর্জন করে। এরপর মনোনিবেশ হয় অভিসন্দর্ভ সম্পন্ন করা। তাঁর অভিসন্দর্ভ ছিল ‘প্লাগিমারিজম ডিটেকশন ইউসিং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’। সেটি প্রকাশিত হয় আইজেসিআইএম (ইন্টরন্যাশনাল জার্নাল অব. কম্পিউটার এন্ড ইনফরমেশন সিস্টম) জার্নালে। এরপর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনে আরো অধ্যয়ন। এরজন্য আমেরিকা অথবা কানাডা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার আগ্রহ ছিল। দুই দেশ থেকে ভালো রেসপন্স পায়। সর্বশেষ কানাডার একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘কনকর্ডিয়া ইউনিভার্সিটি’তে দীর্ঘমেয়াদী দুবছরের কম্পিউটার সাইন্সের ওপর এমএসসি-উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করার অধ্যয়ন। এ বিশ্ববিদ্যালয় কানাডার একটি প্রদেশ-কুইবেক প্রদেশের মন্ট্রিয়াল সিটিতে অবস্থিত। ভাগিনা তানভীর হাসান সৌরভ শিশুশ্রেণি থেকে মের্ধার স্বাক্ষর রেখে আসছে। সে ২০১৫ সালে ছাগলনাইয়া বল­ভপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি (বিজ্ঞান) ও ২০১৭ সালে ফেনী মৌলভী শামছুল করিম কলেজ থেকে এইচএসসি (বিজ্ঞান) উর্ত্তীণ হয়। ভাগিনা সৌরভরা তিন ভাই। বড়ভাই মেহেদী হাসাব শুভ ব্যাংকার, ছোটভাই মাহমুদুল হাসান গৌরব অধ্যয়নে আছে। সে ভাইদের মধ্যে মেজ। তাঁর বাবা আব্দুল মান্নান মাস্টার একটি স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষক। মা রওশ আরা বেগম গৃহিনী এবং আমার মেজবোন। তাকে বিদায় সম্ভাসন জানাতে আমরা আমন্ত্রিত হই। তার বড় খালা আনোয়ারা বেগম ও ছোট খালা সাজেদা বেগম এবং বড় খালার বড় মেয়ে হাসিনা আক্তার ও মেয়ে ইকরা মণিকে সঙ্গে নিয়ে সমাবেত হয় তাদের বাড়ি মিরসরাই উপজেলায় করেরহাট ইউনিয়নের জোয়ার পূর্বজোয়ার গ্রামে। দিনবর খাওয়া-দাওয়া, গল্পগুজব ও খুনসুটি নিয়ে মেতে থাকা। সঙ্গে ছবি সেশনও হয়। তাঁর মা-র মাথার ওপর তার গ্রেজুয়েট ডিগ্রির-ক্যাপ পরিয়ে দেয়া; সেই এক অপরূপ ক্ষণ। যা চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলামিস্ট