একুশে চেতনা : ছাত্র আন্দোলনের প্রেরণা

1

মাওলানা এম সোলাইমান কাসেমী

বাংলাদেশের অভ্যুত্থানে ছাত্র আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে অধিকার আদায়ে মাঠে নেমেছে শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের এক অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালে, ঢাকার ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনে নামে। ২১ ফেব্রুয়ারি, ছাত্রদের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পরিণামে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়। ১৯৬৯ সালে, বাংলাদেশের ছাত্ররা পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান গড়ে তোলে। এই আন্দোলনে ছাত্ররা মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। একুশে ফেব্রæয়ারি আমাদের মহান মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্ররা মাঠে নামে। আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিতে অনেক তরুণসহ রফিক, জব্বার, শফিউল, সালাম, বরকতসহ অনেকেই শহীদ হন। তাই এ দিনটি ইতিহাসে শহীদ দিবস হিসেবেও সমধিক পরিচিত। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা- ইউনেস্কো এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এতে সারাবিশ্ব ভাষার জন্য আমাদের ত্যাগ, আন্দোলন ও সংগ্রাামের সাথী।
প্রতিবছর সারা বিশ্বে এ দিবসটি গুরুত্বসহকারে পালিত হয়। কোন নির্দিষ্ট দিন, কোন মহৎ দিন কখনো কখনো জাতীয় জীবনে যুগান্তরের সম্ভাবনা নিয়ে আসে। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে তেমনি একটি দিন। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার স্মৃতি চিহ্নিত দিন। এ দিনটি সংগ্রামের আগুনে জলন্ত। এ দিনটি রক্তাক্ত আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। এ দিনটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের প্রতি মুহূর্তে গতিময়, প্রাণবন্ত এবং তাৎপর্যপূর্ণ দিন। একুশ আমাদের যাত্রা পথের তোরণদ্বার। একুশ আমাদের মাতৃভাষার অহংকার। একুশ আমাদের ন্যায্য ও সত্য দাবির বহিঃপ্রকাশ। একুশ বাঙালি জাতির জীবন্ত ইতিহাস। একুশের চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনের বীজমন্ত্র। আন্দোলন-সংগ্রামের উদ্ভব হয়েছিল, তার শপথ গৃহীত হয়েছিল একুশের চেতনায়। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই পূর্ব বাংলার অধিকার-বঞ্চিত মানুষগুলোর প্রথম সংগঠিত সংগ্রামের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল।চুয়ান্ন’র নির্বাচন, বাষট্টি’র শিক্ষা আন্দোলন, ছয়-দফা, উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান এবং স্বাধীনতাযুদ্ধসহ সকল আন্দোলন সংগ্রামে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে এই একুশে। এই একুশের চেতনায় পরিনতি লাভ করেছিল স্বাধীনতা লাভের নিরঙ্কুশ বিজয়ে।
একুশ ভাষা আন্দোলনের প্রতিভূ হলেও বস্তুত এর প্রতীকীরূপ বাঙালির প্রাণের দাবি স্বাধীনতা। অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির আন্দোলনের ফসল বাংলাদেশ। পৃথিবীর মানচিত্রে লাল-সবুজের পতাকা। একুশ আমাদের নিরবধি সংগ্রামের অঙ্গীকার। মিছিলে, সড়কে, বন্যায়, উন্নয়নে একুশ আমাদের নতুন শপথ। একুশ আমাদের বিশ্বাস, বিজয়ের অঙ্গীকার। একুশ আজ বসন্তের লাল পলাশ। একুশ আজ আমাদের স্বাধীনতা। আমরা জানি, মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি- এই তিনটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের জীবন এবং আমাদের অস্তিত্ব। আমাদের প্রত্যেকের রক্ত, মাংস ও সত্তার পরতে পরতে মিশে আছে মা। আমাদের সুঃখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আকুলতা-ব্যাকুলতা প্রকাশের ভাষা আমাদের মাতৃভাষা-বাংলা। আর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের পরম আশ্রয় আমার দেশ, আমাদের মাতৃভূমি। তাই মা, মাতৃভাষা এবং মাতৃভূমির কাছে আমাদের মন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় নুইয়ে পড়ে। তাই, ভাষা ও মাতৃভূমির গৌরবে, মর্যাদায় মন আমাদের আনন্দে উদ্বেলিত হয়। দীর্ঘ ৪৭ বছর পর ইউনেস্কো’র স্বীকৃতিদানের মধ্য দিয়ে আমাদের ভাষা আন্দোলন বা ২১ ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাদেরকে মর্যাদাবান করেছে। মহিমান্বিত করেছে। তাই প্রত্যেক দেশের মাতৃভাষা উন্নয়নে আমাদের একযোগে কাজ করতে হবে।
আজ বাঙালি জাতি একুশের চেতনা ভুলে গিয়ে দ্বিধা বিভক্ত। ফলে অনেক অর্জন বিভিন্ন সময়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমি বিশ্বাস করি, একুশের দৃঢ় প্রত্যয় আমাদের সহায়ক শক্তি। “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো/ একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি তোমাকে ভুলিতে পারি”। আমরা ভুলিতে পারি না। ভুলবো না। কোন অন্যায় আমরা মানি না। কোনো অপশক্তি আমাদের ‘দাবায়ে রাখতে পারবে না’। আসুন, একুশের চেতনায় সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলি। একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হই। একুশ আমাদের শিখিয়েছে-মাথানত না করা। একুশ আমাদের শিখিয়েছে দেশকে ভালোবাসতে। একুশ আমাদের শিখিয়েছে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধিতে কাজ করতে। দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে। আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে একুশে ফেব্রুয়ারি হাজার তারের এক বীনা। তাতে কত না সুর, কত না ঝংকার। একুশের এ বীনায় ঝংকৃত হয়েছে আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি। আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে একুশ একাধারে ইতিহাস ও ঐতিহ্যি, গৌরবগাঁথা ও প্রেরণা। আমরা মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দিতে পেরেছি। একুশের পথ ধরেই আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। তাই মহান একুশে এদেশের ইতিহাসে ‘আপোসহীন সংগ্রাম ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। একুশ হোক আমাদের সকল অনৈক্য ও সংঘাতের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ হাতিয়ার। একুশ হোক আমাদের উন্নয়নের আশার প্রদীপ। একুশ হোক আমাদের সচেতনা, শিক্ষা ও উন্নয়নের আলোকবর্তিকা। একুশের এই চেতনা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আমাদের আরো কাজ করতে হবে। নতুন প্রজন্মের চেতনাকে আরো শাণিত করতে হবে।

লেখক : পিএইচডি গবেষক, চ.বি.