ডা. দুলাল দাশ
কিডনী রোগ নিয়ে এই লেখাটা বর্তমানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যক। কারণ নিরব ঘাতক কিডনী রোগ এ দেশে মহামারি পর্যায়ে আসার অপেক্ষায় আছে। ধ্বনিত হচ্ছে অশনি শংকেত। কিডনী রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। তাই প্রত্যেকের প্রতি বিশেষ করে দরিদ্রদের প্রতি আবেদন থাকবে একমাত্র স্বাস্থ্যসচেতনায় আপনাকে ৬০-৭০ ভাগ এই রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে। নচেৎ নি¤œ মধ্যবিত্ত ও দরিদ্রদের নিশ্চিত মৃত্যু।
সুতরাং সাবধনাতার মাইর নাই কিডনী রোগকে নিরব ঘাতক বলা হয়। কারণ কিডনী যতক্ষণ ৭০- ৮০ ভাগ রোগগ্রস্ত না হবে তার কোন লক্ষণই বুঝা যাবেনা। যেহেতু লক্ষণ থাকেনা তাই লোকেরা ডাক্তারের কাছে যায়না। তাতে চিকিৎসা পেতে দেরি হয়। কিডনী রোগের একপর্যায়ে ডায়ালাইসিস (মেশিনে রক্ত পরিষ্কার করা) ও কিডনী প্রতিস্থাপন ছাড়া রোগীকে বাঁচান যায়না। খুবই ব্যয়বহুল চিকিৎসা। দেশের বিপুল সংখ্যক ৮০% লোক বুঝতে পারেনা তাদের কিডনী রোগ আছে। কিডনী মানবদেহের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিডনীকে মানবদেহের ছাকনি বলা হয়। পেটের দুই পাশে এদের অবস্থান। একটা ডান কিডনী অন্যটা বাম কিডনী। ইহা রক্ত শোধনোর মাধ্যমে প্রশাবের সাহায্যে শরীর থেকে বর্জ্য অপসারণ করে কোন কারণে ইহার ব্যাঘাত ঘটলে রোগের আবির্ভাব হয়। পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশে প্রায় চার কোটির মত লোক কিডনী রোগে আক্রান্ত। বছরে ৩০হাজার কিডনী রোগী শেষ পর্যায়ে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৫৭% দীর্ঘস্থায়ী কিডনী রোগী প্রতি বছর কিডনী বিকল হয়ে ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়। সুতরাং খুবই ভয়াবহ অবস্থা। তাই একমাত্র সচেতনতায় পারে এই রোগকে প্রতিরোধ করা। এই রোগের আকস্মিক লক্ষণগুলো হলো প্রশ্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া বা প্রশ্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া। প্রশ্রাবের রং গাঢ হওয়া, শরীরে পানি জমে যাওয়া। পা ও মুখ ফোলা, শ্বাস কষ্ট, ক্লান্তি, বমি, রক্তচাপ কমে যাওয়া, যারা কিডনী রোগে ভুগছেন, তাদের পিটে ব্যথা উপরের দিকে নয়, নিচের দিকে, এটার গুরুত্ব দিতে হবে। বার বার প্রশ্রাব করা, মাঝেমধ্যে প্রশ্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া, বা প্রশ্রাবের সাথে অতিরিক্ত ফেনা, ওজন কমে যাওয়া। কিডনী রোগের সাধারণ কারণগুলো হল নেক্নাইটিস, ইনফেকশ (সংক্রমণ), ডায়রিয়া, পানি শূন্যতা, অতিরিক্ত রক্তকরণ এইগুলির চিকিৎসা অবহেলা হলে কিডনী রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। বিষাক্ত খাবার বিষ, দোকান থেকে অযথা ব্যাথানাশক ঔষধ কিনে খাওয়া, প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিব্যায়োটিক ব্যবহার প্রভৃতি। এছাড়া জন্মগত কিছু ত্রুটির কারণে কিডনী বিকল হতে পারে। আমাদের দেশে কিডনী রোগের চিকিৎসায় অনেক উন্নতি হয়েছে। অত্যাধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে পেট না কেটে কিডনীর পাথর, মূত্রনালীর পাথর, মূত্রথলির পাথর বাহির করা হয়। বিশ্বমানের সফলতা দাবি করা যায়। সফলতার সাথে কিডনী প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। উপযুক্ত সময়ে এই পাথরগুলি অপারেশন না করলে অতিদ্রুত কিডনী অকার্যকর হয়ে যাবে, এমনকি কিডনী ফেলে দিতে হবে। তাই এখানেও সচেতনতার খুবই দরকার এবং জরুরী। শুধু অবহেলা এবং আর্থিক কারণে কতরোগীর জীবন রক্ষার্থে কিডনী ফেলে দিতে হয়। কারণ এই পাথর বা টিউমার প্রশ্রাবের গতিপথ বাঁধাগ্রস্ত করে ফলে কিডনীতে পানি জমে, পুইজ জমে কিডনী নষ্ট হয়ে যায়। কিডনী রোগের অন্যান্য কারণের মধ্যে ডেঙ্গু, কলেরা, সেপটিসেমিয়া (রক্তকরণ)। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রাপ্ত বয়স্কদের কিডনীরোগের প্রধান দুইটি ক্রণ ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ। যাদের দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ থাকে তারা খুবই ঝুঁকিপুর্ণ। কিডনীর কার্যকারিতা ভালো আছে কিনা নিয়মিত দেখা সচেতনতার মধ্যে পড়ে। রক্তে ক্রিয়োটিনিন, ইলেকট্রোলাইট, ব্লাড ইউরিয়া, জিএফআর পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া রক্তচাপ, রক্তে শর্করার মাত্রা দেখা উচিত। ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাস, প্রতিদিন বেশি বেশি প্রোটিন খাওয়া, অতিরিক্ত লবণ, পরিশ্রমহীন জীবন, স্হুলতা, হৃদরোগের পুর্ববর্তী ইতিহাস প্রভৃতি। ডায়াবেটিসকে বিশেষভাবে টার্গেট করা হয়েছে। কারণ ২০২৫ সালের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে। ডায়াবেটিক কিডনী রোগ বেড়ে দীর্ঘস্থায়ী কিডনী রোগে পরিণত হতে পারে। সুতরাং ডায়াবেটিস রোগীরা আরও বেশি সচেতন হউন। কিডনী সুস্থ রাখার উপায় রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখা। রক্তে অ/প পরীক্ষা (লক্ষ্য ৭% নিচে) রক্তচাপ ১৪০/৯০ মি.মি. এম এর নিচে। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম, ওজন ঠিক রাখা, লবণ সীমিত খাওয়া, অ্যালকোহল পরিহার, পাতলা লবণ না খাওয়া, প্রতি সকালে খালিপেটে ২-৩ গ্লাস পানি পান করা, প্রশ্রাব উঠলে ধরে না রেখে সাথে সাথে করে ফেলা, অতিরিক্ত প্রোটিন (মাংস) জাতীয় খাবার কিডনীর প্রতিকারক। টেলিফোন করলে জ্যাক ফুড বাসায় দিয়ে যায় যা ক্ষতিকর। একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক লোক শুধু পানি খাওয়ার অভ্যাস করলে এই রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। সাধারণ নাগরিক ও গরিবদের জন্য বলা যায় শুধু প্রশ্রাব ও একটু রক্ত পরীক্ষা করলে কিডনী ভালো আছে কিনা বুঝা যায়। সারাদেশে গড়ে সাড়ে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক আছে ও হাসপাতাল আছে। সেখানে বিনাপয়সায় এই পরীক্ষাগুলো করান। ২৫ বছর বয়স থেকে রাজু মিঞার উচ্চ রক্তচাপ। কিন্তু সে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ফলে তার কিডনী অকেজো হয়ে যায়। রাজু মিঞার মত হাজার হাজার ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগী আছে যারা শুধু অবহেলার কারণে চিকিৎসা নেয়না। নিয়মিত ঔষধ খায়না, খাদ্যভাস পরিবর্তন করেনা, কোন নিয়ম পালন করেনা আস্তে আস্তে তাদের কিডনী বিকল হয়ে পরে। তখন উপায়ন্ত না দেখে হাসপাতাল ও ডাক্তারের কাছে ছুটে। তখন ডাক্তারের কিছুই করার থাকেনা। ডায়ালাইসিস বা কিডনী প্রতিস্থাপন একমাত্র চিকিৎসা। পরিসংখ্যান বলছে ১৯৯০ সালে অন্যান্য রোগ অনুপাতে কিডনী রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৯তম। বর্তমানে সেটা ৭ম স্থানে এসে দাঁড়িযেছে। সচেতনতার সুরে বলছি কিডনী রোগ শরীরে বাসা বাঁধলে হৃদরোগে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি বেড়ে যায়। আমার জানামতে উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা নিয়মিত ঔষধ সেবন করেনা, ডাক্তারের পরামর্শ শুনেন না। নিজে নিজে প্রেসারের ঔষধ বন্ধ করে, আবার শুরু করে এবং সবচেয়ে বেশি ঝুঁতিতে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া প্রেসারের ঔষধ বন্ধ করা যাবেনা। আশার কথা হলো একটু সচেতন হলে ৬০-৭০ ভাগ ক্ষেত্রে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়। কিডনী সুস্থ রাখতে হলে চল্লিশোর্ধ্ব সকল নাগরিকের উচিত কিডনী পরীক্ষা করা। যারা উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে ভুগছেন তাদের কিডনীকে অবহেলা নয়। মনে রাখবেন প্রশ্রাবের ইনফেকশন ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথরের প্রাথমিক মহোষুধ বিনাপয়সায় পানি। প্রতিদিন প্রচুর পানি সেবন করুন। ইনফেকশন চলে যাবে। পাথর বাহির হয়ে যাবে। চিকিৎসকের নিকট গিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হবেনা। শিশুদের চর্ম রোগ থেকে ইনফেকশন হয়ে কিডনী রোগ হতে পারে, তাদের পা, মুখ ফুলে যায়। পেটে পানি আসে, তাই অবহেলা না করে অতিদ্রুত চিকিৎসা করা দরকার। সুযোগ ও সামর্থ্যের অভাবে চিকিৎসা না পেয়ে বেশিরভাগ রোগীর কিডনী বিকল হয়ে যায়। আপনি যদি কিডনী সুস্থ রাখার নিয়মগুলি পালন করেন বা অভ্যাস করেন তবে কিডনীরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাতে জীবন দীর্ঘায়িত হবে, খরচ কমবে। খেয়াল রাখা দরকার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, খাদ্য মাত্রাতিরিক্ত ভেজাল, ক্যামিক্যাণ মিশানো খাবার ও মবিল ও পুরোনো তেলপোড়া খাবার কিডনী রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই পরিহার করুন, পরিশেষে এই রোগ থেকে বাঁচার জন্য দেশব্যাপী সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। গ্রামে গঞ্জে, হাটে বাজারে, মেলায়, সিনেমার পর্দায়, ফেসবুক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, মিল- ফ্যাক্টরীতে পোষ্টারিং, লিপলেট বিলি দরকার। আমেরিকান একজন কিডনী বিকল রোগী সেফ গ্লোজার শুরু করেছিলেন সামাজিক আন্দোলন। ডায়ালাইসিস অবস্থায় মেশিন সহ যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ঢুকে পড়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কিডনী রোগীর অধিকার আইন বাস্তবায়ন করতে বলেছিলেন। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার একমাত্র কিডনী রোগের চিকিৎসার ভার বহন করে। সুতরাং মনে রাখবেন কিডনী সুস্থ থাকলে আপনি ভালো থাকবেন, আপনার হার্ট ভালো থাকবে। একেবারে শেষকথা বেশি বেশি পানি পান করার অভ্যাস করুন, আপনার কিডনী সুস্থ রাখুন।
লেখক: প্রাক্তন চীফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।