একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতীক্ষায় একটি জাতি

1

মুহাম্মদ জাবেদ হোছাইন

পৃথিবীর ইতিহাসে কিছু সংকট দীর্ঘকাল ধরে জাতিসংঘের প্রস্তাব, মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন, সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম ও সাধারণ মানুষের সহানুভূতির কেন্দ্রে থেকেও কোনো স্থায়ী সমাধান পায়নি। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত এমনই এক ইতিহাসবিদ্ধ মানবিক বিপর্যয়, যা আধুনিক সভ্যতার বিবেককে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিশেষ করে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া গাজা উপত্যকার ওপর ইসরায়েলিবর্বর হামলা ও ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর তীব্র দমন-পীড়ন নতুন করে বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। যখন একটি জাতি পঁচাত্তর বছর ধরে ভূমিহীন, স্বপ্নহীন এবং অধিকারহীন হয়ে বেঁচে থাকেÑ তখন সেই ইতিহাস শুধু শোকগাথা নয়; বরং এক দীর্ঘ রাজনৈতিক অপরাধের দলিলও বটে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ একটি বিতর্কিত প্রস্তাব গৃহীত করে, যাতে বলা হয়Ñ ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত প্যালেস্টাইন অঞ্চলে একটি ইহুদি রাষ্ট্র ও একটি আরব রাষ্ট্র গঠিত হবে। প্রস্তাব অনুযায়ী ইহুদিদের জন্য ৫৬ শতাংশ এবং আরবদের জন্য ৪৪ শতাংশ জমি বরাদ্দ করা হয়, যদিও সে সময় প্যালেস্টাইনের ৯০ শতাংশ জনগণ ছিল আরব। এই প্রস্তাব আরবরা প্রত্যাখ্যান করে; কিন্তু ইহুদিরা তা গ্রহণ করে নেয়। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয় এবং পরদিনই আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের ফলে সাত লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি তাঁদের ঘরবাড়ি, জমি ও ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হন। এই ঘটনাকে ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা’ বা ‘বিপর্যয়’ নামে অভিহিত করেন, যা আজও তাদের জাতীয় জীবনের গায়ে গভীর ক্ষত হয়ে রয়ে গেছে।
ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরপরই জাতিগত শুদ্ধিকরণ (বঃযহরপ পষবধহংরহম) নীতিতে বহু ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহর ধ্বংস করা হয়। অনেক জায়গায় ইহুদি বসতি স্থাপন করা হয়। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল আরেকটি বড় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, যা ইতিহাসে ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে ইসরায়েল ফিলিস্তিন ভূখÐের পশ্চিম তীর, গাজা, পূর্ব জেরুজালেম, পাশাপাশি সিরিয়ার গোলান হাইটস ও মিশরের সিনাই উপত্যকা দখল করে। যদিও পরে মিশরের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে সিনাই ফেরত দেওয়া হয়। তবে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে দখলদারিত্ব আজও অব্যাহত রয়েছে। সেখানে ইসরায়েলি বসতি গড়ে ওঠে, যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবৈধ। এই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ বারবার রেজোলিউশন পাস করলেও তা উপেক্ষিত থেকে যায়।
আজকের ফিলিস্তিনিদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। পশ্চিম তীর জুড়ে রয়েছে শত শত চেকপয়েন্ট, সুরক্ষিত দেয়াল ও সেনা ক্যাম্প। ফিলিস্তিনি নাগরিকদের চলাচলে কড়াকড়ি, কৃষিজমি দখল, বাড়িঘরধ্বংস এবং নির্বিচারে গ্রেফতার-নিপীড়ন তাদের প্রতিদিনের বাস্তবতা। গাজার চিত্র আরও ভয়াবহ। ২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েল গাজার ওপর কঠোর অবরোধ আরোপ করে রেখেছে, যা গাজার মানুষকে কার্যত একটি খোলা কারাগারে পরিণত করেছে। ভূমি, আকাশ ও জলসীমাÑ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণাধীন। খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত। ইসরায়েল প্রায়ই বিভিন্ন অজুহাতে গাজায় বিমান হামলা চালায়, যার শিকার হয় সাধারণ মানুষ, শিশু, নারী এবং সামাজিক অবকাঠামো।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের ঘটনার পর এই সংকট নতুন মাত্রা পায়। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস হঠাৎ ইসরায়েলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে হামলা চালায়, যার জবাবে ইসরায়েল গাজায় ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ সামরিক অভিযান শুরু করে। বিমান হামলায় একের পর এক স্কুল, হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র ধ্বংস হয়। শিশুরা চাপা পড়ে ধ্বংসস্তূপের নিচে, নারীরা সন্তান হারান চোখের সামনে, পিতারা হারান পরিবার। মাত্র কয়েক মাসে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ নিহত হন এবং এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, যার অধিকাংশই নিরীহ বেসামরিক মানুষ। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ আক্রমণকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমাজের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যায়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্র একাধিকবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে ইসরায়েলকে রক্ষা করেছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের নিপীড়নের হৃদয়বিদারক চিত্র প্রতিনিয়ত উঠে আসছে। স্কুলে যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ শিশুরা, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হাসপাতাল, রক্তাক্ত রাস্তার ধারে কাঁদতে থাকা বাবা-মা সবই যেনো নীরব পৃথিবীর দিকে আর্তনাদ করে বলছে : আমরা মানুষ, আমরাও বাঁচতে চাই। অথচ এসব চিত্র বিশ্ববাসীরসংবেদনশীলতা জাগাতে যতটা সক্ষম, রাজনৈতিকভাবে ততটা প্রতিফলিত হচ্ছে না। পশ্চিমা বিশ্ব ও মিডিয়ার দ্বিমুখী আচরণÑ একপক্ষের প্রতি সহানুভূতি ও অন্যপক্ষের প্রতি নির্লিপ্ততা এই সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে।
এখানে প্রশ্ন জাগেÑ এই সংকটের শেষ কোথায়? বিশ্ব যদি সত্যিই মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে, তবে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুযায়ী পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই এ সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র ন্যায়সংগত পথ। জাতিসংঘের ১৯৪ ও ২৪২ নম্বর রেজোলিউশন, অসংখ্য আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র, এমনকি অনেক পশ্চিমা দেশের নেতারাও এই দুই রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানকে সমর্থন করেন। তবে কেবল নীতিগত সমর্থন যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন কার্যকর ক‚টনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আনতে হবে। দখলদার ভূখন্ড থেকে সেনা প্রত্যাহার, গাজা থেকে অবরোধ প্রত্যাহার এবং বসতি নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আরব ও মুসলিম বিশ্বকে কেবল বক্তব্য নয়, কার্যকর কূটনৈতিক চাপ ও একতাবদ্ধ ভূমিকা রাখতে হবে। ফিলিস্তিনি নেতৃত্বকেও অভ্যন্তরীণ বিভক্তি ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবেবিশ্বমঞ্চে তাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে হবে। আসলে এই সংঘাতের মূলে রয়েছে দখল ও আধিপত্যের রাজনীতি, যেখানে মানবতা বারবার পরাজিত হয় রাষ্ট্রীয় শক্তির কাছে। ফিলিস্তিনিরা শুধু জমি নয়, হারাচ্ছে তাদের ভবিষ্যৎ, স্বপ্ন ও স্বাধীনতার সম্ভাবনা। একটি জাতির দীর্ঘ দুঃখগাথা যখন বিশ্ব বিবেককে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়, তখন সভ্যতার উৎকর্ষ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
এই মুহূর্তে দরকার একটি নৈতিক বিপ্লব- যেখানে জাতিসংঘ ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো মানবিকতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের নয়। ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, পুরো বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। কারণ, একটি জাতি দীর্ঘকাল ধরে যখন ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তখন তা কেবল একটি ভূখন্ডের সংকট নয়- তা হয়ে ওঠে সমগ্র মানবজাতির ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। আর এই ব্যর্থতাকে রুখতেই এখন প্রয়োজন সম্মিলিত ও দৃঢ় আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ।
ফিলিস্তিন সংকট আজ আর শুধু একটি জাতিগোষ্ঠীর নয়, এটি পৃথিবীর ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও মানবাধিকার ধারণার এক বিশাল পরীক্ষা। বিশ্ব আজ যেখানে গণতন্ত্র ও মানবতার বড় বড় কথা বলছে, সেখানে ফিলিস্তিনের নিষ্পেষিত জনগণের দিকে চেয়ে দেখা উচিতÑ পৃথিবীর এক প্রান্তে বসবাসকারী এই মানুষগুলোও শান্তি, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকার রাখে। আর সেই অধিকার নিশ্চিতের নামইÑ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র।
লেখক : ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিক